'সার্ক' এর সূচনা ক্রমবিকাশ ও সাফল্য-ব্যর্থতার পর্যালোচনা
Share on:
পরে ১৯৯৬ সালে সার্ক ফান্ড ফর রিজিওনাল প্রজেক্টস (SFRP) ও সার্ক রিজিওনাল ফান্ড (SRF) একীভূত করে এসডিএফ গঠন করা হয়। সার্ক দেশগুলোর গৃহীত উন্নয়ন কর্মসূচি বিশেষ করে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামো উন্নয়ন কর্মসূচিসমূহ বাস্তবায়নের জন্যই এসডিএফ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
২০০৪ সালে পাকিস্তানের করাচীতে এসডিএফএর গভর্নিং বোর্ডের অষ্টম সভায় সার্কের সদস্য দেশগুলোর প্রস্তাবিত সকল কর্মসূচি অনুমোদন করা হয়। এছাড়াও এই অঞ্চলে দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য কর্মসূচি প্রণয়নের লক্ষ্যে সার্ক মহাসচিবের সমীক্ষা প্রস্তাবও তখন গৃহীত হয়েছিল। ২০০৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ত্রয়োদশ শীর্ষ সম্মেলনে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং প্রস্তাবিত এসডিএফ-কে ১০০ মিলিয়ন ডলার দেয়ার ঘোষণা দেন। এরপর থেকে এসডিএফ সক্রিয় করার উদ্যোগ নেয়া হয়। পরে নয়া দিল্লীতে অনুষ্ঠিত চতুর্দশ সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে উন্নয়ন তহবিলে ভারত ২০০ মিলিয়ন দেয়ার প্রস্তাব করে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ৩৪ মিলিয়ন ডলার দেয়ার প্রস্তাব করা হয়। ২০০৪ সালে ইসলামবাদ শীর্ষ সম্মেলনে দক্ষিণ এশীয় ফুড ব্যাংক গঠনের প্রস্তাব করা হয়। সদস্য দেশগুলোতে খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার করা এবং আপৎকালীন সময়ে খাদ্য ঘাটতির দেশগুলোতে খাদ্য সরবরাহ এই ব্যাংকের প্রধান লক্ষ্য। তবে সব দেশ এখনো ফুড ব্যাংকের এই প্রস্তাব অনুমোদন করেনি। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা প্রস্তাবটি অনুমোদন করেছে। প্রস্তাবিত ফুড ব্যাংকে ২৪১৫৮০ টন চাল ও গম মওজুদ রাখার কথা বলা হয়েছে। নয়াদিল্লীতে অনুষ্ঠিত চতুর্দশ সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে সার্কের আওতায় দক্ষিণ এশীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছিল। পরবর্তীতে ভারতের নয়াদিল্লীতে প্রতিষ্ঠিত হয় ।
প্রথম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার অবনতি, পণ্য মূল্য, ঋণের বোঝা, বহিঃসম্পদের সীমিত অবস্থা, অসম বাণিজ্য এবং উন্নত বিশ্ব কর্তৃক সংরক্ষণ নীতি অনুসরণের ব্যাপারে সার্ক নেতৃবৃন্দ উদ্বেগ প্রকাশ করেন। দ্বিতীয় সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে নারীদের অংশ গ্রহণের অনুকূলে ও মাদক দ্রব্যের ব্যবসা বন্ধে কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়। এছাড়া রেডিও, টেলিভিশনসহ দক্ষিণ এশিয়ার জন্য বেতার কর্মসূচি গ্রহণ, পর্যটন, ছাত্র শিক্ষার্থীদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি, কারিগরি, বৈজ্ঞানিক ও উন্নয়ন বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও প্রযুক্তি বিনিময়ের জন্য ডকুমেন্টশন সেন্টার প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তৃতীয় সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়ার জন্য একটি খাদ্য ভান্ডার গড়ে তোলা, রাজনৈতিক সন্ত্রাসীদের দেশ থেকে বিতাড়ন করে অভিযোগকারী দেশের হাতে তুলে দেয়া এবং পরিবেশ রক্ষায় আঞ্চলিক সহযোগিতার অঙ্গীকার করা হয়। সার্কভুক্ত দেশগুলোর সামরিক খাতে ব্যয় বৃদ্ধি না করা এবং পারমাণবিক অস্ত্র সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার উপর গুরুত্বারোপ করা হয়। চতুর্থ শীর্ষ সম্মেলনে সার্ক দেশসমূহের সুপ্রীম কোর্টে বিচারপতি ও পার্লামেন্টের সদস্যদের বিশেষ সার্ক ভ্রমণ দলিল দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
