ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন ও জামায়াতের নয়া পয়গাম
Share on:
দুনিয়া দোলানো ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগসহ ধপাস-পতনে এক নতুন রাজনৈতিক মানচিত্র ফুটে উঠছে। এতে বিএনপি ও জামায়াতের পৃথক পথ এবং পাল্টাপাল্টি বক্তব্য মনোযোগ কেড়েছে।
‘এক জালিম বিদায় নিয়েছে, আরেক জালিম যেন না আসে’– জামায়াতের আমির শফিকুর রহমানের এমন বক্তব্যের জেরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সব দলকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী হতে হবে।
ইসলামী রাজনীতিবিদ বা আলেমদের একাংশ দিয়ে বলানো হচ্ছে– জামায়াতের নেতৃত্বে ইসলামী রাষ্ট্র গঠন হবে। বিএনপির ভবিষ্যতে সরকার গঠনের সম্ভাবনাকে তাদের কেউ কেউ নাকচ করে দিতে চান।
ভারত-নমনীয়তা
গণঅভ্যুত্থান-উত্তর পর্বে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে জামায়াতের ঘোষণা নতুন মাত্রা যোগ করেছে। দলটি সম্প্রতি ঢাকায় ভারতীয় মিডিয়ার প্রতিনিধিদের সঙ্গেও মতবিনিময় করেছে। ‘ক্ষমতায় গেলে’ কী কী করবে, সে আশ্বাস দিয়েছে। সম্প্রতি ভারতের মূলধারার সংবাদমাধ্যমে জামায়াতের আমিরের সাক্ষাৎকার নেওয়ার আগ্রহ বেড়ে গেছে। গত ২৭ আগস্ট ভারতীয় মিডিয়ার সঙ্গে আলাপে জামায়াতের আমির বলেন, ‘আমরা পরস্পর প্রতিবেশী। চাইলেই প্রতিবেশী বদল করা যায় না। এটা আমরা তো বটেই, কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।’ অতীতে ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের সুসম্পর্ক ছিল দাবি করে তিনি বলেন, ‘গত সাড়ে ১৫ বছরে শেখ হাসিনার শাসনামলে এটি শীতল ছিল। তবে আমাদের প্রত্যাশা, এখন সম্পর্ক বাড়বে। আশা করি, ভারতও ইতিবাচক থাকবে।’ (মানবজমিন, ২৮ আগস্ট)
বাংলাদেশে গত কয়েক মাসে ভারতের পণ্য ও কর্মী বর্জনের তীব্র আন্দোলন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ভারত বিরোধিতা, সাম্প্রতিক বন্যার জন্য ভারতকে দোষারোপ, শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ায় ভারতের প্রতি ক্ষোভের মধ্যে জামায়াতের আকস্মিক ভারত-নমনীয়তা কেন? ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা বিএনপিরও ছিল এবং আছে। কিন্তু জামায়াত কেন হঠাৎ ভারতের দিকে ঝুঁকছে? সম্প্রতি ঘটে যাওয়া দুনিয়া দোলানো ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে যেসব রাজনৈতিক সত্য জনগণের অভিপ্রায় হিসেবে প্রকাশ পেয়েছে তা হলো, বাংলাদেশে ভারতের নাক গলানো বন্ধ করতে হবে। বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের মূল পৃষ্ঠপোষক ছিল ভারত। কিন্তু সেই চেতনার এই অবস্থায় জামায়াতের এমন অবস্থান কেন?
