সামষ্টিক অর্থনীতির চাপ সামলাতে বিদেশী ঋণ গ্রহণে সতর্ক ও বিচক্ষণ হোন
Share on:
দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অর্থায়নের অন্যতম উৎস বৈদেশিক ঋণ। তবে গত দেড় দশকে বিদেশী উৎস থেকে অস্বাভাবিক হারে ঋণ নেয় তৎকালীন সরকার। ফলে গত বছরের ডিসেম্বরে বিদেশী ঋণের স্থিতি ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছিল।
সম্প্রতি আবারো এ ঋণ শত বিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন (অর্থবছর) শেষে সরকারি ও বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণের স্থিতি ছিল ১০ হাজার ৩৭৯ কোটি ডলার। এ অর্থ বাংলাদেশী মুদ্রায় ১২ লাখ ৪৫ হাজার ৪৮০ কোটি টাকার সমান (প্রতি ডলার ১২০ টাকা ধরে)। আর গত মার্চে বিদেশী ঋণের স্থিতি ছিল ৯ হাজার ৯৩১ কোটি ডলার। সেই হিসাবে গত তিন মাসের ব্যবধানে বিদেশী ঋণের স্থিতি বেড়েছে ৪৪৮ কোটি ডলার।
বৈদেশিক ঋণ সামষ্টিক অর্থনীতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে এটি নির্ভর করে দক্ষ ঋণ ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি রফতানি বাণিজ্য থেকে ভালো আয়, প্রত্যাশিত রেমিট্যান্স প্রবাহ, ডলারের বিপরীতে টাকার মান বজায় থাকা প্রভৃতির ওপর। মোট কথা, অর্থনীতির সার্বিক অবস্থা স্থিতিশীল থাকা জরুরি। কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে দেশের অর্থনীতিতে নানামুখী চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান—টাকার মান অবমূল্যায়নসহ ডলার ও রিজার্ভ সংকট, আমদানির বিপরীতে রফতানি আয় উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে না, নেই রফতানিতে বৈচিত্র্যও। আবার মন্দ ঋণ ও খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে বিরাজ করছে অনিশ্চয়তা। উচ্চ মূল্যস্ফীতি এখনো চড়াও হয়ে আছে সর্বসাধারণের ওপর। এ অবস্থায় ঋণের পরিমাণ আরেকবার ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। এর অর্থ হলো বাজেটে ঋণের সুদ ব্যয়ের চাপ আরো বাড়ল। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষয় আরো বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সামষ্টিক অর্থনীতির চাপ কমাতে তাই বর্তমানে অপ্রয়োজনীয় বিদেশী ঋণ নেয়া বন্ধ করা আবশ্যক।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন দেশ ও দাতা সংস্থা চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) প্রথম তিন প্রান্তিকে (জুলাই-মার্চ) বাংলাদেশের অনুকূলে ঋণের অর্থ ছাড় করেছে ৫৬৩ কোটি ডলার। এ সময় সরকারকে বিদেশী ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ করতে হয়েছে ২৫৭ কোটি ১৫ লাখ ডলার। সে হিসাবে অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে বাংলাদেশের অনুকূলে ঋণ হিসেবে ছাড়কৃত অর্থের অর্ধেকের কাছাকাছি (প্রায় ৪৬ শতাংশ) ব্যয় হয়েছে ঋণের কিস্তি (সুদ ও আসল) পরিশোধে। চলতি অর্থবছরের জুলাইয়ে ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে ৩৮ কোটি ৫৬ লাখ ৭০ হাজার ডলার, যেখানে একই সময়ে বৈদেশিক ঋণের অর্থ ছাড় হয়েছে ৩৫ কোটি ৮৩ লাখ ৩০ হাজার ডলার।
বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) পাশাপাশি জাপান, চীন, রাশিয়া ও ভারতের মতো দেশের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি বিদেশী ঋণ নেয় বাংলাদেশ। এসব ঋণের বড় অংশ আসে প্রকল্প বাস্তবায়ন ও বাজেট সহায়তা হিসেবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সাম্প্রতিক সময়ে নেয়া বেশির ভাগ বিদেশী ঋণ অত্যন্ত ব্যয়বহুল। বিদেশী ঋণের বিপরীতে রিটার্ন আসছে স্থানীয় মুদ্রায় বা টাকায়, তাই ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে বিদেশী ঋণের ব্যয় বাড়বে। প্রকল্পগুলোর জন্য পাইপলাইনে যে বিদেশী ঋণ জমা আছে তা দ্রুত ব্যবহার করতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছর শেষেও বিদেশী উৎস থেকে সরকারি ও বেসরকারি খাতের মোট ঋণ স্থিতি ছিল ৪১ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ৩৪ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার ছিল দীর্ঘমেয়াদি ঋণ। বাকি ৬ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ ছিল স্বল্পমেয়াদি। ওই সময় বিদেশী ঋণ ছিল দেশের মোট জিডিপির ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ। এর পর থেকে বিদেশী ঋণ ক্রমাগত বেড়েছে, সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ২০১৮ সালের পর।
সরকারি বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের পাশাপাশি গত এক দশকে বিদ্যুৎ খাতেও বিপুল পরিমাণ বিদেশী ঋণ এসেছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ এসেছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণের জন্য ১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে রাশিয়া। পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ২ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেয়া হয়েছে চীন থেকে। আর রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার ঋণসহায়তা দিয়েছে ভারত। এছাড়া মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ অন্যান্য প্রকল্প ঘিরে জাপান থেকে ৪৩ হাজার ৯২১ কোটি টাকার সমপরিমাণ ঋণসহায়তা নেয়া হচ্ছে। সরকারের পাশাপাশি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও বিদেশী বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নিচ্ছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশী ঋণের স্থিতি এখন ১১ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি বিদেশী ঋণ রয়েছে ২ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার।
দেশের চলমান সংকটের ভেতরে বিদেশী ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়লে তা অর্থনীতিকেই চাপে ফেলবে। তখন আরো বেশি পরিমাণে ডলারের প্রয়োজন হবে। কিন্তু প্রত্যাশা অনুযায়ী রেমিট্যান্স, রফতানি আয়সহ দেশের ডলার সংস্থান বাড়ানো না গেলে এর বিপরীতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন ঠেকানো কঠিন হবে।
আবার ঋণ করে ঋণ পরিশোধ করার পরিকল্পনা যদি করা হয় এতে দেশ আরো বড় অংকের ঋণের ফাঁদে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। রাজস্ব আয় বাড়ানো এক্ষেত্রে একটি সমাধান হতে পারে। এজন্য সরকারের আয় বাড়ানোর ওপর মনোযোগ বাড়াতে হবে। রাজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য রাজস্ব আহরণ প্রক্রিয়ার সংস্কার জরুরি। সবচেয়ে জরুরি প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়ন করা। অর্থনীতিবিদদের মতে, দেশে বৈদেশিক ঋণের অর্থ ছাড় না হওয়ার পেছনে প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি অন্যতম দায়ী। বিদেশী প্রতিশ্রুত ঋণের বড় অংশই আসে প্রকল্প ঘিরে। ফলে সেখানে কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন। প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। আপাতত স্বল্প প্রয়োজনীয় বা অপ্রয়োজনীয় বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ থেকে বিরত থাকা উচিত সরকারের। এছাড়া প্রকল্প দীর্ঘায়িত করে ব্যয় বৃদ্ধির সংস্কৃতি থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে। দ্বিপক্ষীয় ঋণের ক্ষেত্রে চুক্তির শর্ত কিংবা কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানোর জন্য আলোচনা শুরু করা উচিত। সামষ্টিক অর্থনীতির ঝুঁকি কমাতে বর্তমান সরকার বিদেশী ঋণ গ্রহণে সতর্ক ও বিচক্ষণ হোক—এই প্রত্যাশা।