সবার নজর গুজবের ‘বেগমপাড়ায়’
Share on:
কানাডার টরন্টো একটি কসমোপলিটন শহর। এখানে বসবাস পৃথিবীর প্রায় সব দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের। তবে এ শহরের বিশেষ কিছু স্থানে কোনো দেশের অভিবাসীদের বসবাস একটু বেশি দৃশ্যমান। এমন একটি ছোট শহরের নাম মিসিসাগা।
টরন্টোর পাশ ঘেঁষে লেক অন্টারিওর তীরের এ শহরে অনেকের মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, মধ্যপ্রাচ্যসহ দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কিছু দেশের অভিবাসীর বসবাস। এক যুগ আগে হঠাৎ মিসিসাগা শহরের বড় কয়েকটি বহুতল ভবন কানাডার মূলধারার সংবাদমাধ্যমের নজর কাড়ে। সেই ভবনে মূলত থাকত দক্ষিণ এশিয়া থেকে যাওয়া কিছু অভিবাসী পরিবার। এসব পরিবারের স্বামী কাজ করতেন আরবের বিভিন্ন দেশে।
আরব দেশে উচ্চ বেতনে কাজ করা ভারত, বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের বেশ কিছু ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার এবং অন্যান্য পেশার মানুষ একসময় পরিবার নিয়ে কানাডায় চলে এসেছিলেন অভিবাসী হয়ে। কিন্তু তাদের অনেকেই কানাডাতে কাঙ্ক্ষিত চাকরি খুঁজে পাননি। তারা ফিরে যান আরব দেশে আগের চাকরিতে। তবে পরিবার রেখে যান কানাডাতে। অর্থাৎ এসব পরিবারের প্রায় সব স্বামীই থাকতেন আরব দুনিয়ায়; স্ত্রী-সন্তানরা থাকতেন কানাডায়।
এ নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি করেছিলেন ভারতীয় পরিচালক রশ্মি লাম্বা। ফিল্মটির নাম দিয়েছিলেন ‘বেগমপুরা: দ্য ওয়াইভস কলোনি’। সেখানে দেখা যায়, মিসিসাগা শহরের এক এলাকায় কিছু কন্ডোমিনিয়ামে স্বামীর অনুপস্থিতে বেগম বা স্ত্রীরা একা হাতে পরিবারের দায়িত্ব সামলান। ইন্টারনেট দুনিয়ায় ‘বেগমপুরা: দ্য ওয়াইভস কলোনি’ বিদ্যমান। যে কেউ আঙুল টিপে তা দেখে নিতে পারেন।
সেই সিনেমার সূত্র ধরেই কানাডার পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে বিভিন্ন প্রতিবেদন। সেসব প্রতিবেদনে পাকিস্তান, ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় বাংলাদেশের নামও। কিন্তু বাংলাদেশে এ কাহিনি বর্ণিত হয় অন্যভাবে।
রশ্মি লাম্বার ‘বেগমপুরা’ বাংলাদেশে একসময় হয়ে যায় ‘বেগমপাড়া’। মিসিসাগার জায়গায় হয়ে যায় টরন্টোর ‘নর্থ ইয়র্ক’। নর্থ ইয়র্কে তখন কয়েকজন বাংলাদেশি ব্যবসায়ী বাড়ি কিনেছিলেন। সম্ভবত সেই সূত্র ধরে সিনেমাটির মূল বিষয়বস্তুকে পাশ কাটিয়ে বাংলাদেশে হইচই পড়ে যায় কানাডার ‘বেগমপাড়া’ নিয়ে। সিনেমার বেগমপুরার বেগমদের স্বামী আরব দুনিয়ায় কঠোর পরিশ্রম করা পেশাজীবী হলেও কথিত বাংলাদেশের বেগমদের স্বামী প্রচলিত গল্প অনুযায়ী অসাধু-ধনাঢ্য আমলা-ব্যবসায়ী-রাজনীতিবিদ। তারপরও ‘বেগমপাড়া’ অর্থ দাঁড়ায় একটাই– বাংলাদেশের দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী-আমলা-রাজনীতিবিদদের সেখানে দ্বিতীয় ভুবন গড়ে তোলা।
সর্বোপরি, বাস্তবে কানাডার টরন্টো শহরে বেগমপাড়া বলে নির্দিষ্ট কোনো এলাকা নেই। তারপরও বায়বীয় এই বেগমপাড়া নিয়ে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতে কথা হয়েছে; জাতীয় সংসদে বিতর্ক হয়েছে। বাংলাদেশ দূতাবাসের হয়তো আধঘণ্টাও লাগার কথা নয় এটা বের করতে– সত্যি সত্যি বেগমপাড়া বলে টরন্টোর নর্থ ইয়র্কে কিছু আছে কিনা। তারপরও সরকার বেগমপাড়ার অস্তিত্ব নিয়ে খোঁজ নেয়নি কখনও।
বলা যায়, চিলে কান নিয়েছে বলে পুরো দেশ হইচই করলেও কেউ কানে হাত দিয়ে দেখেনি– কানটা জায়গামতো আছে কিনা। গুজবের শক্তি এতই বড় যে, তা নিয়ে হইচই এখনও আছে। অর্থ পাচার কিংবা দুর্নীতির কথা বাংলাদেশে উঠলেই লোকজন কানাডার বেগমপাড়ার উদাহরণ টানে।
জোসেফ গোয়েবলস যথার্থ বলেছিলেন– একই মিথ্যা বারবার বললে একসময় তা সত্যি হয়ে যায়। বাংলাদেশের সংসদ, উচ্চ আদালত, সরকার, সংবাদমাধ্যম, জনগণ এত বছর ধরে বলে বলে টরন্টোর তথাকথিত বেগমপাড়াকে আলোচনার মধ্যমণি বানালেও বাস্তবে এমন বেগমপাড়ার অস্তিত্ব কানাডার টরন্টোতে বসবাসরত বাঙালিরাই খুঁজে পায়নি কখনও।