শেখ হাসিনার ভারত সফর: একটি মূল্যায়ন
Share on:
আসিফ আরসালান: বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সদ্য সমাপ্ত ভারত সফরের ফলাফল নিয়ে রাজনৈতিক মহল এবং নাগরিক সমাজে বিরাট গুঞ্জন এবং ধোঁয়াসার সৃষ্টি হয়েছে। তার সফরের ৪/৫ দিন আগে ভারতের মেইনস্ট্রিম মিডিয়াতে নানান রকম জল্পনা কল্পনার সৃষ্টি হয় এবং বেশ কয়েকটি এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়।
যেসব পত্র পত্রিকা এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এসব খবর প্রকাশিত হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো টাইমস অব ইন্ডিয়া, হিন্দুস্তান টাইমস, দি হিন্দু, টাইমস নাউ, দি ইকনোমিক টাইমস, প্রিন্ট মিডিয়া এনডিটিভি প্রভৃতি। ঐসব রিপোর্ট থেকে বাংলাদেশের গণমাধ্যম যথা ইংরেজি ডেইলি স্টার, বাংলা প্রথম আলো, দৈনিক সমকাল, দৈনিক ইনকিলাব প্রভৃতি পত্রিকায় এক্সক্লুসিভ স্টোরি ছাপা হয়। কিন্তু গতকাল শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ভারত এবং বাংলাদেশের মেইনস্ট্রিম পত্র পত্রিকাগুলোর অনলাইন সংস্করণ ভিজিট করে দেখা গেল যে ঐ সমস্ত এক্সক্লুসিভ স্টোরি দুই প্রধানমন্ত্রীর যৌথ বিবৃতিতে স্থান পায়নি। সাধারণত দেখা যায় যে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সরকার প্রধানদের বৈঠকের পর যৌথ ইশতেহার প্রকাশিত হয়। কিন্তু শেখ হাসিনার এই সফরে কোনো যৌথ ইশতেহার প্রকাশিত হয়নি। যেটি হয়েছে সেটি হলো যৌথ বিবৃতি। এই যৌথ বিবৃতিতে উল্লেখ করার মতো কিছু নাই। কূটনৈতিক শিষ্টাচার বজায় রেখে কতিপয় কূটনৈতিক পরিভাষায় বলা হয়েছে যে উভয় দেশের সরকার তাদের বিদ্যমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে আরো উচ্চতায় নিয়ে যাবেন।
বাংলাদেশের অনলাইন সংস্করণগুলোও বিকালে ভিজিট করলাম। একমাত্র বাংলা দৈনিক মানবজমিনের অনলাইন সংস্করণে বলা হয়েছে যে বৈঠক শেষে উভয় দেশের মধ্যে দশ দফা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই দশ দফা সমঝোতা স্মারক নিম্নে তুলে দেওয়া হলো।
১. বাংলাদেশ-ভারত ডিজিটাল পার্টনারশিপ।
২. ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ গ্রিন পার্টনারশিপ।
৩. সমুদ্র সহযোগিতা ও সুনীল অর্থনীতি।
৪. স্বাস্থ্য ও ওষুধসংক্রান্ত পুরোনো সমঝোতা নবায়ন।
৫. ভারতের ইন-স্পেস এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সমঝোতা।
৬. দুই দেশের রেল মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সংযোগ সংক্রান্ত সমঝোতা।
৭. সমুদ্রবিষয়ক গবেষণায় দুই দেশের সমঝোতা।
৮. দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও প্রশমনে ভারতের ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অথরিটি, বাংলাদেশ ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যমান সমঝোতা নবায়ন।
