গণতন্ত্র-মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অনুপস্থিতিসহ একদলীয় শাসন ব্যবস্থা বেশি দিন থাকবে না
Share on:
দেশকে এগিয়ে নিতে হলে মুক্ত গণমাধ্যমের ভূমিকা শক্তিশালী করতে হবে। সংবাদ অবাধে প্রচার করতে না পারলে দেশ ও জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গণতন্ত্র বাধাগ্রস্থ হয় এবং সরকারের পক্ষে জনগণের সমস্যাগুলো জানা সম্ভব হয় না। সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকদের কাজ হলো সমাজের সমস্যাগুলো জনগণের সামনে তুলে ধরা। সরকারকে সচেতন করা। তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করা। অন্যদিকে দেশে কি ধরনের কাজ হচ্ছে বা না হচ্ছে তা সবাইকে জানানো।
অতীতের তিন দফা নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের নির্বাচনের মাধ্যমেও আওয়ামী লীগ আবারো তাদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের মাধ্যমে একদলীয় শাসন পাকাপোক্ত করার চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে বলে মন্তব্য লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি এলডিপি চেয়ারম্যান কর্ণেল (অব.) ড. অলি আহমেদ বীর বিক্রম এর। তিনি বলেছেন, ‘আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আল্লাহর মেহেরবানিতে এই ব্যবস্থা বাংলাদেশে বেশি দিন চালু থাকবে না। আল্লাহ নিশ্চয়ই এই অন্যায়ের প্রতিকার করবেন। সুদিন আসবেই। মানুষকে শুধু ধৈর্য ধারণের পাশাপাশি ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে নামতে হবে। দৈনিক সংগ্রাম এর ৪৯তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।
কর্ণেল (অব.) ড. অলি আহমেদ বীর বিক্রম। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক মন্ত্রী। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে তার সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর বিক্রম খেতাব প্রদান করে। স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্নেল পদে উন্নীত হয়ে অবসর নেন। পরে রাজনীতিতে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি-এলডিপি এর চেয়ারম্যান। এর আগে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বিএনপি গঠন করলে তিনি সেনাবাহিনীতে তার চাকরি ছেড়ে রাজনীতিতে যোগ দান করেন। পরবর্তীতে এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেন। ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠন করলে তিনি যোগাযোগ মন্ত্রী হন। কর্ণেল অলি আহমেদ ১৩ ই মার্চ ১৯৩৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পৈতৃক বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলার চন্দনাইশে। তার বাবার নাম আমানত ছাফা এবং মায়ের নাম বদরুননেছা। তার স্ত্রীর নাম মমতাজ বেগম। তিনি দুই কন্যা সন্তানের জনক। সম্প্রতি দেশের মত প্রকাশ, গণমাধ্যমের স্বাধীনতাসহ দেশের সার্বিক অবস্থা নিয়ে এ প্রতিবেদকের সাথে কথা বলেন। নীচে সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো।
দৈনিক সংগ্রাম : দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা কতটা রয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
কর্ণেল অলি : বর্তমান সরকার সুকৌশলে জেনারেল মঈন ইউ আহমদ এবং ফখরুদ্দিনের ষড়যন্ত্রের ফসল হিসেবে ২০০৯ সালে সরকার গঠন করে। মূলত তখন থেকেই শুরু হয় দেশে বিরোধী দলের উপর নিপীড়ন-নির্যাতন। জেল-জুলুম হুলিয়া, গুম এবং ক্রমশ একদলীয় বাকশালী শাসনের দিকে অগ্রসর হয়। সেই সাথে অনেকটা রুদ্ধ হয়ে যায় মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে দেখতে পাই, যারাই সরকারের দুর্নীতি, অনিয়ম, হামলা মামলার কথা বলছে, তাদের উপর নির্যাতন নেমে আসছে। তিনি বলেন, ২০২৪ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে তারা আবারো তাদের সন্ত্রাসী কর্মকা-ের মাধ্যমে একদলীয় শাসন পাকাপোক্ত করার চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। দেশে গণতন্ত্র নাই বললেই চলে। গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং মত প্রকাশের অধিকার যেভাবে থাকার কথা, তা সেভাবে নেই। ফলে সমাজে অস্থিরতা বিরাজ করছে। অন্যদিকে অর্থনীতির সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে।
দৈনিক সংগ্রাম : আপনি কী মনে করেন, দেশের গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে?
