মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: শুক্রবার ১৯, জানুয়ারী ২০২৪

দামের দাপটে অসহায় জনগণ

Share on:

চলমান পরিস্থিতির একটি বড় কারণ হিসেবে এসেছে অনিয়ন্ত্রিত মূল্যস্ফীতি। এ শুধু কথার কথা বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের অভিযোগ নয়। তথ্যাভিজ্ঞরা প্রসঙ্গক্রমে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সাম্প্রতিক বিশেষ রিপোর্টেরও উল্লেখ করেছেন। বলা দরকার, দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তিন মাস পরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়মিতভাবে যে রিপোর্ট প্রকাশ করে থাকে তারই জুলাই-সেপ্টেম্বরের তথ্য-পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে তৈরি করা হালনাগাদ রিপোর্টে বলা হয়েছে, গ্রাম ও শহরের উভয় ক্ষেত্রেই মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে চলেছে।


এটা অনেক পুরনো খবর যে, বাংলাদেশে খাদ্যপণ্যসহ প্রতিটি জরুরি পণ্যের দামই বেড়ে চলেছে। বাড়ছেও লাফিয়ে লাফিয়ে। সব মিলিয়ে অবস্থা এমন হয়েছে যে, উচ্চ মূল্য তথা আকাশচুম্বি দামের দাপটে বিপন্ন মানুষ অসহায় হয়ে পড়েছে। দেশের কোনো কোনো এলাকায় এমনকি দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলেও আশংকা প্রকাশ করেছেন তথ্যাভিজ্ঞরা। ভীতি ও উদ্বেগের কারণ হলো, এই বাস্তবতা সত্ত্বেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া কিংবা ইতিবাচক তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বলা হচ্ছে, প্রতিকারের চেষ্টা যেহেতু নেই সেহেতু নেই আশান্বিত হওয়ার কোনো সম্ভাবনাও। সে কারণে জনগণের সচেতন অংশ উদ্বিগ্নজনেরা নতুন একটি দুর্ভিক্ষের আশংকায় ভীত হয়ে পড়েছেন।

চলমান পরিস্থিতির একটি বড় কারণ হিসেবে এসেছে অনিয়ন্ত্রিত মূল্যস্ফীতি। এ শুধু কথার কথা বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের অভিযোগ নয়। তথ্যাভিজ্ঞরা প্রসঙ্গক্রমে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সাম্প্রতিক বিশেষ রিপোর্টেরও উল্লেখ করেছেন। বলা দরকার, দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তিন মাস পরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়মিতভাবে যে রিপোর্ট প্রকাশ করে থাকে তারই জুলাই-সেপ্টেম্বরের তথ্য-পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে তৈরি করা হালনাগাদ রিপোর্টে বলা হয়েছে, গ্রাম ও শহরের উভয় ক্ষেত্রেই মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে চলেছে। বিশেষ করে গ্রাম এলাকায় উচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতির হারের কারণে গ্রামীণ দরিদ্রদের মধ্যে এর আঘাত বেশি আসছে। গ্রামে দরিদ্রদের মধ্যে হারের সঙ্গে আঘাতও বেশি আসছে। এর ফলে ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণে নি¤œ আয়ের মানুষকে প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখে পড়তে হচ্ছে। এছাড়া উচ্চ মূল্যস্ফীতি অর্থনীতির প্রায় সব সূচককেই আঘাত করছে। সে কারণে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ¦গতি নিয়ন্ত্রণকেই এখন সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিতে হচ্ছে। কিন্তু সরকার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক উভয়ের পক্ষ থেকে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণকে প্রাধান্য দেয়া হলেও বিগত বছরের শেষ দুই মাসে মূল্যস্ফীতি কমে আসেনি। সব ধরনের পণ্যের মূল্য বরং বেড়ে চলেছে।

এ সম্পর্কে সর্বশেষ ধারণা পাওয়া গেছে একটি জাতীয় দৈনিকের প্রধান রিপোর্টে। ১৪ জানুয়ারি প্রকাশিত এই রিপোর্টে জানানো হয়েছে, গ্যাস বিদ্যুৎ ডিজেল এবং পানিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের দাম শুধু বেড়েই চলেছে। ‘দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ কঠিন’ শিরোনামে প্রকাশিত রিপোর্টে কয়েকটি পণ্যের তুলনামূলক মূল্যের উল্লেখ করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, ২০১৯ সালের পণ্যমূল্যের তুলনায় প্রায় সব পণ্যেরই মূল্য অনেক বেড়ে গেছে। যেমন ২০১৯ সালে যে মোটা চালের কেজির মূল্য ছিল ৩৮ থেকে ৪২ টাকা, ২০২৪ সালের শুরুতে সে চালের মূল্য হয়েছে ৪৮-৫২ টাকা। একইভাবে অন্য কিছু পণ্যের মূল্যেরও উল্লেখ রয়েছেওই রিপোর্টে - এখানে ২০১৯ এবং ২০২৪ সালের শুরুর মূল্যের পার্থক্য বোঝানোর জন্য কয়েকটি পণ্যের উল্লেখ করা হলো ঃ

