সব ধরনের প্রতিকার আন্দোলনেই সম্ভব
Share on:
নির্বাচন যদি সুষ্ঠু না হয় তাহলে তা সে-ত্রুটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সরাসরি আঘাত করে তাকে দুর্বল করে দেয়। জবাবদিহির দায় সংকুচিত হয়ে আসে। সবচেয়ে বড় কথা, জনজীবনে হতাশা ও পরাজিতের মনোভাব দেখা দেয়।
যুদ্ধ করে বাংলাদেশের যে মানুষেরা সর্বপ্রকার মারণাস্ত্রে সজ্জিত ও সর্বাধিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হানাদার বাহিনীকে হারিয়ে দিল; যুদ্ধ শেষে নিজ দেশে তারা যদি নিজেদের শাসকদের কাছে হেরে গেছে বলে ধরে নেয়, তবে তাদের পক্ষে দারিদ্র্য, পরিবেশ ও বিশ্বব্যবস্থার বৈরিতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সম্ভব হবে, এমন ভরসা থাকে কি? একটির পর আরেকটি জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণের পরাজয়ের ঘটনা ঘটেছে। আর নদীর পানিতে যদি দূষণ দেখা দেয় তবে তার শাখা-প্রশাখাতে ছড়িয়ে না পড়ে পারে না। জাতীয় নির্বাচনের প্রভাব অন্যসব নির্বাচনেও গিয়ে পড়েছিল বৈ কি।
এমনকি আঠাশ বছর পরে অনুষ্ঠিত ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচনও খুব বড় রকমের একটা ঝাপটা খেয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের ধারাপ্রবাহের বাইরে এই নির্বাচন যেতে পারেনি। ডাকসু নির্বাচনে শিক্ষকরাই তত্ত্বাবধানে ছিলেন। তারা সকল শিক্ষার্থীরই অভিভাবক। কিন্তু এই তত্ত্বাবধায়করা অভিভাবকত্বের দায়িত্ব পালন করেননি। বিগত সরকারের সমর্থক ও সরকার কর্তৃক সমর্থিত ছাত্রলীগের বাইরে সকল শিক্ষার্থীরই দাবি ছিল ছাত্রলীগ কর্তৃক পরিপূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রিত আবাসিক হলের পরিবর্তে একাডেমিক ভবনে ভোটের ব্যবস্থা করা; ভোটদানের সময় ছয় ঘণ্টার মধ্যে সীমিত না রেখে প্রসারিত করা; স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স বন্দোবস্তের মতো যুক্তিসংগত কোনো দাবিই মানা হয়নি। ফল দাঁড়িয়েছে এই যে, বহু ছাত্রছাত্রী ভোট দিতে পারেনি। ওদিকে আবার জাতীয় নির্বাচনের ধারাতেই কারচুপির চেষ্টা বিলক্ষণ ঘটেছিল। শিক্ষকদেরই কেউ কেউ ব্যবস্থা করেছিলেন। তারা ব্যর্থ হয়েছেন, বিশেষভাবে ছাত্রীদের প্রতিরোধের মুখে। মেয়েদের এই যে সাহসী ও অগ্রগামী ভূমিকা, তাতে অল্পকিছু হলেও ভরসার কারণ রয়েছে। তারা নিষেধ মানেনি, ছাত্রলীগ ও প্রশাসনের ভ্রূকুটি অমান্য করেছিল; যদিও তারা হত্যার শিকার হয়নি ঠিকই, কিন্তু তাদের ওপর যথারীতি হামলা হয়েছে, মামলা দেওয়াও বাদ থাকেনি। তারা বিপদের ঝুঁকিতেই ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দলীয় প্রতিষ্ঠান নয়, জাতীয় প্রতিষ্ঠান বটে। এর গৌরব মলিন হলে সারাদেশ ব্যথিত হয়, লজ্জা পায়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ পূর্ণ করেছে; হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও শিক্ষক এখান থেকে বের হয়ে গেছেন; তাদের সবার কাছেই এই বিশ্ববিদ্যালয় গৌরবের বস্তু। এর ঐতিহ্যকে মলিন করার ব্যাপারে দেশবাসীর সঙ্গে এদেরও নীরব অনুরোধ আছে। সরকারি আনুকূল্যে সাময়িকভাবে যারা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছিলেন তাদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত বড় হতাশার কারণ।