৯.মৎস্যম্পদের উন্নয়নে বিদ্যমান সমঝোতা নবায়ন।
১০. কৌশলগত ও অপারেশনাল খাতে সামরিক শিক্ষা সহযোগিতায় ডিফেন্স সার্ভিসেস স্টাফ কলেজ, ওয়েলিংটন-ইন্ডিয়া এবং মিরপুর ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজের মধ্যে সমঝোতা।
এরমধ্যে ৬ এবং ১০ নং দফা আলোচনার দাবি রাখে। ৬ নং দফায় বলা হয়েছে দুই দেশের রেল মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সংযোগ সংক্রান্ত সমঝোতা। ১০ নং দফায় বলা হয়েছে কৌশলগত ও অপারেশনাল খাতে সামরিক শিক্ষা সহযোগিতা। এই দুইটি দফাতেই বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি। অথচ এই দুইটি দফা নিয়েই শেখ হাসিনার সফরের ১ সপ্তাহ আগে থেকেই ভারতীয় পত্র পত্রিকায় তুমুল লেখালেখি চলছিল। ৬ এবং ১০ নং দফা অত্যন্ত সুকৌশলে কূটনৈতিক পরিভাষার মোড়কে জড়িয়ে প্রকাশ করা হয়েছে। এর মধ্যদিয়ে অনেক কিছুই বলার অবকাশ আছে। আবার কোনো কিছুই বলার অবকাশ নাই। তাছাড়া কোনোরূপ যৌথ ইশতেহার (Joint Communique) প্রকাশ করা হয়নি। এজন্য বিরাট ধুম্রজালের সৃষ্টি হয়েছে।
॥ দুই ॥
দুই দেশের রেল মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সংযোগ বলতে তারা কি বোঝাচ্ছেন? এসম্পর্কে সফরের ৪/৫ দিন আগে থেকে যেসব খবর ভারত এবং বাংলাদেশের পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তার সারমর্ম নিম্নরূপ:
খবরে বলা হয়েছে, ভারতের রেলওয়ে বোর্ড নতুন রেল লাইন সম্প্রসারণের জন্য চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে। এই নতুন রেল লাইন ভারত থেকে বাংলাদেশ এবং নেপাল হয়ে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের সাথে সংযুক্ত হবে। এই সংযুক্তির ক্ষেত্রে চিকেন নেক নামে বহুল পরিচিত শিলিগুড়ি করিডোরকে এড়িয়ে যাওয়া হবে। বাংলাদেশ এ ব্যাপারে তাদের ভূখন্ডে ৫০০ কি.মি. নতুন রেলওয়ে লাইন নির্মাণের ‘আদেশ’ দিয়েছে। এরমধ্যে ৩৭৬ কি.মি. লাইন হবে ব্রডগেজ লাইন।
নতুন রেল করিডোর নির্মাণের যে রুট দেওয়া হয়েছে সেটাও ভারতীয় প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে ২৫০ কি.মি. নতুন রেল লাইন বসানো হবে। এটি হবে পশ্চিমবঙ্গ থেকে মেঘালয় ভায়া বাংলাদেশ। রুটটি হবে বালুরঘাট-হিলি-গাইবান্ধা-মহেন্দ্রগঞ্জ-তুরা-মেন্দিপাথর। পশ্চিমবঙ্গেও লাইন হবে দুইটি। একটি হবে ৮০ কি.মি.। আরেকটি হবে ৬০ কি.মি।
অপর রুটটি হবে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসাম ভায়া বামনহাট। রুটটি হবে বালুরঘাট-হিলি-পার্বতিপূর-কাউনিয়া-লালমনিরহাট-মোগলহাট-গিতালদহ। যেসব রেল লাইনকে ব্রডগেজে কনভার্ট করা হবে সেগুলি হলো পশ্চিমবঙ্গ থেকে ত্রিপুরা ভায়া বাংলাদেশ। রুটটি হলো গেদে-দর্শনা-আখাউড়া-আগরতলা-পেট্রাপোল-বেনাপোল-নাভারন-যশোর-রূপদিয়া-পদ্মাবিলা-লোহাগড়া-কাশিয়ানি-শিবচর-মাওয়া-নিমতলা-গেন্ডারিয়া-ঢাকা-টঙ্গি-ভৈরব বাজার-আখাউড়া-আগরতলা। এই বিশাল রুটে যথাক্রমে ১০০ কি.মি. ও ১২০ কি.মি. লাইন ব্রডগেজে কনভার্ট করা হবে। নেপালের দিকে স্থাপন করা হবে ১৯০ কি.মি. রেল লাইন। রুটটি হবে বিরাটনগর-নিউ মল। আরেকটি হবে ১২ দশমিক ৫ কি.মি। রুটটি হবে গলগলিয়া-ভদ্রপুর-কাজালি বাজার।
