সারশিল্পকে বাঁচাতে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে
Share on:
শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহের মাধ্যমে সার কারখানাগুলোর উৎপাদন স্বাভাবিক করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি দ্রুত আমলে নেওয়ায় আমি তাঁকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
এখানে জ্বালানি আমদানির বকেয়া পরিশোধ, এলএনজি আমদানির এলসি জটিলতা কিংবা বিকল্প স্থানীয় সরবরাহের জন্য অপরাপর মন্ত্রণালয়ের সহায়তা ও যৌক্তিক সমন্বয় দরকার।
এলএনজি ও জ্বালানি তেল আমদানিতে আওয়ামী লীগ সরকার বকেয়া রেখে গেছে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। এলএনজিতে গত জুলাই পর্যন্ত বকেয়া ৭০০ মিলিয়ন ডলার। জ্বালানি তেলে বকেয়া ৫০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি (বণিক বার্তা, ১৬ আগস্ট, ২০২৪)।
বিপুল এ বকেয়া অপরিশোধিত রেখে সার কারখানায় পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ আসলেই কঠিন হবে।
সার, পেট্রো কেমিক্যাল, জ্বালানির অবাধ আমদানি ফরেন কারেন্সি লিকেজের খাত। আওয়ামী লীগের গ্যাস সরবরাহ পলিসিতে সার কারখানা অবহেলিত ছিল। বিপরীতে তারা ভারত থেকে সার আমদানির পলিসিতে ঝুঁকছিল।
কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ খাতে দীর্ঘ মেয়াদে ডলার সাশ্রয় করতে মৌলিক অবকাঠামোগত পরিকল্পনা, যেমন নতুন রিফাইনারি, ইষ্টার্ণ রিফাইনারীর ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি, সক্ষমতার বিপরীতে সার উৎপাদন, সার ও অ্যামোনিয়া উৎপাদনে পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ হয়নি।
বেসিক কেমিক্যালস এবং প্লাস্টিক-পলি-পেট ইত্যাদি উৎপাদনের কাঁচামাল, স্থানীয়ভাবে হাইড্রো কার্বন উৎপাদনের মৌলিক প্রকল্পে মনোযোগ ছিল না।
জ্বালানি আমদানি এলসির ডলার বাঁচাতে গিয়ে তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি ডলার গচ্চা দিয়েছে সার ও তৈরি পণ্য আমদানিতে। শেষ কয়েক বছরে এ রকম অসাড় ও জড় উন্নয়ন চিন্তা দিয়ে চলছে তারা।
সার ও জ্বালানি আমদানিতে স্পটমার্কেটকেন্দ্রিক কমিশন বাণিজ্যের মাত্রাতিরিক্ত ঝোঁক আজকে ব্যাপক দায়দেনার ভার তৈরি করেছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকেও চাপে ফেলেছে।
এমতাবস্থায় আমরা কয়েকটি ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনাগত বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই।
১. শীর্ষ পাঁচটি ইউরিয়া সার কারখানার মধ্যে চারটিই বন্ধ। শিল্প উপদেষ্টার জন্য আমি দুঃখিত, উত্তরাধিকার সূত্রেই এমন অসাধ্য চ্যালেঞ্জ পেয়েছেন। তথাপি জঞ্জাল সরাতে হবে দ্রুত। কেমিক্যাল ফ্যাক্টরিতে উৎপাদন বন্ধ থাকার মানেই হচ্ছে শত শত কোটি টাকার যন্ত্র ও যন্ত্রাংশের ক্ষতি।
অকেজো হচ্ছে মেশিনারি, মরিচা পড়েও নষ্ট হচ্ছে। রাসায়নিক প্ল্যান্টের (সার, তেল শোধনাগার বা যেকোনো পেট্রোকেমিক্যাল প্ল্যান্ট) প্রতি দুই থেকে তিন বছরের ব্যবধানে নিয়মিত ওভারহোলিং প্রয়োজন। ওভারহোলিংয়ের সময় ডিপ ইন্সপেকশন, টেস্টিং, মেরামত প্রয়োজন, যা পরবর্তী দুই থেকে তিন বছরের জন্য প্ল্যান্টকে ঝুঁকিমুক্ত রাখে। সরকারি প্ল্যান্টগুলোয় সঠিক পরিমাণে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করার পাশাপাশি মানসম্পন্ন রক্ষণাবেক্ষণের প্রতিষ্ঠিত চর্চা ও সংস্কৃতি দরকার। সরকারি সার কারখানাগুলোর চারটি জ্বালানি দক্ষতায় পশ্চাৎপদ। এর সমাধান দরকার।