ছাত্র-জনতার যে অভ্যুত্থান ওই সরকারকে বিদায় নিতে বাধ্য করল, তার ক্ষেত্রটা কিন্তু নানাভাবে প্রস্তুত হয়েছে। ক্ষেত্রগুলোর সবচেয়ে বড়টি হচ্ছে মানুষের ক্ষোভ। দেশের প্রায় সব মানুষই ছিল বিক্ষুব্ধ, কিন্তু তাদের ক্ষোভ প্রকাশের কোনো গণতান্ত্রিক পথ খোলা ছিল না। নির্বাচন ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে দেওয়া হয়েছিল। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ছিল সংকুচিত। রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা সর্বক্ষণ ভয় দেখাত। আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের সেই পঙক্তি, ‘তোমরা ভয় দেখিয়ে করছ শাসন, জয় দেখিয়ে নয়’ কিছুতেই মিথ্যা প্রমাণিত ছিল না। লোকে সন্ত্রস্ত; মুখ খুলতে ভয় পেয়েছে। অথচ তাদের অনেক কথা আছে বলবার। স্টিম জমে উঠছিল, ভেতরে ভেতরে। ওদিকে দুর্নীতি সর্বত্রগামী। ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ হতো না। পুলিশ আসছে শুনলে লোকে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে মারা যেত। কৃষক তার সর্বশক্তি প্রয়োগ করে কৃষিপণ্য উৎপাদন করে, কিন্তু ন্যায্যমূল্য পায় না। গার্মেন্টস শ্রমিকরা বাঁচার মতো মজুরি চাইলে মালিকের পক্ষ নেওয়া পুলিশ ও মালিক নিয়োজিত মাস্তানরা তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেই; আবার সরকারি হাসপাতালেই সরকারি চিকিৎসকরা প্রাইভেট প্র্যাকটিসের চেম্বার খোলার অনুমতি পেয়েছেন। রাস্তায় বের হলে গাড়িচাপা পড়ে মরতে হয়েছে। আদালতের বিচারও পণ্যে পরিণত হয়েছিল।
এ পরিস্থিতিতে মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার কাজটা বামপন্থিরা করতে পারেনি। অত্যন্ত হতাশ ও চরমভাবে অসহায় মানুষ আশ্রয় খুঁজেছে ধর্মের কাছে। ভেবেছে, ইহকালে ন্যায়বিচার পাওয়া গেল না, পরকালে পাওয়া যাবে। সবকিছু মিলে মানুষ নিজেদের অজান্তেই দক্ষিণপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। সুবিধা হয়েছে ধর্মকে নিজেদের নোংরা ইহজাগতিক স্বার্থে যারা ব্যবহার করে তাদের। উস্কানি আসছে বিদেশের ধনী দেশগুলো থেকেও। তারা কেবল যে উগ্র ইসলাম-ভীতি প্রচার করছে, তাই নয়; মুসলমানদের বিরুদ্ধে নানা ধরন ও মাত্রার ক্রুসেড ঘোষণা করে বসে আছে। যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়ে লাখ লাখ মানুষকে উদ্বাস্তু করছে, আবার উদ্বাস্তুরা যখন শরণার্থী হয়ে ইউরোপ-আমেরিকায় আশ্রয় খুঁজতে বাধ্য হচ্ছে তখন তাদের প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করছে। যারা প্রবেশ করছে তাদের হেনস্তা করছে। শান্তি ও শান্তিপ্রিয় বলে পরিচিত ছিল নিউজিল্যান্ড। সেখানেও মুসলিমবিদ্বেষী এক ক্রুসেডার জুমার নামাজের সময় মসজিদে ঢুকে গুলি চালিয়ে ৫০ জনকে হত্যা করেছে। এসবের প্রতিক্রিয়া হবে; বিশ্বব্যাপী জিহাদি তৎপরতা বাড়তে সাহায্য করবে। ভারতীয় সরকারের উগ্র-হিন্দুত্ববাদী আচরণ যে বাংলাদেশের মৌলবাদীদের সাহায্য করছে না– এমনটা ভাববার কোনো কারণ নেই।
বিগত সরকার কর্তৃত্ব পেয়ে এবং সে কর্তৃত্বকে দীর্ঘস্থায়ী করার লক্ষ্যে যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছে তার মধ্যে একটি হলো হেফাজতে ইসলামকে নানা রকমের ছাড় দেওয়া। কতগুলো ছাড় তো অবিশ্বাস্য, প্রায় অকল্পনীয়। এখনও যদি তা অব্যাহত থাকে তাহলে বিশেষ রকমের বিপদ ঘটবে মেয়েদের। হেফাজতিরা নারীমুক্তি পরের কথা, নারী শিক্ষাতেই বিশ্বাস করে না। সমাজে তারা যে আগুনটা জ্বালাতে চাইবে সেটা কেবল প্রগতিপন্থি মানুষকে পুড়িয়ে মেরেই ক্ষান্ত হবে না, সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে, সকল মানুষকেই দগ্ধ করবে এবং কোনো দমকলেরই সাধ্য থাকবে না তাকে নির্বাপিত করার।
গণবিরোধী শক্তির হাত থেকে মুক্তির উপায় যে রুখে দাঁড়ানো, তা আবারও প্রমাণিত হলো। সেটি একাকী বা কয়েকজন মিলে করার কোনো উপায় নেই। প্রতিরোধটা হওয়া চাই সুবিস্তৃত, সংঘবদ্ধ, ধারাবাহিক এবং সুস্পষ্ট লক্ষ্যাভিসারী। লক্ষ্যটা কী? লক্ষ্যটা হলো গোটা ব্যবস্থাকে বদলানো। ব্যবস্থাটা যে কেবল আমাদের দেশে চালু রয়েছে, তা তো নয়; এটা এখন পৃথিবীব্যাপী বিস্তৃত। বাইরের জবরদস্তকারীরা দেশের জবরদস্তকারীদের নানাভাবে সাহায্য করছে, সমর্থন জোগাচ্ছে। প্রতিরোধ প্রয়োজন তা যেমন দেশে, তেমনি একই সঙ্গে আন্তর্জাতিকভাবে।