রাজনৈতিক ‘উদারতা’
১৯৮৬ সালে এরশাদের অধীনে জামায়াতে ইসলামী ভোটে গেছে। জামায়াতে ইসলামী ১৯৯১ সালে বিএনপিকে সমর্থন দিলেও ১৯৯৩ সাল থেকে কেয়ারকেটার সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুগপৎ থেকেছে। এ জন্য তখন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনের পরও ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে একাত্তরের ভূমিকার জন্য জামায়াত নেতাদের বিচার করেনি। কিন্তু ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসেই মানবতাবিরোধী অপরাধের ত্রুটিপূর্ণ বিচার করে জামায়াতের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন নেতার ফাঁসি দিয়েছে।
আওয়ামী লীগ শাসনামলে বিএনপির মতো জামায়াতেরও বহু কর্মী খুন, গুম হয়েছেন। মিথ্যা মামলায় জেল খেটেছেন স্বয়ং আমিরও। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে থেকে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দলটি জোর আন্দোলন করেছে। খালেদা জিয়ার উদার গণতান্ত্রিক মনোভাব এবং জাতীয় ঐক্যমনস্কতার জন্য ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে বিএনপি ঐক্য চেয়ে এসেছিল। জামায়াতসহ সব ইসলামী দল নিয়ে গণতন্ত্র মঞ্চ ও বাম দলগুলোর অ্যালার্জি ছিল; ৫ আগস্ট একত্রে রাষ্ট্রপতি ও সেনাপ্রধানের দপ্তরে যাওয়ার মধ্যেই সব অ্যালার্জির যেন অবসান ঘটে। বামপন্থিরা আর জামায়াতকে দুষছে না। কারণ কী?
জামায়াতের সঙ্গে কওমি আলেমদের দৃশ্যত বিরোধ রয়েছে। গত ১৮ আগস্ট ঢাকার কয়েকজন কওমি আলেমের সঙ্গে বৈঠকে জামায়াতের আমির বলেন, এখন থেকে তারা পরস্পরের জন্য। অতীতের কোনো আচরণের জন্য কেউ কষ্ট পেয়ে থাকলে ক্ষমা চান তিনি।
এক কিতাব দুই মোলাকাত
জামায়াতে ইসলামী দীর্ঘ নির্যাতনের মুখেও তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে গেছে। প্রতি সপ্তাহে দলটির নেতাকর্মীকে জানাতে হয়, কয়টি বই পড়েছেন আর কতজনকে বন্ধু করা গেছে। জামায়াত কর্মীদের মধ্যে একটি কথা প্রচলিত– এক কিতাব, দুই মোলাকাত। অর্থাৎ একটি বই পড়া হয়েছে আর নতুন দু’জনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে। এক নেতার দাবি, তাদের রুকনের সংখ্যা চার লাখের মতো। সেদিন বেশি দূরে নেই, তারা এককভাবে ক্ষমতায় যাবে। জামায়াতের পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাংক, বীমাসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি ও তাদের নেতাকর্মী-সমর্থকদের কর্মসংস্থান হওয়ায় রাজপথে আন্দোলনের অতীত তেজ কমে গেছে। অবশ্য ইসলামী ছাত্রশিবিরের ধারাবাহিক সদস্য সংগ্রহে কিছুটা পুষিয়ে নিয়েছে। প্রশাসনের সর্বত্র তাদের লোক। প্রায় সব ইসলামী দল এবং বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলে ছদ্মবেশে তাদের নেতাকর্মী আছে। আগে যেসব ইসলামী দল জামায়াত থেকে দূরে থাকত, তারাও জামায়াতকে কাণ্ডারি মনে করছে। যেসব কথা জামায়াত বলে না, তা অন্য দলগুলোকে দিয়ে বলায়। জামায়াতকে এখন ইসলামী দলগুলোর কাণ্ডারি হিসেবে দেখানো সেই তৎপরতার ফসল। কিন্তু বৃহত্তর আলেম সমাজ ও অন্যান্য ইসলামী দল জামায়াতকে বাদ দিয়ে চলার পক্ষে।
তোপখানা রোড থেকে মতিঝিল পর্যন্ত রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় এলাকায় জামায়াতের পদে নেই এমন রুকনরা দারুণ সক্রিয়। তারা ঘুরে ঘুরে জনবয়ান তৈরির চেষ্টা করেন; অন্য সব দলের সভা-সেমিনারে উপস্থিত থেকে তথ্য নেন। মিডিয়া ও পেশাজীবী সংগঠনগুলোতে তাদের সরব ও পৃথক উপস্থিতি আছে। প্রেস ক্লাব ও ডিআরইউতে গেলে বোঝা যায়। বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতৃত্ব তাদের হাতে। এদের মধ্যে ওই মতের মূলধারার দক্ষ সাংবাদিকরা ক্রমেই কোণঠাসা হচ্ছেন। মূলত বিএনপি সমর্থিত সাংবাদিকদের কাঁধে চেপেই তারা এ অবস্থানে এসেছেন। এখন বিএনপি সমর্থিতরা কী করবেন?
