৫৭ অভিবাসী বাংলাদেশির সাজামুক্তি, ড. ইউনূসের হাতে কি আলাদিনের চেরাগ?
Share on:
আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের নির্দেশ অনুযায়ী গত ৩ সেপ্টেম্বর ৫৭ বাংলাদেশির সাজামুক্তির আদেশ জারি হয়েছে। জুলাই মাসে দেশ যখন ছাত্র-জনতার আন্দোলনে উত্তাল, তখন মধ্যপ্রাচ্যের অভিবাসী ভাইবোনরাও নেমেছিলেন প্রতিবাদে।
কিন্তু আরব আমিরাতে প্রতিবাদ সমাবেশ বেআইনি হওয়ায় কর্তৃপক্ষ তাদের আটক করে কঠিন সাজা দিয়ে বসে। আমরা তদানীন্তন মন্ত্রীকে বলতে শুনেছি, এ ব্যাপারে তাদের কিছু করার নেই। আমাদের দূতাবাসের কর্মকর্তারাও নিষ্ক্রিয় ছিলেন।
স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের এক মাসেরও কম সময়ের ভেতরে আটক অভিবাসীদের সাজামুক্তি সম্ভব করেছে। এমন অর্জন অভিবাসীদের বার্তা দেয়, বাংলাদেশ সরকার তাদের পাশে আছে। ইচ্ছা থাকলে যে উপায় হয়, তাই করে দেখানোর জন্য অধ্যাপক ইউনূস এবং প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনকে বিশেষভাবে শুভেচ্ছা জানাই।
অবশ্য অভিবাসনে সুশাসন আনতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে হাঁটতে হবে অনেক পথ। অভিবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হলেও এর ব্যবস্থাপনায় রয়েছে অনেক ঘাটতি।
রামরুর গবেষণায় দেখা যায়, ১৯ শতাংশ অভিবাসী আংশিক অথবা সম্পূর্ণ অভিবাসন ব্যয় নির্বাহ করেও বিদেশে যেতে পারেননি। আরও ৩১ শতাংশ বিদেশে যাওয়ার পর নানা রকম হয়রানির শিকার হচ্ছেন। কেউ কেউ কাজ ও বেতন না পেয়ে অল্প সময়ের ভেতরে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। কেউবা শারীরিক ও মানসিক নিগ্রহ সহ্য করেছেন। নারী শ্রমিকদের একাংশ অন্যান্য প্রতারণার পাশাপাশি যৌন হয়রানির শিকার, এমনকি লাশ হয়েও ফিরেছে। কভিডকালে বা পরে প্রত্যাবর্তিত অভিবাসীদের পুনর্বাসনের বিষয়টি বিবেচনার জন্য জোর দাবি উঠেছে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে।
মনে রাখতে হবে, এবারের আন্দোলন চলাকালে রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ করে অভিবাসীরা গণঅভ্যুত্থানে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন। তাদের এ অবদানকে মূল্যায়ন করার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে খুব দ্রুত কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। আগামীতে অভিবাসনে সুশাসন আনতে হলেও কিছু পদক্ষেপ প্রয়োজন।
এক. ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ‘ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি অন স্ট্রিমলাইনিং লেবার রিক্রুটমেন্ট’ কৌশলপত্রের আলোকে নির্বাচিত সরকার এসে অভিবাসীদের জন্য প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করেছিল। ২০০৯ সাল নাগাদ অভিবাসনকে অর্থনীতির ‘থ্রাস্ট সেক্টর’ হিসেবে ঘোষণা করা হলেও এ মন্ত্রণালয়ের বাজেট সর্বনিম্ন পর্যায়েই থেকে গেছে। রাজস্ব বাজেটের ন্যূনতম ১ শতাংশ এ খাতে বরাদ্দ অথবা বার্ষিক রেমিট্যান্সের ৫ শতাংশ সমমানের বরাদ্দ কর্মী ও তাঁর পরিবারের অধিকার রক্ষা ও সেবায় ব্যয় করার দাবি জানিয়ে আসছে নাগরিক সমাজ। আমরা আশা করব, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ ন্যায্য দাবির প্রতি দৃষ্টিপাত করবে।
দুই. দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি অভিবাসী বাংলাদেশিরা দীর্ঘদিন ধরে ভোট প্রদানের সুযোগ চাচ্ছেন। নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন সময়ে আলোচনা করলেও এর বাস্তবায়ন করেনি। অভিবাসী বাংলাদেশি কর্মীদের সাধারণ নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগদানে উদ্যোগ নিতে হবে।
তিন. নারী অভিবাসন থেকে আধুনিক দাসত্ব বন্ধ করে নিরাপদ কর্মসংস্থানের সুযোগ খোঁজা, নির্যাতিত ও কর্মচ্যুত নারী অভিবাসীদের আইনি সহায়তা,