পঞ্চম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের দারিদ্র্য দূরীকরণের লক্ষ্যে কমিশন গঠন করা হয়। এই কমিশন ১৯৯২ সালে তাদের রিপোর্ট পেশ করে এবং ঢাকায় অনুষ্ঠিত সপ্তম সম্মেলনে তা অনুমোদিত হয়। এই রিপোর্টে ১০ বছরের মধ্যে দারিদ্র্য বিমোচনের প্রস্তাব করা হয়। ষষ্ঠ সম্মেলনে সার্ক দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃবাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে সাপটা গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহতি হয়। পরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সপ্তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে সাপটা স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী ১৯৯৫ সাল থেকে সাপটা কার্যকর হয়। এর আওতায় ২২৬টি পণ্যের ক্ষেত্রে শুণ্য থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক রেয়াত ঘোষণা করা হয়। সপ্তম সম্মেলনে ঢাকা ঘোষণায় সার্ক তৎপরতার ক্ষেত্রে সমন্বিত কর্মসূচিকে আরো সংহত ও জোরদার করা, পরিবেশ সংরক্ষণ ও অবক্ষয় রোধে জাতীয়, দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকসহ সব রকমের কর্মসূচি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়ার উপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
১৯৯৫ সালে নতুন দিল্লীতে অনুষ্ঠিত অষ্টম শীর্ষ সম্মেলনে একটি কার্যকর আন্তর্জাতিক চুক্তির অধীনে পূর্ণ পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের আহ্বান জানানো হয়। মালদ্বীপে অনুষ্ঠিত নবম শীর্ষ সম্মেলনের ঘোষণায় সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে অবাধ বাণিজ্য প্রসারের লক্ষ্যে দক্ষিণ এশীয় অবাধ বাণিজ্য এলাকা (সাফটা) গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। দশম সম্মেলনে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ত্বরান্বিত করা, ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তা বিধান, বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ এবং সন্ত্রাস ও মাদক চোরাচালান বন্ধের অঙ্গীকার করা হয়। এছাড়া ২০০২ সালের মধ্যে দারিদ্র্য বিমোচনে সার্কের অঙ্গীকার অব্যাহত রাখা এবং নারী ও শিশু পাচার রোধে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের কথা বলা হয়। শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত একাদশ সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতায় দৃঢ় অঙ্গীকার, অবাধ বাণিজ্য এলাকা গড়ে তোলা এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস প্রতিরোধের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়। ২০০৫ সালে ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ শীর্ষ সম্মেলনে ৪৩ দফা ঘোষণায় খাদ্য নিরাপত্তা কার্যকর, এইডস প্রতিরোধে ফলপ্রসূ পদক্ষেপ গ্রহণসহ অভিন্ন স্বার্থে বহুপাক্ষিক ফোরামে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নেয়ার কথা বলা হয়। এই সম্মেলন থেকে দক্ষিণ এশিয়ার জনগণের জীবন মানের উন্নয়ন ও মানবাধিকার সংরক্ষণের লক্ষ্যে সার্ক সামাজিক সনদ এবং সন্ত্রাস দমনে অতিরিক্ত প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়। ঢাকায় অনুষ্ঠিত ত্রয়োদশ সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয় অর্থনৈতিক ইউনিয়ন গঠনের অঙ্গীকার করা হয়। এছাড়া সম্মেলনে আঞ্চলিক সহযোগিতা, দারিদ্র্য বিমোচন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সন্ত্রাস নির্মূল ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের অভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় পারস্পরিক সহযোগিতা ও একযোগে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়।
২০০৭ সালে নয়াদিল্লীতে অনুষ্ঠিত চতুর্দশ শীর্ষ সম্মেলনে সন্ত্রাস দমন ও যোগাযোগ বৃদ্ধির উপর গুরুত্বারোপ করা হয়। দিল্লী সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং আঞ্চলিক ফুড ব্যাংক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়। ২০০৮ সালে কলম্বোতে অনুষ্ঠিত পঞ্চদশ শীর্ষ সম্মেলনে বহুমুখী যোগাযোগ ও ট্রানজিট সুবিধা, বাণিজ্য বৃদ্ধি এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়। এতে সন্ত্রাসীদের ব্যাপারে তথ্য বিনিময় ও আইনগত সহায়তা প্রদান, এসডিএফ সনদ অনুমোদন, দক্ষিণ এশীয় স্ট্যান্ডার্ড টেস্টিং ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা এবং সাফটার আওতায় আফগানিস্তানকে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দুর্ভাগ্য বশতঃ এই সিদ্ধান্তটি ভারত তার স্বার্থে ব্যবহার করছে।
