‘সময়ের প্রয়োজনেই প্রজন্মের এই অসন্তোষ’
Share on:
উনিশ শতকের শেষ দিকে বাংলার পূর্বাঞ্চলের তথা হালের বাংলাদেশের রাজনৈতিক উত্থানটা ছিল বেশ নাটকীয়। ব্রিটিশ নিপীড়নে যখন বাংলাজুড়ে মন্বন্তরের চাবুক, তখন কলকাতাকে তারা সাজাচ্ছিল তাদের বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে। কিন্তু ১৮৫০ সালের পর থেকে এ অঞ্চলে পাট চাষের অস্বাভাবিক উল্লম্ফন গোটা সমীকরণ বদলে দিল।
যেহেতু শিল্প বিপ্লবের পর ইউরোপে ব্যাপকভাবে চাহিদা বেড়েছে পাটের; ফলে একচেটিয়া দাপট প্রতিষ্ঠা করে পূর্ববঙ্গ তথা আজকের বাংলাদেশের ভূমিজ জনপদ। পাটচাষে নিয়োজিত চাষী, ভূমি বর্গাদানকারী, পাটকলে কাজ করা শ্রমিকরা লাভবান হতে থাকেন। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা স্পষ্ট হয়; ১৮৫০ সালে বাংলা অঞ্চলে পাটের চাষ হতো ৫০ হাজার একর জমিতে। মাত্র ৫০ বছরের ব্যবধানেই ১৯০০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ লাখ একরে। এ বিশাল বিস্তৃতির কারণে কলকাতার বাইরে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, ময়মনসিংহ ও সিলেটের মতো অঞ্চলে বাড়তে থাকে অর্থনৈতিক কর্ম তৎপরতা। পাটচাষী ও সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের হাতে উদ্বৃত্ত টাকা জমতে শুরু করায় তারা সাহস পান পরবর্তী প্রজন্মকে ব্যয়বহুল ইংরেজি শিক্ষায় পাঠাতে। পাটের সূত্রে গড়ে ওঠা এ মধ্যবিত্ত ও ইংরেজি শিক্ষিত প্রজন্মই পরবর্তী বাংলার ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করেছে। যেহেতু পূর্ববঙ্গ ছিল মুসলিমপ্রধান, ফলে সেটা ছিল অন্য অর্থে বাঙালি মুসলমানেরই উন্মেষ পর্ব। ১৮ শতাব্দীর আশি ও নব্বইয়ের দশকে পূর্ববঙ্গের সংবাদ-সাময়িকী কেবল নয়, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গেও প্রতিবিম্বিত হয়েছে সে বাস্তবতা।
বর্তমান বাংলাদেশ নতুন এক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। গণ-আন্দোলন হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এর মধ্যেই নানাভাবে আন্দোলন নিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হয়েছে, হচ্ছে এবং আরো হবে। ২০১৩ সালে ছোট পরিসরে ও ২০১৮ সালে সফলভাবেই কোটা সংস্কার আন্দোলন হয়। হয়েছিল নিরাপদ সড়ক দাবিতেও বড়সড় আন্দোলন। ছোট পরিসরে হলেও ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে প্রশ্নফাঁসের বিরুদ্ধে কিংবা সীমান্ত হত্যা নিয়েও চাউর হয়েছে বাহাস। আইয়ুব খান ও এরশাদের আমলকে গুনতিতে ধরলেও এত অল্প সময়ে এত বেশি গণ-অসন্তোষের উদাহরণ বিরল। এজন্যই বিশেষজ্ঞদের অনুসিদ্ধান্ত, কেবল কোটা বৈষম্যের কারণে নয়; দেড় দশক ধরে দেশে ঘটে যাওয়া নানা খাতে সঞ্চিত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ এ আন্দোলন। বাক স্বাধীনতার প্রশ্নে, সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রশ্নে, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার প্রশ্নে, ভিন্ন মতের দমন, মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্বের ঊর্ধ্বগতি প্রশ্নে—সব কিছু নিয়ে সৃষ্ট এ ক্ষোভ। আধুনিক রাষ্ট্রের মৌলিক ভিত্তি হলো ভোট, অথচ গত দেড় দশকে খুব অল্প মানুষই তার অধিকার লাভে ধন্য হয়েছে। ফলে গণ-অসন্তোষে বহুমাত্রিক শেকড় হাজির থাকার দাবি যথেষ্ট যৌক্তিক। তার পরও আন্দোলনের এ মৌসুমে খোদ আন্দোলনকারীদের দিকে তাকানো উচিত মনে হয় এক দফা। রাস্তায় নামা