সুশাসন প্রতিষ্ঠায় খেলাপি ঋণ বিপর্যয় দূর করতে হবে
Share on:
বাংলাদেশের দুই ধরনের বাণিজ্যিক ব্যাংক রয়েছে। এর একটি হলো রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং অন্যটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক। রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাকালীন মূলধনের জোগানদাতা সরকার।
অন্যদিকে, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাকালীন মূলধনের জোগানদাতা উদ্যোক্তা পরিচালকরা। যে পরিমাণ মূলধন নিয়ে একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয় পরবর্তীতে ব্যাংকে আমানতকারীদের আমানতের পরিমাণ ও ঋণগ্রহীতাদের ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি ঘটলে পর্যায়ক্রমে মূলধনেরও বৃদ্ধি ঘটে। মূলধনের বৃদ্ধি একটি চলমান প্রক্রিয়া। বেসরকারি ব্যাংক প্রতিষ্ঠাকালীন উদ্যোক্তা পরিচালকরা মূলধনের ১০ শতাংশ জোগান দিয়ে থাকেন। বর্তমানে প্রতিটি বেসরকারি ব্যাংকে আমানতকারীদের যে পরিমাণ অর্থ গচ্ছিত আছে উদ্যোক্তা পরিচালকদের মূলধনের সাথে তার হিসাব করলে এর অনুপাত দাঁড়ায় ৯৭.৫ : ২.৫ ।
একজন বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালক নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণে বারিত বিধায় বেশির ভাগ বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকদের দেখা যায়, সমঝোতার ভিত্তিতে এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে থাকেন।
রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি উভয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পরিচালক সমন্বয়ে গঠিত। রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ও পরিচালকরা সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত। বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে উদ্যোক্তা পরিচালকদের প্রাধান্য। পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে উদ্যোক্তা পরিচালকদের মধ্য থেকে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য যিনি তাকে নির্বাচিত করা হয়। অতীতে একজন উদ্যোক্তা পরিচালক তিন বছর ব্যাপ্তিকালের দুই মেয়াদে অর্থাৎ ছয় বছর দায়িত্ব পালন করতে পারতেন। বর্তমানে ব্যাংকিং কোম্পানি আইন সংশোধন করে পরিচালকদের তিন বছর ব্যাপ্তিকালের পরপর তিন মেয়াদে অর্থাৎ ৯ বছর পদে বহাল থাকার বিধান প্রবর্তন করা হয়েছে। অতীতে একই পরিবারের দু’জনের বেশি একসাথে একটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে পরিচালকের দায়িত্ব পালন করতে পারতেন না। সম্প্রতি আইন সংশোধন করে সংখ্যাটি দুই থেকে বাড়িয়ে চার করা হয়েছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ বড় অঙ্কের ঋণগুলোর অনুমোদন দিয়ে থাকে। মাঝারি ও ক্ষুদ্র পর্যায়ের ঋণ অনুমোদনের ব্যাপারে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ব্যবস্থাপকদের অনুমোদন দেয়া আছে। ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ব্যবস্থাপকরা যে ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করেন পরিচালনা পর্ষদের ক্ষেত্রে প্রায়ই তার হানি পরিলক্ষিত হয়।
বাংলাদেশে বর্তমানে বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকার ঊর্ধ্বে। এ খেলাপি ঋণের একটি অংশ অনাদায়যোগ্য হওয়ায় অবলোপন করা হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত বা বাণিজ্যিক ব্যাংক একজন ঋণগ্রহীতাকে ঋণ প্রদান করতে হলে তাকে নির্ধারিত আইন ও বিধিবিধান প্রতিপালনপূর্বক ঋণ দিতে হয়। জামানত ছাড়া কোনো ঋণগ্রহীতাকে ঋণ দেয়ার সুযোগ নেই। বড় অঙ্কের ঋণের ক্ষেত্রে স্থাবর সম্পত্তি অথবা স্থাবর সম্পত্তির ওপর নির্মিত স্থাপনা বন্ধক রাখাপূর্বক ঋণ মঞ্জুর করা হয়। ঋণ পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত বন্ধকি সম্পত্তির মালিকানা রেজিস্ট্রিকৃত দলিলের মাধ্যমে ব্যাংকের বরাবর হস্তান্তর করা হয়। ঋণ অনুমোদনের আগে ব্যাংকের কর্মকর্তারা বন্ধককৃত সম্পত্তি এবং ক্ষেত্রমতে এর ওপর স্থাপনা পরিদর্শনপূর্বক এর মূল্য নিরূপণ করেন। বন্ধককৃত সম্পত্তির মালিকানা বিষয়ে ব্যাংকের আইন শাখা ও আইন উপদেষ্টার মতামত গ্রহণ করা হয়। একজন ঋণগ্রহীতাকে ঋণ গ্রহণ করাকালীন যেসব কাগজপত্র দাখিল করতে হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো জমি খরিদের দলিল, নামজারি ও জমা ভাগ এবং হালনাগাদ খাজনার দাখিলা। রাষ্ট্রায়ত্ত বা বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক বন্ধককৃত সম্পত্তির মূল্যমানের এক-তৃতীয়াংশ থেকে এক-চতুর্থাংশ পরিমাণ অঙ্কের যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণপূর্বক ঋণ দেয়ার কথা থাকলেও প্রায়ই এর ব্যত্যয় পরিলক্ষিত হয়।
উদ্যোক্তা পরিচালক ও বড় ধরনের প্রভাবশালীরা ঋণ গ্রহণের সময় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও কর্মকর্তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে বন্ধককৃত সম্পদের মূল্যমানের দুই থেকে চারগুণ বেশি পরিমাণ অর্থঋণ গ্রহণ করে থাকেন। এ ধরনের ঋণের কিস্তি সময়মতো পরিশোধ না করা হলে অচিরে দেখা যায় সুদ-আসলে ঋণের পরিমাণের অনেক বৃদ্ধি ঘটেছে। এ ধরনের অনেক ঋণগ্রহীতা তাদের গ্রহণকৃত ঋণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দেশে বিনিয়োগ না করে বিদেশে সম্পদ আহরণে ব্যয় করছেন। এদের বিদেশী নাগরিকত্ব রয়েছে এবং দেশে ঋণখেলাপি হওয়ায় প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে এরা বিদেশে পাড়ি জমাতে সদা প্রস্তুত। এ ধরনের অনেক ঋণগ্রহীতা ইতোমধ্যে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন এবং ব্যাংকের সাথে তাদের কোনো যোগাযোগ নেই।
রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের বড় অংশের সাথে যারা সম্পৃক্ত এদের অনেকে সমাজের বিশিষ্টজন এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। অন্য অংশটি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালীদের আশী-র্বাদপুষ্ট হয়ে ঋণপ্রাপ্তিতে সফল হয়েছেন। বিশ্বস্ত সূত্র নিশ্চিত করেছে যেসব ক্ষেত্রে বন্ধককৃত সম্পদের মূল্যমানের চেয়ে ঋণের পরিমাণ অধিক সেসব ক্ষেত্রে পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান বা পরিচালক বা উভয়ে, ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, আইন শাখার কর্মকর্তা, আইন উপদেষ্টা প্রভৃতি অবৈধ অর্থ দ্বারা বশীভূত হয়ে অন্যায়ভাবে ঋণ প্রদানের সপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এ ধরনের ঋণগ্রহীতারা মঞ্জুরীকৃত ঋণের ২০-৩০ শতাংশ উপরোক্তদের উৎকোচ হিসেবে দিয়ে থাকেন। এর একটি অংশ ঋণ মঞ্জুরের আগে এবং অবশিষ্টাংশ ঋণের কিস্তির অর্থ ছাড় করার সময় দেয়া হয়।
ব্যাংক খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট অনেক বিশেষজ্ঞের অভিমত, বর্তমানে প্রতিটি ব্যাংক কাগজ-কলমে যে পরিমাণ অর্থ খেলাপি ঋণ হিসেবে প্রদর্শন করছে; প্রকৃতপক্ষে প্রতিটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ এর চেয়ে অনেক বেশি। হিসেবে গরমিল ও হেরফের করে তারা খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র জনসম্মুখে উপস্থাপনে অনীহ।
রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ আদায়ে তৎপর দেশের জনমানুষসহ সাধারণ আমানতকারীদের ধারণা দিতে তারা মামলা দায়েরের মাধ্যমে অনাদায়ী অর্থ ১ সচেষ্ট- এমন মনোভাব প্রদর্শন করলেও বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যায়, দুর্বলভাবে মামলা পরিচালনা এবং আইনি জটিলতায় মামলা দায়ের করে কাক্সিক্ষত প্রতিকার প্রাপ্তিতে সফলতা পাওয়া যায় না।