সক্ষমতার ২৭ লাখ মেট্রিক টনের বিপরীতে গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলে ১০+ লাখ মেট্রিক টন সার জোগান দেওয়া যেত, কিন্তু ঘোড়াশাল-পলাশ মিলে উৎপাদন আছে অর্ধেকেরও কম। ফলে এমন একটি ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে, যেখানে কিছু ‘সেট রুল’ মানা হবে-
ক. যেহেতু ইউরিয়া উৎপাদনের পর্যাপ্ত সক্ষমতা আমাদের আছে, তাই ইউরিয়া আমদানি হবে না। শতভাগ স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা হবে। সরকারি কারখানার ইউরিয়ার উৎপাদনের মূল্য আমদানি কিংবা কাফকোর আন্তর্জাতিক বিক্রয়মূল্যের চেয়েও কম পড়ে। তাই সাশ্রয়ী বিকল্পটি গ্রহণ করতে হবে।
খ. টিএসপি কিংবা ফসফরাসের মতো অপরাপর সার, যেগুলোর স্থানীয় উৎপাদন পরিমাণে কম এবং উৎপাদন মূল্যও বেশি পড়ে, সেসব সার সাশ্রয়ী বৈদেশিক উৎস থেকে আমদানির স্থায়ী চুক্তি করা যেতে পারে। একটা বেজলাইন থাকবে, যা প্রতিবছর নির্দিষ্ট সোর্স থেকে নিয়মিত আমদানি হবে। এতে আন্তর্জাতিক সংকটেও সারের নিশ্চয়তা থাকবে।
গ. কম দামে গ্যাস পেয়েও কাফকোর সারের দাম বৈদেশিক আমদানি মূল্যের চেয়ে বেশি (টনপ্রতি ৩৩০ ডলার বা বেশি) পড়ছে, তাই কাফকোর সারের বিক্রয়মূল্য নির্ধারক ফর্মুলাটির পুনর্মূল্যায়ন দরকার! মূল্য সহনীয় করে কাফকোর বর্তমান মজুতের ৬০ হাজার মেট্রিক টনের ব্যাপারে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত দরকার।
সহনীয় মূল্যে মজুতের অন্তত অর্ধেক সার বিসিআইসি কিনে কাফকোর উৎপাদন সচলের একটা উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। অতিরিক্ত মজুতের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হয়ে, সারসংকট কাম্য নয়।
কাফকোর সার মূল্য কমানো না গেলে, ২০০৭ সালের আগের মতো আন্তর্জাতিক বাজারে সার বিক্রি অনুমতি দেওয়া যায়। দেশে সারসংকট রেখে বিদেশে বিক্রি শোভনীয় নয়। তথাপি কাফকোকে মূল্য প্রতিযোগিতায় নিতে হবে, মনোপলি ভাঙতে হবে।
ঘ. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, শিল্প মন্ত্রণালয়কে ইউরিয়া সারের বাৎসরিক চাহিদার বিপরীতে সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহের একটা বেজলাইন পরিমাণ ঠিক করতে হবে, যে পরিমাণ গ্যাস দিতে তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকবে। এলএনজি আমদানি করে হলেও বেজলাইন গ্যাসটা সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এতে খাদ্যনিরাপত্তায় অগ্রগতি হবে।
২. আওয়ামী লীগের আমলে সার আমদানিতে পাচার অভিযোগ ছিল, আন্তর্জাতিক বাজারে ২০২১-২২ অর্থবছরে সারের দাম বেড়েছে ১ দশমিক ৮৫ থেকে সর্বোচ্চ আড়াই গুণ। কিন্তু এ সময়ে সার আমদানিতে সরকারের খরচ বেড়েছে প্রায় পাঁচ থেকে কোনো কোনো মাসে ছয় গুণের কাছাকাছি।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র বলছে, মোট আমদানির পরিমাণ বাড়েনি, অর্থাৎ এখানে ডলার পাচার হতে পারে। আমদানি করা সরকারি সার পরিবহনকালেও পাচার হয়েছে। (৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, আজকের পত্রিকা)