কর্ণেল অলি : মত প্রকাশ না করতে পারলে জনগণের যে সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে তা সম্পূর্ণভাবে খর্ব হয়। এছাড়াও যারা সরকার পরিচালনা করে তাদের পক্ষে দেশের কোথায় কি হচ্ছে সে তথ্যগুলিও পাওয়া সম্ভব হয় না। এই দেশে এখন গণমাধ্যম সেভাবে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে বলে আমি মনে করি না। পত্রিকার দেখতে পাই, সত্য বলার কারণে বা লিখার কারণে নাজেহাল হতে হচ্ছে, জেলে যেতে হচ্ছে।
দৈনিক সংগ্রাম : মুক্ত গণমাধ্যম স্বাধীন দেশ ও জনগণের জন্যে কতটা জরুরি?
কর্ণেল অলি : দেশকে এগিয়ে নিতে হলে মুক্ত গণমাধ্যমের ভূমিকা শক্তিশালী করতে হবে। সংবাদ অবাধে প্রচার করতে না পারলে দেশ ও জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গণতন্ত্র বাধাগ্রস্থ হয় এবং সরকারের পক্ষে জনগণের সমস্যাগুলো জানা সম্ভব হয় না। সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকদের কাজ হলো সমাজের সমস্যাগুলো জনগণের সামনে তুলে ধরা। সরকারকে সচেতন করা। তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করা। অন্যদিকে দেশে কি ধরনের কাজ হচ্ছে বা না হচ্ছে তা সবাইকে জানানো। তবে এখানে শর্ত থাকে যে, একজন সাংবাদিককেও দায়িত্বশীল হতে হবে। মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করা থেকে বিরত থাকতে হবে। ব্যক্তিগত ভাবে কোন সংবাদ চাপানোর পূর্বে সাংবাদিকের নিকট সঠিক তথ্য থাকা উচিৎ। অন্যথায় কারো বিরুদ্ধে কোনো কিছুর বিনিময়ে মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করাটা ইসলাম ধম্যের দৃষ্টিকোণ থেকেও পাপ। সকল ক্ষেত্রে মনুষ্যত্বকে প্রাধান্য দিতে হবে। এবং দেশের প্রচলিত নিয়মনীতিকে শ্রদ্ধা করতে হবে।
দৈনিক সংগ্রাম : ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট এর পরিবর্তে সাইবার সিকিউরিটি এ্যাক্ট করা হয়েছে। আপনি কী মনে করেন এতে সাংবাদিকদের হয়রানি কমবে?
কর্ণেল অলি : ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট এবং সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট দু’টির মধ্যে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য প্রার্থক্য নেই। এখানে দেখতে হবে এটি শুধু সাংবাদিক নয়, বিরোধী দলের সকল স্তরের মানুষকে নির্যাতন নিপীড়ন করারও অন্যতম একটি পন্থা। এই নির্যাতন বর্তমান সরকারের জন্য নতুন কোনো বিষয় না। বঙ্গবন্ধ শেখ মুজিবুর রহমানের সময়ও শুধু চারটি সংবাদপত্র ছিল। অবিশিষ্টগুলো বন্ধ করে দিয়ে সাংবাদিক এবং গণমাধ্যমের কন্ঠরোধ করা হয়েছিল। ফলে দেশে দুর্ভিক্ষ নেমে আসে। গুপ্ত হত্যা, গুম বৃদ্ধি পায়। মানুষ ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হয়। মানুষের মধ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা এবং অস্বস্তি কাজ করে। প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের সরকারগুলি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়না। তারা বন্দুকের উপর নির্ভর করে সরকার পরিচালনা করে। অবশেষে কিন্তু তা সফল হয় না।
দৈনিক সংগ্রাম : ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আপনি কী মনে করেন, দেশ সংকট থেকে মুক্তি পাবে?