এমন অনেক ঋণ রয়েছে যেগুলো গ্রহণের সাথে জালিয়াতির সম্পৃক্ততা রয়েছে। এ ধরনের অনেক জালিয়াতির সাথে ব্যাংকের চেয়ারম্যান, কিছু পরিচালক, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট শাখার ব্যবস্থাপক সম্পৃক্ত থাকলেও ত্রুটিপূর্ণ তদন্তের মাধ্যমে মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল করায় প্রকৃত অপরাধীরা পর্দার আড়ালে থেকে যায়।
রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ওপর অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ কার্যকর রয়েছে। উভয় প্রতিষ্ঠান থেকে যে নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত ও দিকনির্দেশনা দেয়া হয় তার ভিত্তিতে ব্যাংকগুলো পরিচালিত হয়ে থাকে। বিগত দু’দশক ধরে দেখা গেছে, খেলাপি ঋণ প্রতি বছর ক্রমে স্ফীত হয়েছে এবং এ ধারা এখনো অব্যাহত আছে। তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত ও দিকনির্দেশনা সঠিক হয়ে থাকলে এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। আর তাই এর দায় থেকে সংশ্লিষ্ট দু’টি প্রতিষ্ঠানও অবমুক্ত নয়।
২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আট হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে পাচারে সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এ ঘটনা সংঘটন-পরবর্তী দীর্ঘসময় অতিবাহিত হলেও এর সাথে বাংলাদেশ ব্যাংকসংশ্লিষ্ট যারা সম্পৃক্ত তাদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করা এখনো সম্ভব হয়নি। এ সময়ে ব্যাংকটির গভর্নরের দায়িত্বে যিনি ছিলেন তাকে অপসারণ করা হলে তিনি তার পূর্বেকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতার পেশায় ফিরে আসেন। এ ধরনের ব্যক্তি যিনি এত বড় অঘটনের সময় ব্যাংকটির শীর্ষ পদে আসীন ছিলেন এবং অঘটন-পরবর্তী এটি যেন জসম্মুখে প্রচার না পায় সে বিষয়ে সে সময়কালীন তার তৎপরতা আমলে নেয়া হলে এরূপ ব্যক্তির প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় পুনঃপ্রত্যাবর্তন নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কতটুকু সমর্থনযোগ্য তা বিবেচনার দাবি রাখে। এ ধরনের ঘটনা ব্যাংক খাতে জালিয়াতিকে উৎসাহিত করে ঋণখেলাপি হওয়ার পথকে যে প্রশস্ত করে তা এ দেশের সচেতন মানুষ অনুধাবনে সক্ষম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ কর্ণধারসহ আরো কিছু ব্যাংকের শীর্ষ কর্ণধারের অপতৎপরতা, অযোগ্যতা ও দুর্নীতিতে এ দেশে বড় ধরনের ঋণ জালিয়াতি ও ঋণখেলাপির ঘটনা সংঘটিত হলেও তাদের বিরুদ্ধে সরকার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পক্ষ থেকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় এরা দায়মুক্ত ভাব নিয়ে মাথা উঁচু করে সমাজে চলাফেরায় উদ্যত। অথচ এদের মধ্যে ন্যূনতম বিবেকবোধ ও দায়িত্বজ্ঞান থাকলে এরা লোকচক্ষুর আড়ালে গিয়ে নিজেদের আত্মরক্ষার প্রয়াস নিতেন।
বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের কারণে যে বিপুল অর্থ আজ অনাদায়যোগ্য এ অর্থের মালিক এ দেশের সাধারণ জনমানুষের অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের আমানতকারী এবং শেয়ারহোল্ডাররা। ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ও সার্বিক অব্যবস্থাপনায় এর আমানতকারী ও শেয়ারহোল্ডাররা তাদের ন্যায্য লাভ ও মুনাফা থেকে বঞ্চিত হলেও ঋণখেলাপির সাথে যারা সম্পৃক্ত তারা অনেকটা দায়হীন থেকে দেশ এবং বিদেশে অবৈধভাবে আহরিত সম্পদের সুরক্ষায় নিয়োজিত। এভাবে চলতে থাকলে এ দেশের ব্যাংক খাতে ধস নেমে তা দেশের বড় ধরনের বিপর্যয় নিয়ে আসবে। তাই সময় থাকতে ঋণখেলাপির দায় যাদের ওপর বর্তায় তাদের আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তি বিধান প্রত্যাশিত নয় কি।