মাধ্যমিকের জন্য যা করতে হবে
Share on:
ব্যানবেইসের তথ্যেই দেখা যায়, গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে পাঠদানে নিয়োজিত শিক্ষকদের ৮০ শতাংশেরই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেই।
মাছুম বিল্লাহ
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে যে বাংলাদেশে মাধ্যমিক পর্যায়ে দক্ষ ও যথাযথভাবে প্রশিক্ষিত শিক্ষকের হার কমে আসছে। ২০১১ সালেও দেশের মাধ্যমিক শিক্ষা খাতে নিয়োজিত শিক্ষকদের মধ্যে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ শিক্ষকের হার ছিল ৭৫ শতাংশের কিছু বেশি। এখন তা নেমে এসেছে প্রায় ৬৮ শতাংশে। প্রশিক্ষিত ভালো শিক্ষক বলতে প্রধানত বিভিন্ন শিক্ষক ট্রেনিং ইনস্টিটিউট বা কলেজ থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়া শিক্ষকদের বোঝানো হয়েছে।
প্রশিক্ষণ শেষে এসব শিক্ষকের যোগ্যতার স্বীকৃতি হিসেবে সনদ দেওয়া হয়ে থাকে। ব্যানবেইসের প্রতিবেদনেও প্রশিক্ষিত শিক্ষক হিসেবে মূলত ব্যাচেলর অব এডুকেশন (বিএড), ব্যাচেলর অব ফিজিক্যাল এডুকেশন (বিপিএড), ব্যাচেলর অব অ্যাগ্রিকালচার এডুকেশন (বিএজিএড), মাস্টার্স অব এডুকেশন (এমএড) অথবা ডিপ্লোমা ইন এডুকেশন ডিগ্রিধারীদেরই বিবেচনা করা হয়েছে। পরিসংখ্যানের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে ২০১১ সালে দেশে মোট শিক্ষকের মধ্যে প্রশিক্ষিতের হার ছিল ৭৫.৩৬ শতাংশ। নারী শিক্ষকদের মধ্যে এই হার ছিল ৭৭.৪৩ শতাংশ।
এর পরপরই দেশে প্রশিক্ষিত শিক্ষকের হার নিম্নমুখী হয়ে ওঠে। গত দশকে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষায় প্রশিক্ষিত শিক্ষকের হার সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছিল ২০১৪ সালে। ওই সময়ে মোট শিক্ষকের ৬২.৩২ শতাংশ এবং নারী শিক্ষকদের ৬০.২৪ শতাংশ ছিল প্রশিক্ষিত। পরে ২০১৬ সালে প্রশিক্ষিত মোট শিক্ষকের হার বেড়ে দাঁড়ায় ৭০ শতাংশে।
একই সঙ্গে প্রশিক্ষিত নারী শিক্ষকের হার পৌঁছায় ৬৭.৭৮ শতাংশে। কিন্তু এর পর থেকে প্রশিক্ষিত শিক্ষকের হার আবারও কমতে শুরু করে। সর্বশেষ ২০২২ সালে প্রশিক্ষিত মোট শিক্ষকের হার ৬৭.৯১ শতাংশে এবং প্রশিক্ষিত নারী শিক্ষকের হার ৬৭.০২ শতাংশে পৌঁছায়।
পুরনো দক্ষ শিক্ষকদের অবসরগ্রহণ ও নতুনদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় প্রায় এক যুগে এমন পরিসংখ্যানগত পার্থক্য তৈরি হয়েছে বলে দাবি করছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর; যদিও শিক্ষকরা বলছেন, চাকরিরত প্রতিষ্ঠান থেকে বিএড ডিগ্রি অর্জনের জন্য ছুটি না পাওয়া এবং বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠানের সনদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে জটিলতা থাকায় শিক্ষকদের অনেকেই বিএড ডিগ্রি নিতে পারছেন না। ফলে মোট শিক্ষকের মধ্যে দক্ষ ও যথাযথভাবে প্রশিক্ষিত শিক্ষকের হারও এখন কমে চলেছে।
শিক্ষার উন্নয়নে আমরা যত পরিকল্পনা করি না কেন বা শিক্ষাক্রমে যতই পরিবর্তন আনি না কেন, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে না পারলে শিক্ষার উন্নয়ন সম্ভব নয়। বিষয়টি শিক্ষা প্রশাসনের বিবেচনায় রাখা উচিত। বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান থেকে সনদ পেলেও অনেক সময় বিএড স্কেল পাওয়া যায় না। নারী শিক্ষকদের বেশির ভাগকেই চাকরির পাশাপাশি পরিবার ও সন্তান সামলাতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে প্রশিক্ষণের জন্য বাড়তি সময় বের করাও অনেকের জন্য সম্ভব হয় না। এগুলো আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রের বাস্তবতা, যা অস্বীকার করা যাবে না।
