সংস্কৃতি অঙ্গন সংস্কারের উদ্যোগ নিন
Share on:
মহান মুক্তিযুদ্ধের পর এই এক নতুন বাংলাদেশ দেখছে জনগণ। ঊনসত্তরেও না; নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও এমনটি দেখেনি দেশবাসী। মুক্তিযুদ্ধ ব্যতীত এত খুন, এত লাশ, এত প্রাণের সংহার, এত ধ্বংসযজ্ঞও দেখেনি মানুষ।
শত শহীদের রক্তের বিনিময়ে তাই এ এক রক্তাক্ত নতুন বাংলাদেশ। তারুণ্যের স্বপ্নের, আগামী দিনের সাম্যের বাংলাদেশ; জনআকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ।
এবারে আবালবৃদ্ধবনিতা নতুন করে ভাবতে বাধ্য হচ্ছে তারুণ্যের ঐক্য, সংহতি, স্পর্ধা, সাহস ও শক্তি সম্পর্কে। যে তরুণ সমাজকে প্রায়শ আমরা অরাজনৈতিক, রাজনীতিবিমুখ, অনলাইনে আসক্ত সমাজশ্রেণি হিসেবে বিবেচনা করে আসছি, তারাই দেখিয়েছে, কী করে অন্যায্যতা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়ে গণঅভ্যুত্থান ঘটানো যায়। দাবি আদায়ের আন্দোলনে রাজনৈতিক নেতৃত্বের পতন ঘটানো সম্ভব করা যায়।
দ্বিতীয় স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে আপামর জনগণ। তাই নতুন সরকারের কাছে জনপ্রত্যাশাও অনেক বেশি। জনগণ চায় এই সরকার জনআকাঙ্ক্ষা, সাম্য ও মানবিক মর্যাদার দেশ উপহার দেবে, যেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, আইনের শাসন ও গণতন্ত্র সমুন্নত থাকবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে দুটি ঘটনা। ২০১৮ সালে সংঘটিত নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের দাবিতে শিশু-কিশোরদের আন্দোলনে কেবল নিরাপদ সড়ক নয়, রাষ্ট্র সংস্কারের দাবিও ওঠে। একই বছরে সংঘটিত কোটা সংস্কার আন্দোলন সামাল দিতে বিবেচনাহীনভাবে সব কোটা প্রথাই বাতিল করে দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী। খেয়াল রাখতে হবে, ওই সময়ের শিশু-কিশোররাই ৬ বছর পর ২০২৪ সালে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালেয়ের শিক্ষার্থী। তাদের রয়েছে আন্দোলনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, হেলমেট বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের স্মৃতি।
আমাদের এও বিবেচনা করতে হবে, কোটা সংস্কার আন্দোলন কেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল। সমাজের অন্যায্যতা, অন্যায়, অবিচার, নিপীড়ন, বৈষম্য এই নামকরণেই ফুটে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে কোটা ব্যবস্থার সংস্কারসহ সমাজ ও রাষ্ট্রে নিহিত অন্যায্য ও বৈষম্যমূলক কাঠামোর অকার্যকর পদ্ধতিরই আমূল সংস্কার চায় এই তরুণ সমাজ। তাই এই ছাত্র-জনতার আন্দোলন গণতান্ত্রিক আন্দোলন তো বটেই, ছিল গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও প্রতিষ্ঠার আন্দোলনও।
গণআন্দোলনের মুখে স্বৈর সরকারের বীভৎস পতন ও পলায়ন দেখলাম আমরা! সুদীর্ঘ ৭৫ বছরের একটি রাজনৈতিক দলের সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী নেতাকর্মীকে না জানিয়ে কীভাবে দেশ ত্যাগ করলেন! তাও শোকাবহ আগস্ট মাসে। কী নির্মম পরিহাস! আর মন্ত্রী-এমপি, নেতাকর্মী যারা মুখভরা ফাঁকা আওয়াজ দিতেন, তারা আজ পলাতক! ধূর্ত মন্ত্রী-এমপি সবাই পলাতক। এই দুর্বৃত্ত নেতৃত্বের অধীনে ছিল দেশ! তারা বিগত দেড় দশক কতই না জুলুম, নিপীড়ন, খুন, গুম চালিয়েছে জনমানুষের ওপর!
এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায়। উপদেষ্টাদের অধিকাংশের রয়েছে কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা, সাফল্য। সমাজে ভালোমানুষ হিসেবে তাদের মর্যাদা আছে, সুনাম আছে। তবে মনে রাখতে হবে, গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈর সরকারকে হটিয়ে আজকের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে রয়েছে অসংখ্য ঝুঁকি। কারণ ইতিহাসের এমন সন্ধিক্ষণে সময়টি সোজাসাপটা নয়। প্রায় সবক’টি জনপ্রতিষ্ঠানে রয়েছে দলীয় লেজুড়বৃত্তির কর্মকর্তা-কর্মচারী; স্বৈর সরকারের প্রতি আনুগত্যশীল পুলিশ, আমলা। দালাল-দুর্বৃত্ত শ্রেণিরও অভাব নেই। ঘাপটি মেরে আছে স্বৈর সরকারের সুবিধাভোগী অসংখ্য মানুষ। এরা সুযোগ পেলেই অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে প্রস্তুত। দেশের বিশৃঙ্খলায় তাদের পরোক্ষ মদদ নেই– এ কথা হলফ করে বলা যাবে না। এ ছাড়া দেশে কয়েক দিন কোনো সরকার না থাকায় এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিশেষ করে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার কারণে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটে। জানমালের ক্ষতি হয়, বাড়িঘরে আগুন, আক্রমণ করা হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে। মন্দিরে হামলা হয়, ভাস্কর্য ভাঙাসহ দুর্বৃত্তরা তাণ্ডব চালায়।
ফলে সরকারের সামনে নানা ধরনের ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। স্বৈরাচারী সরকার ক্ষমতা ছেড়ে এমনভাবে পালিয়ে গেছে, যেখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়। সবার আগে শক্ত হাতে সামাল দিতে হবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং খুব দ্রুত জনগণের মাঝে আস্থা ফিরিয়ে আনাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কোনোমতেই যাতে উগ্রবাদ মাথাচাড়া না দিতে পারে, সেদিকে নজর রাখতে হবে। রাষ্ট্র সংস্কারে যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে সরকারকে কাজ করতে হবে।
গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে রাষ্ট্র সংস্কার জরুরি, মানে রাষ্ট্রের কাঠামোগত সংস্কার ও নীতি সংস্কার। অর্থাৎ যে স্বৈর সিস্টেমের ওপর রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে আছে, তার সংস্কার অপরিহার্য। আমাদের মনে রাখতে হবে, দীর্ঘ দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে স্বৈর সরকার দেশের সব জনপ্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের কাঠামো ও নীতিগত সংস্কার করা জরুরি। নীতিগত সংস্কারে জনঅংশগ্রহণ যাতে নিশ্চিত হয়, সে ব্যাপারে খেয়াল রাখা সমীচীন হবে।
আমরা যারা সংস্কৃতি বিষয়ে চর্চা করি, লেখালেখি করি, মনে করি, সংস্কৃতি অঙ্গনের সব প্রতিষ্ঠানের সংস্কার আবশ্যক। কারণ সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিগত সরকার দলীয় ও জনবিরোধী হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। বাংলা একাডেমি, জাতীয় গণগ্রন্থাগার, শিশু একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, নজরুল ইনস্টিটিউট, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের আমূল পরিবর্তন দরকার। প্রয়োজন কাঠামো ও নীতিগত সংস্কার। এসব প্রতিষ্ঠানে যারা নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন তারা হবেন মেধাবী ও যোগ্য; দলমতের ঊর্ধ্বে।
সব সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান হবে জনবান্ধব, সংস্কৃতিবান্ধব। বাংলা একাডেমি বা জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে লেখক-পাঠকদের জন্য ক্যাফে-লাইব্রেরির ব্যবস্থা থাকবে, যেখানে লেখক-পাঠকরা স্বাধীনভাবে আড্ডা-আলোচনা করবেন।
নতুন সরকারের প্রতি আমাদের আস্থা আছে। কিন্তু তাদের কাজে অসংগতি দেখলে সমালোচনাও করব। বর্তমান পরিষদে অভিজ্ঞ প্রশাসকের ঘাটতি আছে, যিনি বা যারা শক্ত হাতে দুর্বৃত্তপনা সামাল দেবেন। নেই ব্যবসায়ী প্রতিনিধি যিনি বা যারা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য তদারকি করবেন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও প্রতিনিধিত্বের ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়। তা ছাড়া এ পরিষদের অনেক উপদেষ্টার সরাসরি জনসম্পৃক্ততা নেই; রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাও নেই। যদিও এনজিও এবং মানবাধিকার কর্মীদের প্রতিনিধিত্ব কমবেশি জনগোষ্ঠীর কোনো কোনো অংশের সঙ্গে সরাসরি কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে।
এই পরিষদই যে চূড়ান্ত, এমন হয়তো না। প্রয়োজনে সংযোজন-বিয়োজন হতে পারে। কিন্তু নতুন সরকারের কাছে জনগণের ব্যাপক প্রত্যাশা, তাদের দায়িত্বও অপরিসীম। নাগরিক হিসেবে আমি, আমরা সরকারকে সহযোগিতা করব। আশা করি, নিজেদের যথাযথ দায়িত্ব মেনে রাষ্ট্র কাঠামোর প্রয়োজনীয় সংস্কারসহ আইনের শাসন কায়েম করে গণতান্ত্রিক দেশ নির্মাণে তারা সফল হবেন।