৩. স্থানীয় সার আমদানিতেও মূল্য জালিয়াতি ছিল। বিসিআইসির আমদানি করা প্রতি টন সারের দাম পড়েছে ২৬৮ দশমিক ৩৩ ডলার। একই সময়ে সরকারের দেওয়া গ্যাসে উৎপাদন সচল রাখা কাফকো থেকে প্রতি টন সার কেনা হচ্ছে ৩৬০ ডলার মূল্যে, টনপ্রতি ৯২ ডলার বেশি দাম নিচ্ছে কাফকো। (আজকের পত্রিকা, ১১ অক্টোবর ২০২৩)
৪. বিসিআইসির প্রতিষ্ঠানগুলোতে, সার কারখানার ম্যানেজমেন্ট অজ্ঞ লোকে ভরে গেছে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের সাবেক ও বর্তমান সচিব, বিসিআইসি ও সার কারখানাগুলোর ম্যানেজমেন্টে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ও সিবিএর দৌরাত্ম্য সীমা ছাড়িয়েছে।
বাপেক্স, তিতাস, পেট্রোবাংলার সর্বত্র একই চিত্র। কৌশলগত ইঞ্জিনিয়ারিং খাতের বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের দুর্বৃত্ত চক্রগুলো ভেঙে অতি দ্রুত দক্ষতা ও গবেষণানির্ভর ম্যানেজমেন্টে গুরুত্ব দিন, মেধাভিত্তিক পদায়ন করুন।
৫. সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়েও ২-৩ টাকা বেশি দামে সার কিনতে হয় কৃষকদের। ডিলার ও খুচরা বিক্রেতারা কেজিপ্রতি ২-৩ টাকা বেশি রাখলে কৃষকের ২০-৫০ কেজি দামের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে। এখানে শৃঙ্খলা ফেরাতে বাজার মনিটরিং করুন।
কৃষি ও সারের ভর্তুকিতে দুর্নীতি থামাতে মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে অটোমেশন এবং ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন চিন্তাকে প্রাধান্য দেওয়া চাই। এখানে ডিলার আইডি, কৃষকের আইডি এবং বাধ্যতামূলক ডিজিটাল পেমেন্ট ম্যাপিং করে ডেটাবেজ ও সফটওয়্যারভিত্তিক ব্যবস্থাপনা শুরু করে দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব।
৬. বিশেষ টাস্কফোর্স করে সার ও পেট্রো কেমিক্যাল কারখানাগুলোর যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ, সিস্টেম প্রসেসগুলো আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন অডিট করে সার কারখানাগুলোর প্রকৃত স্বাস্থ্য এবং সক্ষমতা যাচাই করুন। দরকারি বিনিয়োগ করে ভবিষ্যৎ সারপ্রাইজ এবং ঝুঁকিমুক্ত থাকুন।
৭. ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিগত সরকার ইউরিয়াসহ বিভিন্ন সারের দাম বাড়িয়েছিল কয়েক দফা। যেহেতু আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম কমে এসেছে, তাই সারের দাম কিছুটা কমিয়ে দিন। এতে সরকারের ওপর কৃষকদের আস্থা বাড়বে। নতুন সরকার ‘জনবান্ধব’ এমন ইমেজ তৈরি হবে।
দেশে সার উৎপাদন এখনো বৈদেশিক আমদানি থেকে অনেক সস্তা। তা ছাড়া বৈশ্বিক কোনো সরবরাহ সংকটের বিপরীতে স্থানীয় উৎপাদন সক্ষমতা একটি টেকসই বিকল্প। তাই শাহজালাল, যমুনা, সিইউএফএল, আশুগঞ্জ কারখানাগুলো বাঁচান।
ঘোড়াশাল-পলাশকে পূর্ণ সক্ষমতায় নেওয়ার পরিকল্পনা নিন। সার আমদানিতে ডলার পাচার, স্থানীয় বিভিন্ন ধরনের চুরিগুলো থামাতে, ব্যবস্থাপনা দুর্বৃত্তপনা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে আন্তরিক চেষ্টা করুন।
এতেই কৃষকের কল্যাণ, দেশের কল্যাণ। সারশিল্প টেকসই হোক, কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত হোক, বাংলাদেশ এগিয়ে যাক!