দেশে শিক্ষার হার বাড়লেও এর গুণগত মানের উন্নতি খুব বেশি হয়নি বলে মনে করছেন শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। শিক্ষকসংকট তার অন্যতম কারণ। মাধ্যমিক পর্যায়ে সাধারণত শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতের ন্যূনতম মানদণ্ড ধরা হয় ১ঃ৩০। অর্থাৎ প্রতি ৩০ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে ন্যূনতম একজন শিক্ষক থাকবেন। অথচ ব্যানবেইসের প্রতিবেদন বলছে, মোট শিক্ষক-শিক্ষার্থী আদর্শ অনুপাতের কাছাকাছি থাকলেও ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির (আইসিটি) মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে শিক্ষকসংকট অত্যন্ত প্রকট। এর মধ্যে গণিতের ৪২২ ও ইংরেজির ৪১০ শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক রয়েছেন একজন। আর বিজ্ঞানে তা আরো বেশি—এক হাজার ২১ শিক্ষার্থীর পাঠদানে আছেন কেবল একজন শিক্ষক। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক যেসব বিষয় পড়ানো হয়, সেগুলোতে শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক তুলনা করে দেখা গেছে, তুলনামূলক কঠিন বিষয়গুলোকে কম গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষকদের অর্ধেকের বেশি সমাজবিজ্ঞান, ধর্ম, লাইব্রেরি বিজ্ঞান ও শারীরিক শিক্ষার। অন্যদিকে বর্তমানে আইসিটিতে প্রতি ৬৮৯ শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক রয়েছেন একজন। এ হিসেবে বাংলায় ৪৫৭, ইংরেজিতে ৪১০, গণিতে ৪২২ শিক্ষার্থীকে মাত্র একজন শিক্ষক পাঠদান করেন। ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞানের মতো বিষয়ে শিক্ষকসংখ্যা কম থাকায় অনেক সময় এমন শিক্ষকরাও এসব বিষয় পড়াতে বাধ্য হচ্ছেন, যাঁরা স্নাতক পর্যায়ে তা পড়ে আসেননি। ফলে শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি থেকে যাচ্ছে এবং এর প্রভাব পড়ছে শিক্ষার্থীদের সার্বিক পারফরম্যান্সে। মাধ্যমিক পর্যায়ে যারা অকৃতকার্য হচ্ছে, তাদের বড় অংশই ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান বা আইসিটিতে অকৃতকার্য হচ্ছে। অন্যান্য কারণের মধ্যে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকসংকট এর অন্যতম।
মাধ্যমিকের ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১ঃ২১০। বিজ্ঞান সাধারণত পড়িয়ে থাকেন ভৌতবিজ্ঞানের শিক্ষকরা। বিজ্ঞান বিষয়ে প্রতি এক হাজার ২১ জন শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষক রয়েছেন মাত্র একজন। এ ছাড়া ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষায় প্রতি ৩২৯ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক রয়েছেন। নবম ও দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্যের বিভাগভিত্তিক বিষয়গুলোতে এই সংকট আরো প্রকট। শিক্ষা পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভূগোল বিষয়ে প্রতি দুই হাজার ৮২৫ শিক্ষার্থীকে পাঠদান করান একজন শিক্ষক। বিভাগভিত্তিক বিষয়গুলোর মধ্যে ভালো অবস্থানে রয়েছে জীববিজ্ঞান। এ বিষয়ে প্রতি একজন শিক্ষকের কাছ থেকে জ্ঞান অর্জন করে ৬৫ জন শিক্ষার্থী। শিক্ষা পরিসংখ্যানের তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে মোট দুই লাখ ৭৮ হাজার ৬০৮ জন শিক্ষকের মধ্যে সমাজবিজ্ঞান, ধর্ম, বাংলা, কৃষিবিজ্ঞান, শারীরিক শিক্ষা, গার্হস্থ্য অর্থনীতি ও লাইব্রেরি বিজ্ঞানে শিক্ষক রয়েছেন এক লাখ ৪১ হাজার ১৪৮ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিক্ষক সমাজবিজ্ঞানে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শিক্ষক ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষায়। ভাষাগত শিক্ষকের সংকট সব দেশেই রয়েছে। তবে আমাদের দেশে শুধু ভাষা নয়, সব ক্ষেত্রেই শিক্ষকসংকট। এটি কাম্য নয়। বিশেষ করে বিদ্যালয়গুলোতে অনেক সময় দেখা যায়, যিনি আইসিটি পড়াচ্ছেন, গণিত বা ইংরেজি পড়াচ্ছেন. তিনি সে বিষয়ে স্নাতক করেননি। ফলে শিক্ষার্থীরা যা শিখছে, সেখানে ঘাটতি থাকছে। এই চর্চা থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। এখন আমাদের সব ক্ষেত্রে আইসিটি শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাই ভালো শিক্ষক পেতে হলে শিক্ষা ক্যাডারে আইসিটি যুক্ত করা প্রয়োজন।
ব্যানবেইসের তথ্যেই দেখা যায়, গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে পাঠদানে নিয়োজিত শিক্ষকদের ৮০ শতাংশেরই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেই। ২০২২ সালে প্রকাশিত এ তথ্য অনুযায়ী দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিষয়ের পাঠদানে নিয়োজিত শিক্ষকদের ৮৪ শতাংশেরই সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ডিগ্রি নেই। একই চিত্র দেখা যায় গণিতের ক্ষেত্রেও। গণিতে ডিগ্রি রয়েছে কেবল ১৯ শতাংশ শিক্ষকের। বাকি ৮১ শতাংশই অন্য বিষয়ে ডিগ্রিধারী।
আমরা জানি, আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে ২০০৭ সালে চালু হয় সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি এবং ২০১২ সালে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমরা অনেক চ্যালেঞ্জ দেখেছি। সৃজনশীল প্রশ্ন চালুর দেড় দশক পরেও এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষক সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করতে পারছেন না। মাউশির অধীন নয়, এমন অঞ্চলের ছয় হাজার ৭৮৪টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পরিচালিত সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী ৩৮.১৬ শতাংশ শিক্ষকই সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করতে পারেন না। ১৪.৮৬ শতাংশের অবস্থা খুবই নাজুক। তারা বাইরে থেকে তৈরি করা প্রশ্নপত্র দিয়ে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেন। এর আগে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে একই ধরনের আরেক সমীক্ষায় দেখা যায়, সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করতে পারেন না ৪১.৭৩ শতাংশ শিক্ষক।
শিক্ষার প্রধান ও প্রথম উপকরণ হচ্ছে ভাষা। এর মাধ্যমেই তো আমরা আমাদের মনের ভাব প্রকাশ করে থাকি। বাংলা মাতৃভাষা হিসেবেও আমাদের চর্চা করা উচিত এবং আমাদের জ্ঞানচর্চার মাধ্যম হওয়া উচিত। এ ভাষার প্রতি গুরুত্ব না দেওয়া হলে শিক্ষার্থীরা জ্ঞানের জগতে প্রবেশে বড় ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হবে এবং এরই মধ্যে হচ্ছে। ইংরেজি আমাদের দ্বিতীয় ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইংরেজির প্রতি গুরুত্ব দিতেই হবে। প্রশিক্ষিত ভালো শিক্ষকের অভাবে শিক্ষার্থীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একজন স্নাতক, স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করলেও তিনি শিক্ষার্থীদের কিভাবে পড়াবেন বা শেখাবেন, শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় কিভাবে সামাল দেবেন—এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। সবচেয়ে বড় কথা, শুধু প্রশিক্ষণ নিলেই হবে না, প্রতি বিষয়ের শিক্ষকদের নিয়মিত অনুশীলন এবং পেশার প্রতি ডেডিকেশনের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে।
সূত্র: দৈনিক কালেরকন্ঠ
তারিখ: ১৬ জানুয়ারি, ২০২৪