সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় অনুপম আদর্শ হযরত মুহাম্মদ (সা.)
Share on:
ন্যায়বিচার মহান ব্যক্তিত্বদের বৈশিষ্ট্য, ধার্মিকদের গুণ, সৎকর্মশীলদের অভ্যাস এবং মুমিনদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতার পথ। পৃথিবীতে এরূপ যত গুণীজন ও নবী-রাসুল এসেছেন, তাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ছিলেন বিশ্বনবী, শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)।
যিনি সর্বোত্তম সালাম ও দোয়ার অধিকারী। ন্যায়বিচার তাঁর মহান চারিত্রিক গুণাবলির অন্যতম। তিনি চেনা-অচেনা, বন্ধু-শত্রু, সমমত বা বিপরীতমত সবার সঙ্গে ন্যায়ের আচরণ করতেন। এমনকি সবচেয়ে কঠোর শত্রুরাও তাঁর ন্যায়বিচারের অংশ পেত। কীভাবে তিনি ন্যায়বিচার করবেন না, যিনি এই স্পষ্ট ও প্রকাশ্য আদেশের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিলেন: হে মুমিনগণ! আল্লাহর জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় থাকো এবং কোনো জাতির প্রতি বিদ্বেষ তোমাদের ন্যায়ের পথ থেকে বিরত রাখবে না। ন্যায়বিচার করো, সেটাই আল্লাহভীতির নিকটবর্তী। আল্লাহকে ভয় করো, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের কাজ সম্পর্কে অবহিত (সুরা মায়িদা: ৮)। তিনি আল্লাহর এই আদেশ সব সময় পালন করতেন; তাঁর সঙ্গী এবং শত্রুদের সবার প্রতি ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে আচরণ করতেন।
রাসুল (সা.) নবুওয়াতের বহু বছর আগে, যুবক অবস্থায় ‘হিলফুল ফুজুল’ নামে একটি সামাজিক সংগঠনে যোগ দিয়েছিলেন, যারা সামাজিক বৈষম্য ও আগ্রাসনের শিকারদের সাহায্য করতেন। তাদের লক্ষ্য ছিল: ‘তারা অত্যাচারিতদের সাহায্য করবে এবং সর্বতো চেষ্টা করে তাদের অধিকার রক্ষা করবে।’ বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি জীবনের প্রতিটি দিক তথা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, ব্যবসা, বিয়ে, উত্তরাধিকার, যুদ্ধ ও ন্যায়বিচারের নীতিগুলো তুলে ধরেছিলেন, যা আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক; যেমনটি ১৫০০ বছর আগেও ছিল। এই ভাষণে তিনি তাঁর অনুসারীদের জীবন, ন্যায়বিচার এবং দুর্বল ও নির্ভরশীলদের প্রতি সদয় আচরণে গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছিলেন। ব্যক্তি ও সামাজিক সমতার বিষয়ে তিনি বলেছিলেন: ‘হে মানুষ! তোমাদের প্রভু একজন এবং তোমাদের পূর্বপুরুষও একজন। শুনে রাখো, হে মানুষ! একজন আরবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই অ-আরবের ওপর; যেমন একজন অ-আরবেরও নেই আরবের ওপর। শ্বেতাঙ্গের কোনো প্রাধান্য নেই কৃষ্ণাঙ্গের ওপর এবং কৃষ্ণাঙ্গেরও নেই শ্বেতাঙ্গের ওপর; শুধু ব্যক্তিগত গুণাবলি বা নৈতিকতা, বুদ্ধিমত্তা এবং নিজস্ব প্রচেষ্টার মাধ্যমে যা অর্জিত হতে পারে তা ব্যতীত।’ (মুত্তাফিকুন আলাইহি) আজ আমরা আমাদের সমাজে ছোট-বড় উভয় ধরনের বৈষম্যের উদাহরণ দেখতে পাই। জাতি বা ধর্মের পার্থক্যের কারণে সারাবিশ্বে মানুষ প্রায়ই সহিংসতা ও সন্ত্রাসের শিকার হয়। আমাদের সবার সিদ্ধান্ত ও কর্মকাণ্ডে যদি নবী মুহাম্মদ (সা.) প্রদত্ত সমতার নীতিগুলো গ্রহণ করা হতো, তাহলে আজকের পৃথিবী কতটা ভিন্ন হতো!
নবী মুহাম্মদ (সা.) সবাইকে সদয়তা এবং কল্যাণ প্রদর্শনের উৎসাহ দিয়েছেন। তিনি মা-বাবা, সন্তান, জীবনসঙ্গী এবং তাদের পরিবারের প্রতি সদয় আচরণের শিক্ষা দিয়েছেন। বলেছেন, ‘বিশ্বাসীদের মধ্যে সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ ইমানদার সেই, যার চরিত্র সেরা এবং তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সেই, যে তার স্ত্রীদের প্রতি সবচেয়ে উত্তম আচরণ করে।’ তিনি প্রতিবেশীদের প্রতি সদয় আচরণ করার উৎসাহ দিয়ে বলেছেন, ‘আল্লাহ আমাকে প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্ব পালনের বিষয়ে এত বেশি এবং এতবার বলেছেন, আমি ভাবতে শুরু করেছিলাম হয়তো প্রতিবেশী উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত হতে পারেন।’ (মুসলিম)। তিনি শ্রমিকদের জন্য অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ছিলেন এবং বলেছেন, শ্রমিকের মজুরি তার ঘাম শুকানোর আগেই প্রাপ্যটা দিতে হবে। যুদ্ধবন্দিদেরও অধিকার দেওয়া হয়েছে।
রাসুল মুহাম্মদ (সা.) মূলত কোরআন ও সুন্নাহর ওপর ভিত্তি করে সমাজ কাঠামো প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে এর যথাযথ বাস্তবায়ন করেছেন। একটি হাদিস থেকে এর স্পষ্ট নির্দেশনা পাওয়া যায়। একবার কুরাইশ বংশীয় মাখজুম গোত্রের এক সম্ভ্রান্ত মহিলা চুরির অপরাধে ধরা পড়লে রাসুলুল্লাহ (সা.) তার হাত কর্তনের নির্দেশ দেন। আভিজাত্য ও বংশমর্যাদার উল্লেখ করে সে মহিলার শাস্তি লাঘবের জন্য রাসুলুল্লাহর (সা.) কাছে তাঁর একান্ত স্নেহভাজন উসামা ইবনে জায়েদ (রা.) সুপারিশ করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে বলেন, ‘তুমি কি আল্লাহর দণ্ডবিধির ব্যাপারে সুপারিশ করছ?’ অতঃপর লোকজনকে আহ্বান করে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! নিশ্চয়ই তোমাদের পূর্ববর্তী জনগণ পথভ্রষ্ট হয়েছে এ জন্য যে, তাদের কোনো সম্মানিত লোক চুরি করলে তখন তারা তাকে রেহাই দিত। আর যখন কোনো দুর্বল লোক চুরি করত তখন তারা তার ওপর শাস্তি প্রয়োগ করত। আল্লাহর কসম! মুহাম্মদের কন্যা ফাতিমাও যদি চুরি করে, তবে অবশ্যই তার হস্ত কর্তন করে দিতাম।’ (বুখারি ও মুসলিম) সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠা ও সামাজিক আইন বাস্তবায়নে তাঁর এ দৃঢ়তা মানুষের প্রতি রাসুলের (সা.) ভালোবাসা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আজকের সমাজকে সঠিক পথে আনার জন্য রাসুলের (সা.) শিক্ষা অনুসরণ করা সর্বত্র প্রয়োজন।