তরুণ প্রজন্মের বড় অংশ মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। আরো স্পষ্ট করে বললে, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা অধিকাংশ ছাত্রই মফস্বল থেকে আসা; আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারাই। গত দেড় দশকের শিক্ষার মধ্য দিয়ে তারা কেবল নিজেদের পরিচয় জেনেছেন, এমন নয়। জেনেছেন ক্ষমতা কাঠামো কীভাবে কাজ করে, জেনেছেন দেশের ‘হাতে গোনো কয়েকটা শহর’ কীভাবে সাড়া দেশকে সংজ্ঞায়ন করছে। হাতে গোনা কয়েকজন মানুষ কীভাবে দাঁড়িয়ে আছে ‘সমগ্র জাতি’ অভিধা নিয়ে কিংবা কীভাবে জীবনের নিরাপত্তার জন্য কোনো রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতা অনিবার্য হয়ে পড়ছে। তাদের অর্জিত এ অভিজ্ঞতা দিয়ে জমাট বাঁধছে নতুন শ্রেণী চেতনার স্ফুলিঙ্গ।
পাটচাষে সৃষ্ট উনিশ শতকের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীরা নিজেদের উপস্থিতি জানান দিয়েছিলেন আত্মপরিচয়কে সংজ্ঞায়নের মধ্য দিয়ে। সে আত্মজিজ্ঞাসার রাজনৈতিক প্রকাশ দৃশ্যমান হয় মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা যে ঢাকায় হলো, তাও এমন অনুসিদ্ধান্তের পেছনে বড় যুক্তি। আবার বায়ান্নর পর থেকে যে একসারি আন্দোলন, তার ঐতিহ্য দাঁড়িয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা ও তার মধ্য দিয়ে সৃষ্ট নতুন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভেতর। তাতে যুক্ত হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীও। তাদের চোখে-মুখে ছিল পাকিস্তানি বৈষম্যের বিপরীতে নিজেদের প্রাপ্য হিস্যা বুঝে পাওয়ার দাবি। আজকের রাস্তায় নেমে আসা তরুণদের চোখে-মুখে সেই চেতনা পাঠ করা কি খুব কঠিন?
মধ্যবিত্তের সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টি জাতির ভাগ্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক। কোনো জনপদে যখন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে ওঠে, তাদের স্বীকৃতির জন্য প্রশস্ত ব্যবস্থা থাকতে হয় শাসনযন্ত্রের। কারণ সনাতনপন্থীদের ক্ষমতা কাঠামোয় যদি নবগঠিত মধ্যবিত্ত যথাযথ স্বীকৃতি না পায়, তাহলে যেকোনো মূল্যে তারা তা আদায় করে নেবে। সেক্ষেত্রে যদি সনাতন ব্যবস্থাকে বাধা মনে হয়, সর্বোচ্চ নিষ্ঠুরতায় ছুড়ে ফেলবে তাকে। এটাই ইতিহাসের সমীকরণ, বিপ্লবের ব্যাকরণ। ফরাসি বিপ্লব, আমেরিকান বিপ্লব কিংবা রুশ বিপ্লবের পেছনে থাকা কারণের দিকে তাকালে এ অনুসিদ্ধান্ত স্পষ্ট হয়। সেসব বিপ্লবের মধ্য দিয়ে পুরনোকে ছুড়ে ফেলে স্থাপন হয়েছে নতুন ব্যবস্থা। স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছে নব উত্থিত শক্তি। সেই সব উত্থান নতুন করে সংজ্ঞায়ন করেছে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে। মূলত ক্ষমতা ধরে রাখার কৌশল হলো বৈষম্য কম রাখা। কারণ বৈষম্য যেখানে যত বেশি দৃশ্যমান, আন্দোলন তত পরিব্যাপ্ত। স্বীকৃতি না পাওয়াদের ক্ষোভ তত বেশি।