কর্ণেল অলি : আওয়ামী লীগ একটি সন্ত্রাসী রাজনৈতিক দল। তারা কখনো অতীতে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করতে পারে নি। আমরা যদি সুদূর অতীতের দিকে তাকাই, ১৯৯৬ সালে মখা আলমগীরের নেতৃত্বে আওয়ামীপন্থী সরকারি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে মঞ্চ তৈরি করে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ভোট চুরি করে সরকার গঠন করে। ২০১৪ সালে বিনােেভাটে সরকার গঠন করে। ২০১৮ সালে রাতের ভোটে সরকার গঠন করে। ২০২৪ সালে দিনের বেলা প্রক্যেকটি ভোট কেন্দ্রের গোপন কক্ষে ব্যালট পেপারে সিল মেরে ৪০ পার্সেন্ট ভোট দেখায়। যা প্রকৃতপক্ষে ৭ থেকে ১০ শতাংশের ঊর্ধ্বে নয়। অনেকের মতে ২ থেকে ৫ শতাংশের বেশি ভোট কাস্টিং হয়নি। এই দল কখনো জনগণকে বিশ্বাসও করে না, আস্থায়ও নিতে পারে নি। বিদেশী কিছু প্রভুদের প্রত্যক্ষ সাহায্য নিয়ে জনগণের উপর অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে।্ আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আল্লাহর মেহেরবানিতে এই ব্যবস্থা বাংলাদেশে বেশি দিন চালু থাকবে না। আল্লাহ নিশ্চয়ই এই অন্যায়ের প্রতিকার করবেন। অচিরেই সুদিন আসবে। মানুষকে শুধু ধৈর্য ধারণ করতে হবে এবং সাংবিধানিক পন্থায় অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে জাতি-ধর্ম দলমত নির্বিশেষে বিরোধী দলের প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, সরকার বিরোধী কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে হবে। এই অবৈধ সরকারের পতনের দায়িত্ব শুধু রাজনৈতিক দলের উপর ছেড়ে দিলে হবে না। দেশ প্রেমিক সকল নাগরিককে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় হতে হবে।
দৈনিক সংগ্রাম : ১৭ জানুয়ারি দৈনিক সংগ্রামের ৪৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। প্রতিষ্ঠানটির সাংবাদিক-কর্মচারী ও পাঠকের উদ্দেশে কিছু বলুন।
কর্ণেল অলি : দৈনিক সংগ্রামের ৪৯তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে দেশের সিনিয়র এ রাজনীতিবিদ বলেন, প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে পত্রিকার এডিটর, প্রধান রিপোর্টার, সকলস্তরের সাংবাদিক, পাঠকসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাই। আমাদের সকলকে দেশের কথা চিন্তা করতে হবে, জনগণের কথা চিন্তা করতে হবে। সম্পূর্ণ বিশ্বস্ততার সাথে, আল্লাহ ও তার রাসুলের নির্দেশিত পথে চলতে হবে, জীবনধারণ করতে হবে। এতেই সকলের মঙ্গল এবং সমাজে শান্তি ফিরে আসবে। আশা করি দৈনিক সংগ্রাম তার আদর্শ থেকে কখনো বিচ্যুত হবে না। দেশের গণতন্ত্র, ভোটাধিকার, ন্যায়বিচার, জনগণের সমস্যা সমাধানসহ সর্বোপরি স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের পক্ষে তাদের ভূমিকা অব্যাহত রাখবে। আশা করি জনগণের আশা আকাংখা পূরণে সত্যকে ধারণ করে আপনারা জনগণের পাশে থেকে দেশের মঙ্গলের জন্য কাজ করবেন। দেশ ও দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের জন্য মঙ্গল হবে, সেটিই তুলে ধরবেন। আমি এবং আমার দলের পক্ষ থেকে আপনাদের উত্তোরোত্তর সমৃদ্ধি কামনা করি।
সূত্র: দৈনিক সংগ্রাম