একক কর্তৃত্বের ওপর সবাই নির্ভরশীল
Share on:
আমাদের দেশের পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, প্রতিষ্ঠানগুলো আর স্বতন্ত্রভাবে সক্রিয় থাকতে পারছে না। একক কর্তৃত্বের ওপর সবাই নির্ভরশীল। এসব আমরা পত্রিকা এবং মন্ত্রীদের বক্তব্যের মধ্য দিয়েও বুঝতে পারি। যেমন কোথাও অপরাধ বা দুর্নীতি বা কেউ খুন হোক বা কোনো বড় ঘটনা, তখন আমরা শুনি মন্ত্রী বলছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন’, ‘প্রধানমন্ত্রী নজর রাখছেন’ ইত্যাদি। যেন প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ না দিলে মন্ত্রীদের কোনো চলনশক্তি নেই।
আনু মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক। তিনি ‘সর্বজনকথা’ পত্রিকার সম্পাদক। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। অর্থনীতি, রাজনীতি, সামাজিক উন্নয়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর ৪৫টির বেশি বই রয়েছে। সম্প্রতি তাঁর প্রকাশিত বইয়ের নাম: পুঁজির বিশ্বযাত্রা এবং চীন: পরাশক্তির বিবর্তন। দৈনিক আজকের পত্রিকায় প্রকাশিত সাক্ষাতকারটি নিচে তুলে ধরা হলো।
প্রশ্ন : নতুন মন্ত্রিসভা সম্পর্কে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
আনু মুহাম্মদ: মন্ত্রিসভা নিয়ে আমার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।
প্রশ্ন: কারণটা কী?
আনু মুহাম্মদ: এই সরকার যে ধরনের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সরকার গঠন করেছে, তাতে নাগরিকদের গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান—মানে বাছাইয়ের কোনো সুযোগ ছিল না। ফলে আগের সরকার তার ইচ্ছামতো লোকজন ঠিক করেছে। নির্বাচন নয়, মনোনয়ন-প্রক্রিয়ায় যেভাবে এসেছে তাতে নাগরিকদের ভূমিকা ছিল ‘মৃত সৈনিকের’! এর মধ্যে তাই কোনো পরিবর্তন নেই। পরিবর্তন না থাকার কারণে আমার আশঙ্কা হচ্ছে, আগের ধারাবাহিকতাতেই দেশ পরিচালিত হবে। যেখানে স্বচ্ছতা, জবাবদিহির কোনো স্থান নেই। সবকিছুতে জোরজবরদস্তি আর দুর্নীতি। নাগরিকদের মতামত নয়, দেশি-বিদেশি কতিপয় গোষ্ঠীর স্বার্থই প্রধান। তাতে দেশ ও মানুষের বড় ক্ষতি হলেও কোনো প্রতিকার নেই। সেই ধারাবাহিকতায় নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। কয়েকজন মন্ত্রী পরিবর্তিত হয়েছে, এটা ঠিক। কিন্তু তাতে কী আসে-যায়? বাংলাদেশে তো আলাদাভাবে মন্ত্রণালয়ের কোনো ভূমিকা নেই। আবার মন্ত্রীদেরও আলাদা কোনো ভূমিকা বা কার্যকারিতা নেই।
বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থাটা এ রকম দাঁড়িয়েছে। মন্ত্রীদের আপেক্ষিক ক্ষমতা, স্বাধীনতা ও সক্রিয়তাও দুর্লভ। এখন সব মন্ত্রী, মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠান প্রধানমন্ত্রীর একক কর্তৃত্বের ওপর নির্ভরশীল এবং তাঁর দ্বারা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত। কাজেই বেশি দক্ষ, অদক্ষ, বেশি দুর্নীতিবাজ, কম দুর্নীতিবাজ, বেশি চাপাবাজ, কম চাপাবাজ, ভদ্র বা অভদ্র এ ধরনের পার্থক্য এখন আর কোনো কাজ করে না। মন্ত্রণালয়ের সব ধরনের সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রীর একক কর্তৃত্বেই হয়। মন্ত্রীরা সারাক্ষণ ওপরের নির্দেশের দিকেই তাকিয়ে থাকেন, আর প্রধানমন্ত্রীর বন্দনা করেন। শুধু হয়তো কিছু ক্ষেত্রে অনিয়ম, স্বজনতোষণ বা দুর্নীতির ক্ষেত্রে নিজের আলাদা সক্রিয়তা থাকে।
একটি দেশকে যদি ন্যূনতম গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে চলতে হয়, তাহলে সেখানে প্রতিষ্ঠান কার্যকর থাকা জরুরি। শুধু সরকার কোনো প্রতিষ্ঠান হতে পারে না। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে কার্যকর থাকতে হয়। আদালত, দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার সংস্থা, নির্বাচন কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংক, বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান যদি প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় কাজ করতে পারে, তাহলে সরকার যদি কোনো ভুল করে বা কোনো ধরনের বিচ্যুতি ঘটে, তাহলে সংশোধন করার সুযোগ থাকে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির প্রক্রিয়া তৈরি হয়।