সোশ্যাল মিডিয়ার উত্থান প্রজন্মের এ আন্দোলনকে যেন আরো বেশি প্রসারিত করেছে। ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট কোথায় কি দমন করেছে সেটা পরের কথা। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে গেছে আন্দোলনের পেছনের নৈতিক ভিত। আসাদের মৃত্যুর বর্ণনা শুনেছে মানুষ; আর আবু সাঈদের মৃত্যুর ভিডিও দেখেছে চোখে। ঐতিহাসিকতার দিক থেকে আসাদের মৃত্যুর চেয়ে আবু সাঈদের মৃত্যু কম ইমপ্যাক্টফুল হবে না। শুধু আবু সাঈদ নয়, কাকে কোথায় কীভাবে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, পেটানো হচ্ছে, সেটা মুহূর্তেই ছড়িয়ে যাচ্ছে দেশে ও বিদেশে। সামনে চলে আসছে শাসনযন্ত্রের মিথ্যাচার। এটা আন্দোলনের মূল স্পিরিটকে আরো ন্যায্যতা দেয়। চলমান বৈষম্য নিয়ে তাদের যে দীর্ঘ অভিযোগের ফিরিস্তি, তার পাটাতনকেই শক্তিশালী করে। সমরবিদ্যার সূত্র অনুসারে, যুদ্ধ জয়ের আদিতম হাতিয়ার অস্ত্র বা কৌশল নয়, নৈতিক অবস্থান। কারণ নৈতিক ভিত ঠিক না হলে শত্রুর শিবিরে ন্যায্যতায় ঐক্য তৈরি হয়। নিজের শিবিরে জন্ম নেয় টানাপড়েন।
ইউরোপের এনলাইটেনমেন্টের আগে পোপতন্ত্র ধর্মের দোহাই দিয়ে নির্যাতন চালিয়েছে। ডাইনি হত্যার নামেও চলেছে ভিন্ন মতের নিধন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সংকট হচ্ছে, সব বৈষম্যকে বৈধ করার জন্য রাষ্ট্রপক্ষ ‘মুক্তিযুদ্ধ’কে ব্যবহার করেছে। প্রতিবার ভিন্নমতকে দমন করতে গিয়ে আশ্রয় নেয়া হয়েছে এ ‘জাদুর কাঠি’র। ফলে পোপতন্ত্রের মতো এর দিকেও আঙুল তুলেছে আন্দোলনকারীরা। মুক্তিযুদ্ধকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছে নিজের প্রগতিবাদী সময়ে দাঁড়িয়ে। তারা কেউ মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারের বাইনারি ব্যবস্থা নিয়ে অতটা আবেগমথিত নয়, যতটা আবেগি কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কাঙ্ক্ষিত বিভাগে নেহাত বৈষম্যের কারণে সুযোগ না পেয়ে। বর্তমানের বেকারত্ব, মূল্যস্ফীতি ও সার্বিকভাবে অধিকারের স্বীকৃতি আদায় তাদের জন্য অনেক বড় কিছু। বিষয়টা সনাতনপন্থীদের আতঙ্কিত করতে পারে, কিন্তু প্রতিটি প্রজন্মের সামনে দাঁড়িয়ে ইতিহাস এভাবেই কাজ করেছে। ব্যাখ্যা ও পুনর্ব্যাখ্যা হয়ে এগিয়ে গেছে, কেউ মানুক আর না মানুক।
ফলে এ আন্দোলন সাধারণ আন্দোলন নয়। হয়তো ভুল হচ্ছে বা হবে প্রচুর; হয়তো তারা ব্যবহৃতও হবে দুয়েকবার। কিন্তু কোনো একক ব্যক্তি কিংবা একক দলের পরিচালিত বলে একে বর্জন করলে ভুল হবে। ‘ট্যাগ’ দিলে ক্ষোভই বাড়বে শুধু। দিন শেষে এ মানুষ ঘুরে-ফিরে আসবে রাস্তায়। যদি আজকে হত্যা, গ্রেফতার ও গুমের মাধ্যমে তাদের ফিরিয়েও দেয়া হয়; তার পরও। যেমনটা ২০১৮ সালে এসেছিল। ১৯০৫ কিংবা ১৯৬৯ সালে যেমনটা চেয়েছিল ‘প্যারাডাইম শিফট’। সময় যত গড়াবে, বৈষম্যের শিকার শিক্ষিত নিম্নমধ্য ও মধ্যবিত্তের দলটা আরো ভারী হবে। আর রাস্তায় নামাটা যত সহজ, রাস্তা থেকে ওঠে আসাটা তত সহজ নয়। যে একবার ভয় কাটিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছে, তাকে তার হিস্যা বুঝিয়ে না দিয়ে ঘরে ফেরানোটা প্রায় অসম্ভব।
পাকিস্তানের জন্ম ছিল এ প্রস্তাবের ওপর দাঁড়িয়ে যে ভারতে অধিকারবঞ্চিত মুসলিমরা তাদের প্রাপ্য হিস্যা পাবে না। ঠিক একই পাটাতনে দাঁড়িয়ে পরবর্তী সময়ে জন্ম হয় বাংলাদেশের। বাঙালিরাও বুঝেছিল, পাকিস্তানের আঞ্চলিক ব্যাকরণে তারা ন্যায্য অধিকার পাবে না। আজ স্বাধীনতার এত বছর পর যখন নিজ দেশে তরুণদের চোখে সনাতনী ব্যবস্থার বৈষম্য স্পষ্ট; তখন তারা কথা বলতে চায় সবকিছুকে ছাপিয়ে। যেন মনে করিয়ে দিতে চায় প্রখ্যাত সাহিত্যিক জহির রায়হানের সুখপাঠ্য গল্প ‘সময়ের প্রয়োজনে’-এর কথা। মুক্তিযোদ্ধারা কেন লড়াই করেছেন তার শেষ জবাব ছিল ‘সময়ের প্রয়োজনে’। প্রজন্মের এ তীব্র অসন্তোষও কি দিনশেষে সময়ের প্রয়োজনে নয়?