সম্পাদকীয় প্রকাশনার সময়: বুধবার ১৪, অগাস্ট ২০২৪

সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ সেবা নিশ্চিতে উদ্যোগ নিতে হবে

Share on:

জনগণকে সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ সেবা দেয়া সরকারের দায়িত্ব। বিগত সরকারের ভুল পরিকল্পনা ও গোষ্ঠী স্বার্থকে গুরুত্ব দেয়ায় তা সম্ভব হয়নি। আবার ভর্তুকির চাপ সামলাতে সরকার বছরে চারবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে ভোক্তা পর্যায়ে চাপ আরো বাড়িয়ে দেয়।


দেশের মোট উৎপাদন সক্ষমতার ২০ শতাংশেরও বেশি অবদান রয়েছে আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির কয়লাভিত্তিক চারটি বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের। কিন্তু বৈশ্বিক মানের বিপরীতে বাংলাদেশে কয়লাভিত্তিক এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ ব্যয় অনেক বেশি। কেন্দ্রভেদে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা দেড়-দুই গুণ। আবার বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ও বেশি হচ্ছে। কারণ বর্তমানে দেশে চাহিদার চেয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা দ্বিগুণ হয়েছে।

বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ (কেন্দ্র ভাড়া) দিতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে এসব কেন্দ্রের নির্মাণ ব্যয়ের সঙ্গে উৎপাদন খরচ যুক্ত হয়ে তা বিদ্যুতের দামে বড় আকারে প্রভাব ফেলছে। ফলে ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুৎ খরচ বেড়ে যাওয়ায় দেশের শিল্প-বাণিজ্যে প্রভাব ফেলছে। পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। যা মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব রাখছে। অথচ সাশ্রয়ী দামে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে—এমন পরিকল্পনা থেকে দেশে অনুমোদন দেয়া হয়েছিল অন্তত ডজনখানেক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। কিন্তু দিন যতই গড়াচ্ছে ততই ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক এসব প্রকল্প। প্রতিবেশী ভারতসহ বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ এখনো সাশ্রয়ী দামে কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। অন্য দেশ সাশ্রয়ী দামে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ও বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারলেও বিশেষ গোষ্ঠীস্বার্থকে গুরুত্ব দেয়ায় আমরা তা পারছি না।

বিদেশী ঋণে দেশে বৃহৎ কয়লাভিত্তিক আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির চারটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। দেশের বিদ্যুৎ খাতের সক্ষমতা বাড়াতে এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। এগুলো হচ্ছে—মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র (প্রথম পর্যায়), পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র (আরপিসিএল নরিনকো) ও রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। চারটির উৎপাদন সক্ষমতা ৫ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট, যা দেশের মোট উৎপাদন সক্ষমতার ২০ শতাংশেরও বেশি। এর মধ্যে তিনটি এখন উৎপাদনে। বাকি একটির নির্মাণকাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে।

সরকারি তথ্যানুসারে, বর্তমানে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ২৫ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। গত সোমবার দিনে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১২ হাজার ৮৮০ মেগাওয়াট। অর্থাৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার প্রায় অর্ধেক উৎপাদন হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়নি। প্রতিযোগিতামূলক শর্তে বা দামে ঋণ চুক্তি, পণ্য ক্রয় ও নির্মাণ এবং এতে সময়ক্ষেপণ কমানো গেলে খরচ অনেকটাই কমে আসত। এখন এসব কেন্দ্রের নির্মাণ ব্যয়ের সঙ্গে উৎপাদন খরচ যুক্ত হয়ে তা বিদ্যুতের দামে বড় আকারে প্রভাব ফেলছে।

আর বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে দরপত্রে প্রতিযোগিতা, নির্ধারিত সময়ে কেন্দ্র নির্মাণ, ঋণের কঠিন শর্ত এমনকি যন্ত্রপাতি আমদানি প্রক্রিয়ায় শর্তগুলো ছিল ন্যূনতম। এসব জটিলতা ও ব্যয় বিশ্লেষণ করে ঋণ নেয়া হলে বিদ্যুতের বড় প্রকল্পগুলোর ব্যয় কমানো যেত। পাশাপাশি বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডও (বিপিডিবি) আর্থিকভাবে এত দুরবস্থার মধ্যে পড়ত না।

চারটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ১ লাখ ২৪ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকা। নির্মাণ ব্যয়ের এ হিসাব বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, চার বিদ্যুৎ কেন্দ্রে অন্তত ৬১ হাজার ৬৩৮ কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে। এর মধ্যে মাতারবাড়ীতে বন্দর উন্নয়ন ও জমি অধিগ্রহণ বাবদ ব্যয় ২০-২৫ হাজার কোটি টাকা ধরা হলেও চার বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সব মিলিয়ে অন্তত ৩৫ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় সম্ভব ছিল বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে একেকটি আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে আদর্শ ব্যয়মান প্রতি মেগাওয়াট ১ মিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি, বর্তমান বিনিময় হারে যা ১২ কোটি টাকার সমপরিমাণ (প্রতি ডলারে ১১৮ টাকা ধরে)। সেই হিসাবে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যয় হওয়ার কথা ১৫ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। আর এ সক্ষমতার চারটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যয় হওয়ার কথা ৬৩ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা।

নির্মাণ ব্যয়ের এ হিসাব বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, রামপালে প্রতি মেগাওয়াট নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১২ কোটি ১২ লাখ টাকা। পায়রায় দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে একটিতে প্রতি মেগাওয়াট নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ২১ কোটি ৫৪ লাখ টাকার কিছু বেশি। অন্যটিতে তা প্রায় ১৮ কোটি টাকা। আর মাতারবাড়ীতে প্রতি মেগাওয়াট নির্মাণ ব্যয় ৪৭ কোটি ৪৬ লাখ টাকা।

গত এক দশকে বিদ্যুৎ খাতে বিদেশী ঋণ এসেছে বিপুল পরিমাণে। সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে নেয়া হয়েছে বেশির ভাগ ঋণ। যেমন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ এসেছে রাশিয়া থেকে। পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ২ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেয়া হয়েছে চীন থেকে। আর রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার ঋণসহায়তা ভারত থেকে নেয়া হয়েছে। এছাড়া মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ অন্যান্য প্রকল্প ঘিরে জাপান থেকে ৪৩ হাজার ৯২১ কোটি টাকা মূল্যের ঋণসহায়তা নেয়া হচ্ছে।

রাষ্ট্রীয় চুক্তির আওতায় বিদেশী ঋণে এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। দেশে নির্মিত বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যয় কমিয়ে আনা সম্ভব ছিল। অথচ আমরা তা নিশ্চিত করতে পারিনি। জনগণের ঘাড়েই বসছে ঋণ পরিশোধের বোঝা। যে ব্যয় দেখানো হয়েছে, ডলার অবমূল্যায়নের কারণে তা আরো বেশি হবে। জমির খরচ বেশি দেখানো হলেও নির্মাণ ব্যয় এত বেশি হওয়ার কথা নয়। আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে যৌক্তিক ব্যয় করা গেলে বিপুল পরিমাণে ব্যয় কমানো সম্ভব ছিল। জনগণের অর্থ ব্যয়ে আরো সতর্ক হওয়া দরকার।

দেশের বিদ্যুৎ খাত দীর্ঘদিন ধরেই লোকসান ও আর্থিক সংকটের বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। আর্থিক লোকসান থেকে বের হতে হলে খাতটি থেকে অযৌক্তিক ব্যয় কমিয়ে আনতে হবে। বিশেষ করে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ও অব্যবহৃত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যয় থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। ক্রমাগত লোকসানের বোঝা কমাতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে বারবার। যদিও তা বিপিডিবির মতো সংস্থাগুলোর দায়দেনা ও লোকসানের বোঝা কমাতে পারছে না। কোনো গোষ্ঠী স্বার্থকে গুরুত্ব না দিয়ে জনগণের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়া দরকার।

দৈনিক বণিকবার্তা