সার্কের চ্যালেঞ্জসমূহ : ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বর মাসে ঐক্যবদ্ধভাবে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে ৭টি দেশের অর্থনৈতিক সমস্যাবলীর মোকাবেলা এবং সমৃদ্ধি ও প্রবৃদ্ধির হার ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে সার্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই সাতটি দেশ পরস্পর পরস্পরের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী এবং অত্যন্ত কাছাকছি অবস্থিত হলেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন কিংবা আসিয়ানের ন্যায় তাদের মধ্যে আন্তঃবাণিজ্যের হার বৃদ্ধি পায়নি, বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং সদস্য দেশগুলোর মধ্যে নতুন বাজার সৃষ্টি, দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক অগ্রগতির পূর্বশর্ত । এই শর্ত পূরণে আঞ্চলিক এই সংস্থাটির ভূমিকা অত্যন্ত সীমিত বলে প্রতীয়মান হয়। সদস্য দেশগুলোর উপর ভারতের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রবণতা এর জন্য প্রধানতঃ দায়ী। সার্কের সদস্য দেশগুলোর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যের সমস্যাও রয়েছে। একটি বড় ও শক্তিধর দেশ হিসেবে ভারত অন্যান্য দেশগুলোকে সার্কের সম অংশীদার বলে মনে করে না। সার্ক দেশসমূহের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যের অভাব, প্রতিবেশী দেশসমূহের সাথে ভারত সম্পর্কে তিক্ততা ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রবণতা আঞ্চলিক এই জোটের ঐক্য ও সংহতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। এর ফলে বাণিজ্যিক চুক্তিসমূহের ফলপ্রসূ বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়েছে। এতে করে সদস্য দেশগুলোকে জোট ও চুক্তির বাইরে এসে একক ও দ্বিপাক্ষিক উদ্যোগ গ্রহণ করে স্বস্ব বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থরক্ষার চেষ্টা করতে দেখা যায়।
২০১৪ সাল পর্যন্ত সার্কের তিন দশকের কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, দক্ষিণ এশিয়ার আর্থ সামাজিক নীতির স্থপতি হিসেবে নয়, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও সম্মেলনের মাধ্যমে আঞ্চলিক আলাপ-আলোচনা উৎসাহিত করার একটি ফোরাম হিসেবেই সার্কের কর্মকান্ড বেশি পরিচিতি লাভ করেছে।
একটি আঞ্চলিক সংস্থা বা জোট হিসেবে এই প্রতিষ্ঠানটির কার্যকারিতা কতিপয় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। সার্কের কাঠামোটি প্রকৃতপক্ষে আঞ্চলিক সহযোগিতার অনুকূল নয়। সার্ক শীর্ষ সম্মেলনই হচ্ছে সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারক কর্তৃপক্ষ। শীর্ষ সম্মেলনের অংশীদার যে কোনও একটি দেশ অনীহা প্রকাশ করলে সম্মেলন পন্ড হয়ে যেতে পারে। কার্যত হয়েছেও তাই। সার্ক প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত ৩২টি বছরে এর সনদ অনুযায়ী ৩২টি শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবার কথা থাকলেও হয়েছে মাত্র ১৮টি। অবশিষ্ট ১৪টি হয়নি। এর প্রধান কারণ ভারতের বিরোধিতা। ভৌগোলিক আয়তন, অর্থনৈতিক অবস্থা, সামরিক শক্তি এবং আন্তর্জাতিক প্রভাব এর সব ক’টি দৃষ্টিকোণ থেকেই ভারত দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে একটি শক্তিধর দেশ। এ প্রেক্ষিতে আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী একটি শক্তি হিসেবে ভারতের সম্ভাবনা আসিয়ানের তুলনায় সার্ককে একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন জোটে পরিণত করেছে। সার্ক ভারতীয় আধিপত্যবাদের খপ্পরে পড়ে যাবে এই ভয়ে প্রাথমিক অবস্থায় পাকিস্তান এতে যোগ দিতে চায়নি।