আমাদের দেশের পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, প্রতিষ্ঠানগুলো আর স্বতন্ত্রভাবে সক্রিয় থাকতে পারছে না। একক কর্তৃত্বের ওপর সবাই নির্ভরশীল। এসব আমরা পত্রিকা এবং মন্ত্রীদের বক্তব্যের মধ্য দিয়েও বুঝতে পারি। যেমন কোথাও অপরাধ বা দুর্নীতি বা কেউ খুন হোক বা কোনো বড় ঘটনা, তখন আমরা শুনি মন্ত্রী বলছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন’, ‘প্রধানমন্ত্রী নজর রাখছেন’ ইত্যাদি। যেন প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ না দিলে মন্ত্রীদের কোনো চলনশক্তি নেই। এভাবে যদি প্রধানমন্ত্রীর একক কর্তৃত্ব দিয়েই সবকিছু চলে তাহলে মন্ত্রী পরিবর্তন হলে চেহারা ছাড়া কী পরিবর্তন হবে? কোনো দেশে ন্যূনতম গণতান্ত্রিক সরকারে এ রকম কোনো উদাহরণ নেই যে প্রধানমন্ত্রীর একক কর্তৃত্বে সবকিছু চলে। এত মন্ত্রী আসলে কেন জনগণের টাকায় রাখা হয়, সেটাই প্রশ্ন।
প্রশ্ন: নতুন সরকারের সামনে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো কী?
আনু মুহাম্মদ: তারা কোনটাকে চ্যালেঞ্জ মনে করে, সেটা তারাই ভালো বলতে পারবে। এই সরকার নতুন করে নির্বাচিত হওয়ার পর যেসব কথাবার্তা বলছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে, জনগণের সব ধরনের সমস্যাকে অস্বীকার করার প্রবণতা তাদের একই রকম আছে।
জনগণের কাছে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, নিরাপত্তার সমস্যা, শিক্ষা, চিকিৎসা ভালোভাবে পাচ্ছে না। দিন দিন এসবের ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। জনগণের জন্য বিপজ্জনক হচ্ছে, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি ব্যয় বাড়ছে, দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাচ্ছে। সরকার এগুলোকে তো গুরুত্ব দিচ্ছে না কখনোই। যদি জাতীয়ভাবে চিন্তা করি, তাহলে আমাদের দেশে দুর্নীতি হলো একটা বড় সমস্যা।
প্রধানমন্ত্রী এর আগেও বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স, এখনো বলছেন। অতীতে তাঁর মুখে যতই আমরা এ কথা শুনেছি, ততই দুর্নীতি কিন্তু বেড়েছে। দুর্নীতিবাজ হিসেবে নানা রকম বাধাবিপত্তি থাকার পরেও পত্রিকায় যেসব রিপোর্ট প্রকাশিত হয়, কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে আমরা দেখিনি। আরেকটা হচ্ছে, দুর্নীতির সঙ্গে সম্পর্কিত বিদেশে অর্থ পাচার। এ ছাড়া ঋণ ও আমদানিনির্ভর, দুর্নীতি, অপরিকল্পিত এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে খুবই ক্ষতিকর মেগা প্রকল্পের কারণে দেশের ওপর বড় আর্থিক বোঝা তৈরি হয়েছে। প্রধানত, এসব কারণেই ডলার ও রিজার্ভের সংকট তৈরি হচ্ছে।
এখন সরকার যদি এসব সমস্যাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়, এর সমাধান করার উদ্যোগ নেয়, তাহলে তো তার পুরো উন্নয়ন যাত্রারই মৌলিক পরিবর্তন করতে হবে। কীভাবে এত ঋণ ও আমদানিনির্ভর হয়ে গেল অর্থনীতি? এত ঋণ ও আমদানিনির্ভর তো হওয়ার দরকার ছিল না। শুধু দুর্নীতি কমিশন আর কতিপয় গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে এ অবস্থা হয়েছে। এগুলোই অর্থনীতিকে বিপদ ও সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। সরকার যদি এসব সংকট হিসেবে স্বীকার করে তাহলে তো তার ঘাড় ঘোরাতে হবে জনগণের দিকে।
কিন্তু এখনো সরকারের মধ্যে প্রবণতা দেখতে পাচ্ছি—আগের মতোই সংকটের দায়কে অস্বীকার করা। যে কারণে এই সংকটের সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলোকে আগে তো স্বীকার করতে হবে। এবারের নির্বাচনের পরও তো সেটা দেখতে পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে, সরকারের কাছে প্রধান চ্যালেঞ্জ ক্ষমতায় চিরস্থায়ী হওয়ার পথ নিশ্চিত করা, একদলীয় নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা আর তার জন্য সব ধরনের সমালোচনা, ভিন্নমত দমন করার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখা।
প্রশ্ন: এরপরও বাজার নিয়ন্ত্রণ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে মন্ত্রীরা কথা বলছেন। আপনি তাঁদের বিষয়ে কতটুকু আশাবাদী?