ভারতীয় রেলওয়ে সূত্র উল্লেখ করে হিন্দুস্তান টাইমস এবং টাইমস নাউ পত্রিকা সমূহে বলা হয়েছে যে এর ফলে একদিকে যেমন ভ্রমণের সময় অনেক কমে যাবে অন্যদিকে তেমনি কৌশলগতভাবেও ভারত লাভবান হবে। কারণ চিকেন নেকটি মাত্র ২২ কি.মি. লম্বা। এর এক প্রান্ত রয়েছে নেপালে, আরেক প্রান্ত রয়েছে বাংলাদেশে। ভুটানের দোকলাম নামক কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূখন্ডটি নিয়ে ভারত এবং চীনের মধ্যে যখন যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি হয় তখন এই চিকেন নেক নিয়ে ভারত অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়ে। তখন থেকেই ভারত চিন্তা করতে থাকে যে সামরিকভাবে অত্যন্ত স্পর্শকাতর এই চিকেন নেক যদি শত্রুর হুমকির মুখে পড়ে তাহলে ভারতের পশ্চিমাঞ্চল পূর্বাঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। পর্যবেক্ষক মহল বলেন যে এমন একটি অবস্থায় ভারত দুইটি বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে পরিণত হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি করিডোর হয়ে উত্তর পূর্ব ভারতের মনিপুর বা নাগাল্যান্ডে যেতে সময় লাগে ৩২ ঘণ্টা। হিন্দুস্তান টাইমস দাবি করেছে যে যদি কলকাতা থেকে বাংলাদেশ হয়ে মেঘালয়, মনিপুর বা নাগাল্যান্ডে যেতে হয় তাহলে বিরতিহীন দ্রুত গতির মালগাড়ির সময় লাগবে মাত্র ৪ ঘণ্টা। অর্থাৎ ভারতের সময় বাঁচবে ২৮ ঘণ্টা। বিবিসি এবং আলজাজিরায় বলা হয়েছে যে এইসব রুটে যে মালগাড়ি চলবে সেগুলিতে শুধুমাত্র নিত্য ব্যবহার্য পণ্যই পরিবহণ করা হবে না, সমরাস্ত্রও পরিবহণ করা হবে। ভারতীয় ইংরেজি পত্র পত্রিকাতেও সমরাস্ত্র শব্দটি সরাসরি না বলে বলা হয়েছে Goods having strategic importance.
এই সামরিক গুরুত্বের কারণেই ভারতীয় পত্র পত্রিকাগুলোতে বলা হয়েছে যে বাংলাদেশ হয়ে যে নতুন রেল ট্রানজিট স্থাপন করা হবে সেই রুটগুলি শিলিগুড়ি করিডোর বা চিকেন নেকে নির্মিত রেল লাইনকে পাশ কাটিয়ে চলবে। এর ফলে চিকেন নেকের ওপর তেমন কোনো চাপ আর থাকবে না। ভারতের রেলওয়ে বোর্ড যেসব রুটকে চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে, দি হিন্দু পত্রিকার বিজনেস লাইনে তার দৈর্ঘ্য ধরা হয়েছে ১২৭৫ দশমিক ৫০ কি.মি.।
॥ তিন ॥