ভারত সার্ককে তার স্বার্থ উদ্ধারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের একাধিক নজিরও ইতোমধ্যে স্থাপন করেছে। এর ট্রানজিট ও আঞ্চলিক হাইওয়ে এবং কানেক্টেভিটি সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত প্রকৃতপক্ষে ছিল ভারত প্রভাবিত। বাংলাদেশের উপর দিয়ে তার উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সংঘাতমুখর রাজ্যগুলোতে উৎপাদিত পণ্যের আনা নেয়া নিশ্চিতকরণই ছিল এর লক্ষ্য। প্রতিবেশী প্রত্যেকটি সদস্যদেশ সার্ক এর উপর ভারতীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার বিরোধী; তাদের ধারণা এর ফলে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহেযাগিতার পরিবেশ ক্ষুণ্ন হতে বাধ্য। আবার ভারতের তরফ থেকে কয়েকটি প্রতিবেশী দেশকে নাম মাত্র কয়েকটি প্রস্তাব দেয়া ছাড়া দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর ভয় ও আশংকা দূরার করার কোনও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। তাদের প্রতি ভারতের আচরণ কখনো বন্ধুসুলভ ছিল না, এখনো নেই। অভিন্ন অন্তর্জাতিক নদী উজানে বাঁধ দিয়ে ভারত বাংলাদেশে কৃষি ব্যবস্থা ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। পাকিস্তান, নেপাল ও ভুটানও তার আগ্রাসনের শিকার। বাংলাদেশের সাথে ভারতের দীর্ঘ মেয়াদী সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে সমুদ্র সীমা নির্ধারণ নিয়ে বিরোধ, ছিটমহল বিনিময়সহ স্থল সীমানা নির্ধারণ, আন্তর্জাতিক নদীসমূহের পানি ভাগাভাগি ও ব্যবস্থাপনা সমস্যা, সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ, সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক হরহামেশা বিনা উস্কানিতে গুলী বর্ষণ, বাংলাদেশীদের হত্যা ও তাদের ছত্রছায়ায় বাংলাদেশ ভূখন্ডে ঢুকে ভারতীয়দের জমি দখল, চাষাবাদ,লুটপাট প্রভৃতি। এই সমস্যাগুলো জিইয়ে রেখে ভারত কৌশলে বাংলাদেশের ভারতপন্থী সরকারের কাছ থেকে বন্দর, করিডোর, ট্রানজিট ও গ্যাস, কয়লা ব্যবহারের সুবিধা আদায় করে নিয়েছে যা দেশের ১৬ কোটি মানুষ সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। সাধারণ মানুষের এই প্রতিক্রিয়া উভয় দেশের জনগণের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় বাধা হয়ে রয়েছে যা সার্ক এর দর্শনকে দুর্বল করছে।
দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে রয়েছে বিশাল ঘাটতি। আনুষ্ঠানিক বাণিজ্যে এই ঘাটতির পরিমাণ গড়ে বছরে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা। অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য বিশেষ করে চোরা কারবারকে অন্তর্ভুক্ত করা হলে এর পরিমাণ বছরে ৬০ হাজার কোটি টাকা অতিক্রম করে। সার্ক এর সাপটা, সাফটা কিংবা উভয় দেশের মধ্যে সম্পাদিত কোনও প্রকার বাণিজ্য চুক্তিই এই ব্যবধান হ্রাস করতে পারছে না। ভারতের শুল্ক ও শুল্ক বহির্ভূত বিধি নিষেধ এর জন্য প্রধানত দায়ী। এ ক্ষেত্রে তাদের গৃহীত ব্যবস্থাসমূহের স্বচ্ছতাও নেই। শুল্ক সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পণ্যের শ্রেণী বিন্যাস নিয়ে বিরোধ, রাসায়নিক পরীক্ষা ও ইন্ডিয়ায় কাস্টমস কর্তৃপক্ষের নিজস্ব মূল্যায়নের উপর গুরুত্বারোপ রুলস অব অরিজিন সার্টিফিকেট গ্রহণে অস্বীকৃতি, একতরফাভাবে ট্যারিফ মূল্য চাপিয়ে দেয়া, আইএসআই সার্টিফিকেট গ্রহণের বাধ্যবাধকতা, বিএসটিআই সনদ গ্রহণে অস্বীকৃতি, কোয়ারেন্টাইন সনদের বাধ্যবাধকতা প্রভৃতি ভারতে বাংলাদেশী পণ্যের প্রবেশকে অসম্ভব করে তুলেছে। ফলে সার্ক এর বাণিজ্যিক কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে। প্রায় একই রকমের অবস্থা অন্যান্য দেশেও বিরাজ করছে। আবার সামাজিক ও অর্থনেতিক প্রাধান্যের সুযোগ দেশটিকে প্রতিবেশীদের প্রতি উদ্ধত ও আপোষহীন করে তুলেছে। দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ভারতের সাথে প্রতিবেশী দেশসমূহের দীর্ঘমেয়াদী বিরোধ সার্ক এর কার্যকারিতার উপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করছে। (চলবে)