সরু চাল ৫৪-৬২ঃ ৬০-৭৫; খোলা আটা ২৭-৩০ঃ ৩৫-৫০; খোলা সয়াবিন-৭৮-৮৪ঃ ১৫৫-১৬০; চিনি৪৮-৫৫ঃ ১৪০-১৪৫; মোটা মসুর ডাল- ৫৫-৬০ঃ ১০৫-১১০; অ্যাংকর ডাল- ৩৫-৫০ঃ ৬৫-৭৫; আলু- ২০-৩০ঃ ৫০-৬০; পেঁয়াজ- ২০-৩৫ঃ ৮০-১০০; রসুন- ৪০-৮০ঃ ২২০-২৬০; জিরা- ৩২০-৪৫০ঃ ৮৫০-১০৫০; ব্রয়লার মুরগি- ১২৫-১৩০ঃ ১৯৫-২০০; গরুর মাংস৪৭০-৫০০ঃ ৬৫০-৭০০; ডিম - ৩৪-৩৬ঃ ৪২-৪৫।

অন্য সব পণ্যেরও মূল্য বেড়েছে প্রায় সমান অনুপাতে। যেমন ৮০০ টাকার গ্যাসের মূল্য বেড়ে হয়েছে ১০৮০ টাকা। অন্যদিকে প্রতি ইউনিট বিবদ্যুতের মূল্য ৭ টাকা ৪৪ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে ৮ টাকা ২৫ পয়সা। আর প্রতি লিটার ডিজেলের মূল্য ৬৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১০৯ টাকা। একইভাবে প্রতি এক হাজার লিটার পানির দাম১১ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৫ টাকা ১৮ পয়সা। এভাবেই বিস্ময়কর পরিমানে বেড়েছে সকল পণ্যের মূল্য।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ রিপোর্টে আশার কথা শুনিয়ে বলা হয়েছিল, নানামুখী উদ্যোগ ও চেষ্টা সত্তেও কিছু খাতে অস্থিতিশীলতা এবং ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বাধাগ্রস্ত হলেও এসব প্রতিকূলতার মধ্যেই বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি সামনের দিকে এগোচ্ছে। কৃষিখাতে উৎপাদন বৃদ্ধি হচ্ছে, শিল্পখাতেও ঘটছে অগ্রগতি। একই সঙ্গে দেশের ভেতরে মানুষের চাহিদা যেমন বেড়েছে, তেমনি মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে সকল খাতে লাগাম টেনে ধরা হয়েছে। ফলে সব মলিয়ে উন্নয়নের গতিপথ মসৃণ হবে বলে আশা করা যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এই আশাবাদের অবশ্য বাস্তবায়ন ঘটতে পারেনি। এজন্যই বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় কোনো পণ্যেরই দাম কমেনি। সবই বরং মানুষের নাগালের অরেক বাইরে রয়ে গেছে। সামগ্রিক সংকটের মধ্যেও বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্টের মূলকথাগুলো অবশ্য আশাবাদের সৃষ্টি করেছিল। উৎসাহ যুগিয়েছিল। বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হারকে সহনীয় পর্যায়ে আনার পাশাপাশি অনুৎপাদনশীল বিভিন্ন খাতে ব্যয় কমানো গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির চাপ অনেক কমে যেতে পারে। সরকার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংাদেশ ব্যাংকের উচিত সে লক্ষ্যেই তৎপর হয়ে ওঠা। কিন্তু সে আশাও পূর্ণ হতে পারেনি। চাল, আটা ও ভুট্টাসহ খাদ্যপণ্যের দামে বাংলাদেশ বরং রেকর্ড তৈরি করেছে। চাল তো রয়েছেই, সেই সাথে গম ও ভুট্টার মতো দানাদার যেসব খাদ্যশস্য বাংলাদেশে মানুষ এবং গবাদি পশুর খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয় সেগুলো সম্পর্কে সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ ইউএসডিএ’র তৈরি করা এক রিপোর্টে জানানো হয়েছে, প্রধান তিন খাদ্যপণ্যের দাম অতীতে কখনো এত বেশি বাড়তে দেখা যায়নি। দিন কয়েক আগে বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিকের প্রধান খবরে মার্কিন রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে এ তথ্যেরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, চাল, আটা ও ভুট্টার উৎপাদনে বড় ধরনের কোনো হেরফের হয়নি, যার কারণে সেগুলোর দাম এত বেশি পরিমাণে বাড়বে। দাম বেড়েছে আসলে অন্য কিছু কারণে।