বিএনপির অবস্থান
কয়েক বছর আগের ঘটনা। আন্দোলন চলছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি ও পেশাজীবীদের সঙ্গে এক দিন স্কাইপে মতবিনিময় করছেন। বিষয়, আন্দোলন ও ভবিষ্যতের রাজনীতি। এক পর্যায়ে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে গুঞ্জন উঠল। কেউই পরিষ্কার করে বলছে না। আমি তখন ভাইস চেয়ারম্যান। বললাম, জামায়াত আমাদের আন্দোলনের মিত্র। কিন্তু এ দল সম্পর্কে বিএনপির চিন্তা করতে হবে। তারা একসময় বিএনপির প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াবে।
‘তোমাকে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে’– এ কথাটি সেদিন স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম। অবশ্য তারেক রহমান আগাগোড়াই পার্থক্য রচনা করে চলছিলেন। ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের একীভূত আন্দোলনের প্রস্তাব তিনি ঝুলিয়ে রেখেছেন। যদিও ২০১৮ সালের নির্বাচনে জামায়াতকে ২২টি আসনে নমিনেশন দিয়ে সমালোচিত হয়েছিলেন। এরপর বিএনপি ২০ দলীয় জোটকে অকার্যকর করে জামায়াতকে দূরে সরিয়ে রেখেছে।
অস্বীকারের উপায় নেই, পতনের আগে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টিও জামায়াতকে অগ্রবর্তিতা দিয়েছে। মানতে হবে, এই অভ্যুত্থানে বিএনপির নেতাকর্মীর জানবাজি অংশগ্রহণের পাশাপাশি জামায়াত কর্মীদের তৎপরতা ছিল লক্ষণীয়। কিন্তু রাজনৈতিক কর্মীদের মৃত্যুর হিসাবে বিএনপি এক নম্বরে।
অন্তর্বর্তী সরকার
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ‘অরাজনৈতিক’ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশাসনিক নিয়োগ নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে নীরব ঠেলাঠেলি চলছে। বিএনপির গুলশান অফিস থেকে আমলাদের এক ধরনের তালিকা যাচ্ছে। আবার জামায়াতের মগবাজার কার্যালয়ও বসে নেই। এই দোলাচলে কিছুটা বিব্রত সরকার। আমলা, উপাচার্য প্রমুখ নিয়োগে দলনিরপেক্ষতা দেখা হচ্ছে। এ আলোচনাও কান এড়িয়ে যাচ্ছে না যে, কোন উপদেষ্টার কী ব্যাকগ্রাউন্ড। ধর্মবিষয়ক উপদেষ্টা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার যথেষ্ট সতর্কতা দেখিয়েছে। প্রথম প্রথম বিএনপি দ্রুত নির্বাচন চাইলেও জামায়াত বর্তমান সরকারকে সময় দিয়ে যৌক্তিক সময়ে ভোট করার কথা বলেছে। পরে বিএনপি সে পথে গেছে। সামনের দিনগুলোতে বিএনপি ও জামায়াতের আলাদা এবং প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান আরও স্পষ্ট হবে।
বিএনপির একজন নীতিনির্ধারকের মতে, জামায়াতে ইসলামীর নবউত্থান সম্পর্কে বিএনপি ওয়াকিবহাল, কিন্তু মোটেও বিচলিত নয়। জামায়াতের ভোট কয়েক শতাংশ। বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের ওপর ভর করে তারা এ পর্যায়ে এসেছে। স্বকীয় শক্তি আছে, তবে তা সরকার গঠনের ধারেকাছে নয়। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান গত ৩০ আগস্ট ভারতীয় এক গণমাধ্যমের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, জামায়াত সম্পর্কে ভারতের একটি ভ্রান্ত ধারণা আছে। তাদের ভোট বড়জোর ৫ থেকে ৮ শতাংশ। জামায়াতের সঙ্গে আর জোট করার কথা বিএনপি ভাবছে না।
সর্বশেষ
এদিকে ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়ালকে এক সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আমাদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে জামায়াতের আগ্রহ নজরে এসেছে এবং আমরা আশাবাদী, এ নিয়ে আরও আলাপ-আলোচনা করব। মঙ্গলবার জামায়াতের আরেক সাংবাদিক বৈঠকে আওয়ামী লীগকে ক্ষমা করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে।