মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: বুধবার ২১, অগাস্ট ২০২৪

স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও চিকিৎসাকর্মীদের ওপর হামলা কেন?

Share on:

সংঘাত-সহিংসতায় খার্তুম যেভাবে ধ্বংস হয়েছে, তাতে নিরাপত্তার জন্য অনেক সুদানিই পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। যুদ্ধের প্রভাবে সুদানের রাজধানী খার্তুমের স্বাস্থ্যসেবা ভেঙে পড়ায় অনেক পরিবার জরুরি ভিত্তিতে চলে যেতে বাধ্য হয়।


২০২৩ সালে খার্তুমের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে হামলার ফলে রাজধানীজুড়ে ওষুধের সংকট তৈরি হয়। তার মানে, অত্যন্ত পীড়িত সুদানিরাও তাদের জরুরি ওষুধ খুঁজে পায়নি। স্বাস্থ্যসেবা যে অত্যাবশ্যকীয়, তা আক্রান্ত হলে সুদানের যে পরিণতি, অন্যত্র লাখ লাখ মানুষের জন্যও এটাই বাস্তবতা।

ফিলিস্তিনের গাজায় হাসপাতালগুলোতে দফায় দফায় হামলা চালানো হয়েছে। সেখানে শতাধিক মানুষ নিহত ও আহত হয়েছে। এর মধ্যে স্বাস্থ্যকর্মী ও বাস্তুচ্যুত মানুষও ছিল, যারা নিরাপদ মনে করে সেখানে আশ্রয় নিয়েছিল। আফ্রিকার দেশ কঙ্গোর ডোমা শহরে বাস্তুচ্যুত মানুষদের চিকিৎসা দেওয়ার সময় চিকিৎসক ও নার্সদের হত্যা করা হয়েছে। ইউক্রেনে প্লেন থেকে আক্রমণে কিয়েভের ওখমাদিত হাসপাতালকে নিশানা করা হয়। আক্রমণে এক চিকিৎসক ও একজন হাসপাতাল কর্মী প্রাণ হারান এবং ১৬ জন আহত হয়। এর মধ্যে সাতজনই শিশু। পাকিস্তানে বোমা হামলায় এমন পুলিশ কর্মকর্তারা প্রাণ হারান, যারা পোলিও টিকা দেওয়া কর্মীদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিলেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান হিসেবে আমি বরাবরই এ ধরনের হামলায় নিন্দা জানিয়ে এসেছি। একই সঙ্গে মানবিক সহায়তায় নিয়োজিত কিংবা এর বাইরেও অন্যত্র দায়িত্ব পালনকারী স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা ও তাদের প্রতি সম্মান দেখানোর আহ্বান জানিয়েছি। বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যসেবা দানকারী আমাদের অংশীদার মানবিক সংস্থাগুলোও একই আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু আমার দাবি সেভাবে প্রতিপালন করা হয়নি। যদিও যুদ্ধ-সংঘাতে হাসপাতালসহ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান, তাদের কর্মী, রোগী ও অন্যান্য জনবলের সুরক্ষার বিষয়টি আন্তর্জাতিক আইনেই বলা আছে।

২০২৩ সালে কেবল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাই ১ হাজার ৫২০টি হামলার ঘটনা রেকর্ড করেছে, যেখানে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে হামলায় অন্তত ৭৫০ জন রোগী ও স্বাস্থ্যকর্মীর প্রাণহানি ঘটেছে এবং ১ হাজার ২৫০ জন আহত হয়েছে। চলতি বছর এখন পর্যন্ত সাত শতাধিক হামলার ঘটনা ঘটেছে। এই সংখ্যা ভয়াবহ। যদিও বাস্তবে সমস্যা কতটা ভয়াবহ, তা হয়তো এই সংখ্যা দ্বারা বোঝানো কঠিন। একটা হামলাই গুরুতর মানবিক সংকট সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট। অথচ দেখা গেছে, কোথাও কোথাও অল্প সময়ের ব্যবধানে অনেক আক্রমণ পরিচালনা করা হয়েছে। গাজায় যেমনটা দেখা গেছে। গত অক্টোবরে শুরু হওয়া গাজা সংঘাতে এখন পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক স্বাস্থ্যকর্মী প্রাণ হারিয়েছে। একই সঙ্গে ২৮৭ জন মানবিক সহায়তা কর্মী জীবন দিয়েছে। এর মধ্যে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের সহায়তায় নিয়োজিত জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএতে কর্মরত আমাদের অনেক সহকর্মী আছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য পরিবারের অন্তত একজন সদস্য ডিমা আলহাজ সেখানে প্রাণ হারিয়েছেন।

গাজার মতো ইউক্রেন, সুদান, কঙ্গো, হাইতি কিংবা এর বাইরেও যারা সংঘাতে প্রাণ হারায়, তারা শোকাহত পরিবার ও আত্মীয়স্বজন রেখে যায়। সংঘাতে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো মানবিক সহায়তা দানকারী ও স্বাস্থ্যকর্মীদের যেমন সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে, তেমনি স্বাস্থ্যকর্মীরা যে আক্রান্তদের সেবা করছে, তাদের সেবাদানও ব্যাহত হচ্ছে। এমনকি জনস্বাস্থ্যের জন্য স্পষ্ট হুমকি থাকা সত্ত্বেও সেখানে সেবা দিতে গিয়ে মানবিক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা ব্যাপকভাবে আক্রমণের শিকার হয় ও মানসিকভাবে ভীত হয়ে পড়ে।

১৯ আগস্ট যখন বিশ্ব মানবিক দিবস পালন করছি, এ দিবসে আমরা মানবিক সহায়তাকর্মীদের ওপর হামলা তীব্র হওয়া এবং এ ধরনের ঘটনাকে স্বাভাবিকীকরণের পদক্ষেপের প্রতিবাদ জানাই। দিবসটিতে আমি স্বাস্থ্যকর্মীসহ মানবিক সহায়তাকর্মীদের ওপর সব ধরনের সহিংসতা, হুমকি ও হামলার নিন্দা জানাই। হাসপাতালসহ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের ওপর আক্রমণের ফলে স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজ ব্যাহত হয়, স্বাস্থ্যসেবা সামগ্রী বিতরণে বিঘ্ন ঘটে এবং স্বাস্থ্য সুবিধার প্রয়োজনীয় পরিষেবা যেমন– টিকা, প্রসবপূর্ব যত্ন এবং জটিল রোগের চিকিৎসায় ব্যাঘাত ঘটে। কোনো জনপদে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া একমাত্র হাসপাতালের ওপর একক আক্রমণও কমিউনিটির সব মানুষের স্বাস্থ্যসেবা ধ্বংস করে দিতে পারে এবং এর পরিণতিতে কয়েক বছরের জন্যও তাদের ভুগতে হতে পারে। অনেক জায়গায় স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু চিকিৎসাই দিচ্ছে না, বরং তাদের আশ্রয় ও কল্যাণেও অবদান রাখে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংবিধান বলছে, ‘স্বাস্থ্যই সকল মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তার মূল এবং ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় সহায়তার মাধ্যমেই কেবল এটি নিশ্চিত হতে পারে।’ আমাদের সহকর্মী যারা মানবিক সংকটাপন্ন পরিবেশে কাজ করে, তারা কতটা মূল্যবান, তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভালো করেই জানে। সশস্ত্র সংঘাতে অকারণে যখন আমরা তাদের হারিয়ে ফেলি, সে বেদনাও আমরা অনুভব করি। মানবিক কাজে তাদের প্রেষণা লাখ লাখ মানুষের জীবনে বড় প্রভাব ফেলতে সক্ষম।

দৈনিক সমকাল