আনু মুহাম্মদ: এসব কথায় আমি কীভাবে আশাবাদী হব? আশাবাদী হতে পারি না এ কারণে, আগের মন্ত্রীরাও একই কথা বলেছেন, তাঁদের কথায় সততা ও গুরুত্ব কি দেখা গেছে? আর মন্ত্রীর ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব নিয়েই তো আমার সন্দেহ আছে। সেই পরিস্থিতির যদি পরিবর্তন না হয়, প্রধানমন্ত্রীর একক কর্তৃত্বে যদি সবকিছু পরিচালিত হয় আর সেটাই যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে তো সমাধান হবে না। কারণ এর আগে তো জিনিসপত্রের দাম কমেনি, দুর্নীতিও কমেনি; বরং বেড়েছে।
প্রশ্ন: দিন দিন রিজার্ভ কমে যাওয়ার কারণ কী?
আনু মুহাম্মদ: আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের দুটি পথ। এক. রপ্তানি থেকে আয়; দুই. রেমিট্যান্স থেকে আয়। এর সঙ্গে আছে বিদেশি বিনিয়োগ এবং ঋণ। এগুলো হলো বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের উৎস। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে সরকারি ও বাজারের দামের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। এই পার্থক্যের কারণে প্রবাসীদের একটা বড় অংশ বেসরকারি উপায়ে দেশে অর্থ পাঠাচ্ছেন। সরাসরি না পাঠানোর কারণে এটা মজুত হিসেবে আসছে না। বিষয়টি দাঁড়াচ্ছে—সরকার যদি প্রতি ডলারে ১০০ টাকা দেয় আর তাঁরা যদি বাইরে ১২০ টাকা পান। তাহলে তো তাঁরা সেই উপায়টাকে গ্রহণ করবেন।
আরেকটা হলো, আমদানি ও রপ্তানির মধ্যে নানা কায়দাকানুন করে বিপুল পরিমাণ ডলার পাচার হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে। যারা সম্পদ পাচার করছে, তারা ক্ষমতাবান, কাজেই তা বন্ধ হওয়ার পথও দেখা যাচ্ছে না। পাশাপাশি বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে। এই চাপটা সামনের দিকে আরও বাড়তে থাকবে।
প্রশ্ন: এই সংকট থেকে আমরা কীভাবে মুক্তি পেতে পারি?
আনু মুহাম্মদ: সরকার যে ঋণ ও আমদানিনির্ভর অতিব্যয়বহুল অস্বচ্ছ উন্নয়নের ধারা তৈরি করেছে, পরিপূর্ণ পরিবর্তন ছাড়া এর কোনো সমাধান হবে না। আশু জরুরি তিনটি কাজ—এক. ঋণ ও আমদানিনির্ভর ধারা অব্যাহত রাখা যাবে না। দুই. বিপুল পরিমাণ অর্থ যারা লুণ্ঠন করে বিদেশে পাচার করেছে, তাদের থামাতে হবে এবং ব্যবস্থা নিতে হবে। তিন. বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বাধীন ও স্বচ্ছভাবে কাজ করতে দিতে হবে। অর্থকরী খাতে যে বিষাক্ত বৃত্ত তৈরি হয়েছে, সেখান থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে কমপক্ষে এই তিন জায়গায় নজর দিতেই হবে। এ ছাড়া জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হলো ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী অনিয়ন্ত্রিতভাবে সরকারের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগে যৌক্তিক কোনো কারণ ছাড়াই জিনিসপত্রের দাম যখন-তখন বৃদ্ধি করছে। তাদের জন্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ করতে হবে। এ কাজগুলো ত্বরিত গতিতে না করতে পারলে জনগণের জীবন-সংকট আরও বাড়বে। সরকার কি এগুলো করবে?
সূত্র: আজকের পত্রিকা