পর্যবেক্ষক মহল ধারণা করেছিলেন যে তিস্তা সম্পর্কে দুই প্রধানমন্ত্রীর আলোচনায় কিছু না কিছু থাকবে এবং যৌথ ইশতেহারে সেটি স্থান পাবে। কিন্তু যৌথ ইশতেহারের পরিবর্তে এসেছে যৌথ বিবৃতি। বাংলাদেশের ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের দিল্লি প্রতিনিধি পল্লব সরকার রিপোর্ট করেছিলেন যে চীন যে তিস্তা প্রকল্প নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে সেটি ভারত হতে দেবে না। সেজন্য কিছুদিন আগে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রা ঢাকা এসেছিলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বলে গেছেন যে ভারত তিস্তা প্রকল্পে অর্থায়ন করবে। ভারত কত টাকা দেবে তিস্তা প্রজেক্টে? চীনা প্রস্তাবে যা বলা হয়েছে তা নি¤œরূপ:
১. তিস্তা নদীর বাংলাদেশ অংশে গভীর ড্রেজিং বা গভীর খনন কাজ করা হবে। এরফলে বিপুল পরিমাণ পানি নদীতে জমা হবে।
২. নদীর পানি যাতে আশে পাশে উপচে না পড়ে এজন্য উঁচু বাঁধ বা ব্যারাজ নির্মাণ করা হবে।
৩. শুষ্ক মৌসুমে উত্তর বঙ্গের চারটি জেলায় সেচ কার্য এবং অন্যান্য কাজে যাতে পানির অভাব না হয় সেজন্য একটি বড় আকারের জলাধার নির্মাণ করা হবে।
৪. সমগ্র প্রকল্পের মধ্যে আরো থাকবে তিস্তা নদীর বাংলাদেশ অংশের দুই পাড়ে টাউনশীপ বা নগর গড়ে তোলা হবে।
এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রাথমিকভাবে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ধরা হয়েছে। এটি প্রাথমিক খরচ। প্রকল্প সম্পন্ন করতে আরো অর্থের প্রয়োজন হবে। সেটি চীন বাংলাদেশ আলোচনার মাধ্যমে সেই অর্থের সংস্থান করা হবে। ভারতের সাথে আলোচনার সময় তিস্তা প্রসঙ্গ আদৌ উঠেছিল কিনা সেটি বোঝা যাচ্ছে না। নরেন্দ্র মোদি ৫ বছরের জন্য ক্ষমতায় এসেছেন। এখন তিনি যদি তিস্তার পানির যে ন্যায্য অংশ বাংলাদেশের প্রাপ্য সেই ন্যায্য অংশ দিয়ে দেন তাহলে এই মুহূর্তে তিস্তা প্রকল্পের প্রয়োজন নাও হতে পারে। কিন্তু সেটি এখন ধোঁয়াশার মধ্যে রয়েছে।
ইতোপূর্বে পত্র পত্রিকায় লেখা হয়েছে যে সীমান্তে বাংলাদেশীদেরকে যে নির্বিচারে গুলি করা হচ্ছে সে প্রসঙ্গটি উঠবে। কিন্তু যৌথ বিবৃতিতে সেই প্রসঙ্গটি নাই।
॥ চার ॥
পর্যবেক্ষক মহল বলেন যে ওপরে উল্লেখিত পয়েন্টগুলো ইচ্ছাকৃতভাবেই ধোঁয়াশার মধ্যে রাখা হয়েছে। কারণ আগামী মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীনে রাষ্ট্রীয় সফরে যাবেন। চীন জানতে চাইবে, ভারতে তিনি কী আলোচনা করেছেন? যে রেল ট্রানজিট হবে সেখানে সমরাস্ত্র পরিবহণের সম্ভাবনা রয়েছে বলে টাইমস অব ইন্ডিয়ায় বলা হয়েছে। সে কারণে এখন যৌথ বিবৃতির ৬ নং দফা ইচ্ছাকৃতভাবেই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। অনুরূপভাবে দুই দেশ যে সামরিক সহযোগিতা করবে সেখানেও ভারতীয় ঋণের টাকায় ভারতীয় অস্ত্র ক্রয়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে ভারতীয় মিডিয়ায়। চীন সফরের আগে এই বিষয়টিও উহ্য রাখা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি জটিল সময় পার করছেন। চীন ও ভারতের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন। আখেরে তিনি সফল হবেন কিনা সেটি বলবে অনাগত ভবিষ্যৎ।