প্রধান খাদ্যশস্য তিনটির মূল্য সম্পর্কে ওই মার্কিন রিপোর্ট জানিয়েছে, এসবের মধ্যে কোনো একটিরও যদি দাম বাড়ে তাহলে অন্যগুলোর দামও বেড়ে যায়। বহু বছর ধরে এটাই নিয়মে পরিণত হয়েছে। একই কারণে সাম্প্রতিক সময়েও তিনটি শস্যেরই দাম বেড়েছে এবং এখনও বেড়ে চলেছে।

উদাহরণ হিসেবে রিপোর্টে খোলা বাজারে আটার দামের উল্লেখ করে জানানো হয়েছে, ২০২০ সালের জানুয়ারিতে প্রতি কেজি আটার দাম যেখানে ছিল ৩০ টাকার নিচে সেখানে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে সে আটার দামই বেড়ে হয়েছে ৫৫ টাকা। একইভাবে ৩২ টাকার আশেপাশে থাকা প্রতি কেজি মোটা চালের দাম ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ৫০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ওদিকে প্রধানত পশুর খাদ্য হলেও ভুট্টার দামও বেড়েছে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে প্রতি কেজি ভুট্টা ২৪ টাকার আশেপাশে পাওয়া গেলেও ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ভুট্টার দাম বেড়ে হয়েছে ৩৪ টাকা ৫০ পয়সা।

মার্কিন খাদ্য বিভাগের ওই রিপোর্টে দাম বেড়ে যাওয়ার কয়েকটি কারণেরও উল্লেখ করা হয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়া, জাহাজ ভাড়া ও অন্যান্য ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়া, লেনদেনের প্রধান মুদ্রা মার্কিন ডলারের মূল্য বৃদ্ধি এবং বাংলাদেশে উচ্চ হারে মূূল্যস্ফীতি। এ প্রসঙ্গে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হলো, বাংলাদেশ সরকারের কোনো মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেই কিন্তু মার্কিন রিপোর্টের কোনো তথ্য-পরিসংখ্যানের বিরোধিতা করা হয়নি। যেমন খাদ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, চালের দাম বাড়ার খবর ঠিক হলেও এবার আমনের উৎপাদন ভালো হয়েছে। সে কারণে ওই চাল বাজারে এলে চালের দাম কমতে শুরু করবে। খাদ্যমন্ত্রীর পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট অন্যজনেরা বলেছেন, সার ও জ্বালনি তেলের সঙ্গে অন্যান্য ব্যয় বেড়ে যাওয়াও চালের দাম বাড়ার প্রধান একটি কারণ। গম ও আটা এবং ভুট্টার দামও একই ধরনের বিভিন্ন কারণে বেড়েছে। এসবের সঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন বিষয়ে ভারতের নিষেধাজ্ঞা।

বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশে মানুষ এবং গবাদিপশুর প্রধান তিনটি খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে যাওয়ার খবর অত্যন্ত আশংকাজনক ও ভীতিকর। উল্লেখ্য, বাংলাদেশকে নিয়ে প্রায় নিয়মিতভাবে এ ধরনের রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। যেমন মাত্র কিছুদিন আগে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি এফএও বলেছিল, বাংলাদেশ উচ্চ ঝুঁকির সাত দেশের তালিকায় রয়েছে। ওই রিপোর্টে এফএও আরো বলেছিল, বাংলাদেশসহ উচ্চ খাদ্য ঝুঁকির সাত দেশে প্রধান খাদ্যের দাম অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় বিপুল পরিমাণ গরীব মানুষ ভীষণ বিপদের মধ্যে জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। মার্কিন খাদ্য বিভাগের আলোচ্য রিপোর্টের মূলকথায়ও একই ধরনের আশংকাই প্রকাশ করা হয়েছে।

বলার অপেক্ষা রাখে না, এ ধরনের কোনো রিপোর্টেই বাংলাদেশের জন্য আশার কারণ হতে পারে না। একই কারণে এ বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে উদ্যোগ নেয়া দরকার এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই দরকার মূল্য কমিয়ে আনার লক্ষ্যে সততার সঙ্গে উদ্যোগী হয়ে ওঠা।

সুত্র: দৈনিক সংগ্রাম