মনোসামাজিক সেবা, অভিবাসনের দেশে সেফ হোমের সৃষ্টি, যৌন নির্যাতনের কারণে জন্ম নেওয়া শিশুর রক্ষণাবেক্ষণসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে।
চার. ন্যায়সংগত ও নৈতিক নিয়োগ নিশ্চিত করতে অভিবাসন প্রক্রিয়া সিন্ডিকেটমুক্ত করা প্রয়োজন। ব্যক্তিগতভাবে সংগৃহীত ভিসা, রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে প্রক্রিয়াকরণের নিয়মটি বন্ধ করে ডেমো অফিসগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। ভালো মানের কোম্পানি ভিসা সংগ্রহে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে বাধ্য এবং সাব-এজেন্টদের অনানুষ্ঠানিক সেবাগুলোকে আনুষ্ঠানিক কাজের অংশে পরিণত করতে হবে।
পাঁচ. প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় একটি বিশেষায়িত মন্ত্রণালয়। আমলাতন্ত্রের সাধারণ বদলির নিয়মের কারণে অভিবাসন বিষয়ে যারা দক্ষতা অর্জন করেন, কয়েক বছরের মাথায় তারা অন্য মন্ত্রণালয়ে চলে যান। পরবর্তী কর্মকর্তাকে নতুন করে সব শিখতে হয়।এ ক্ষেত্রে অভিবাসনবিষয়ক ‘ক্যাডার সার্ভিস’ চালু করা প্রয়োজন।
ছয়. অভিবাসন ব্যবস্থাপনায় প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর বিএমইটি, ডেমো, টিটিসি, বোয়েসেল, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক কর্মদক্ষতার মূল্যায়নের ভিত্তিতে শক্তিশালী করার নীতিমালা তৈরি করতে হবে।
সাত. জাতীয় দক্ষতা নীতিতে আন্তর্জাতিক অভিবাসীদের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয়নি। প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী জনবল সৃষ্টির জন্য দক্ষতা বৃদ্ধিবিষয়ক কর্মপরিকল্পনা ও বাজেট বরাদ্দ প্রয়োজন।
আট. গত কয়েক বছর ধরেই বিভিন্ন কারণে আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় রেমিট্যান্স হ্রাস পাচ্ছে বা প্রবৃদ্ধির হার কমছে। মুদ্রাস্ফীতি, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক প্রবাহে এক্সচেঞ্জ রেটের ফারাক, রেমিট্যান্স পাঠানোয় উচ্চ খরচ, ব্যাংকিং সেক্টরের প্রতি অনাস্থা, অন্যায্য করনীতি, ব্যবসায়ীদের আন্ডার ইনভয়েসিং, ভিসা ক্রয়ের জন্য রিক্রুটিং এজেন্সিদের বিদেশে অর্থের প্রয়োজনীয়তাসহ এর পেছনে নানা কারণ কাজ করছে। ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় কম খরচে রেমিট্যান্স পাঠানোর আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা বাংলাদেশে চালুর বিষয়টি যাচাই ও বিবেচনা করে দেখা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে গ্রাহকের ঝুঁকি প্রশমনে ভোক্তা প্রতিরক্ষা আইন প্রয়োজন। খুব দ্রুত রেমিট্যান্স আহরণ ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে নীতিমালা তৈরির জন্য কমিশন গঠন করা প্রয়োজন।
উপরোক্ত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় চাই পরিকল্পনা, সময়-নির্দিষ্ট বাস্তবায়ন ধাপ, অর্থায়ন, নাগরিক সমাজের অংশীদারিত্ব, অভিবাসনের দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা এবং বহুপক্ষীয় ফোরামে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখা। এ কাজ প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের পক্ষে একা সম্ভব নয়। পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র, নারী ও শিশু, শিক্ষা, শিল্প ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্তদের সমন্বয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি প্রয়োজন। এ কমিটির অধীনে অভিবাসন বিষয়ে অভিজ্ঞ অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি সংগঠন, বিশেষজ্ঞ মিলে তৈরি করতে পারে কর্মপরিকল্পনা। আমরা আশা করব, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ও দ্রুততার সঙ্গে বিবেচনা এবং এ সংক্রান্ত রূপরেখা দ্রুত জনগণের কাছে উপস্থাপন করবে।