স্বৈরাচার শেখ হাসিনার দাম্ভিকতা দেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে রেখে গেছে
Share on:
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করার পর ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করাসহ ৩৫টি ছাত্র সংগঠনের নেতারা ১৫ আগস্টকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন না করা এবং ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে গণহত্যাকারী পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের ফাঁসির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করছেন।
এমন অবস্থায় হাসিনা দিল্লিতে বসে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিভিন্ন বিভ্রান্তিকর বার্তা দিতে থাকেন, যা অনলাইনে ভাইরাল হয়েছে। বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ মন্তব্য করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘আপনি আর কোনো বার্তা দিয়েন না আপা, আপনি নিজ পরিবার ছাড়া কাউকে ভালোবাসেন না। আপনার দম্ভ, জিদ, অহঙ্কার বাংলাদেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে রেখে গেছে। আপনি আমাদের মৃত্যুকূপের মধ্যে ফেলে দিয়ে গেছেন। আপনি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে দিয়ে গেছেন। আপনার কান্না এখন ‘কুমিরের কান্না’ লাগে। আপনাকে বিশ্বাস করি না। আর কথা বইলেন না, ক্ষমা প্রার্থনা করেন। আর খেলবেন না।’
যুগে যুগে দাম্ভিকতার ঔদ্ধত্যের অনিবার্য পরিণতি যা হয় শেখ হাসিনারও তা-ই হয়েছে। কেবল ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে উড়োজাহাজে দেশ ছেড়ে বেঁচেছেন তিনি। গোটা দল, দলটির নেতাকর্মী এবং তার এতদিনের সহযোগীদের নিয়ে যাননি, নেয়ার দরকার মনে করেননি। তাই বাদবাকিদের ‘হিজ হিজ হুজ হুজ’ অবস্থা। মানে যে যেভাবে যে পথে পারে পালাবে। অনেকে সফল হয়েছে। সালমান রহমান-আনিসুল হকরা লুঙ্গি পরে বেশভূষা বদলে স্থলপথ-জলপথ মিলিয়ে পালাতে গিয়ে নৌকায় ধরা খেয়েছেন। বেশ কৌতুক বিনোদনের খোরাক দিয়েছেন তারা। নৌকার লোক নৌকাতেই ধরা। তার ওপর বুজুর্গ ছুরতের দরবেশ নামে পরিচিত সালমান রহমান দাড়িগোঁফ কামিয়ে ভিন্ন এক অবয়ব ধরেছিলেন। দড়ি দিয়ে দু’হাত কষে বেঁধে তাদের আইনের কাছে সোপর্দ করেছে নৌ-পুলিশ। কী একটা দৃশ্যপট এই পরাক্রমশালীদের।
এ দিকে শেখ হাসিনাসহ ৯ জনের নামে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। এটি এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিষয়। এর আগে শেখ হাসিনাসহ সাতজনের নামে প্রথম হত্যা মামলার সূত্রপাত হয়। মুদি দোকানি আবু সায়েদকে হত্যার অভিযোগে। প্রশ্ন হচ্ছে, ওবায়দুল কাদের, আনিসুল হক, সালমান রহমান, আসাদুজ্জামান কামাল, নানক, পলক, শামীম ওসমান, বেনজীর, মামুন, হাবিব, হারুনরাই চালিয়েছেন হাসিনার রেজিম? এরা তো ফ্রন্টলাইনার মাত্র। বাকিরা কোথায়?
টানা ১৫-১৬ বছর গুম-খুন-অত্যাচার, ধর্মের নামে নিদারুণ ভণ্ডামি, কাউকে হত্যার পর চোখে গ্লিসারিন দিয়ে কাঁদা, ব্যাংকিং ও অর্থনৈতিক খাত গিলে খাওয়ার কাজগুলো হয়েছে পরিকল্পনামাফিক। রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্রসহ বিভিন্ন বিষয়ে শেখ হাসিনা সরকারের পদক্ষেপগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলার পথ রুদ্ধ করাও ছিল এ পরিকল্পনার মধ্যে। এই অ্যাজেন্ডার প্যাকেজ বাস্তবায়নে ব্যবসায়, আমলাতন্ত্র ও দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির সম্মিলিত চক্রের দাবায় শেষ দিকে চালে গোলমাল ঘটায় রাজা উল্টে যায়। আর সবাইকে ছেড়ে রাজা তার বোনকে নিয়ে সবার আগে চম্পট দেন। পরিবারের কিছু সদস্য আগে থেকেই চলে যান সেফ শেল্টারে। সালমান-আনিসসহ নেতা-মন্ত্রীদের ধরা পড়তে হচ্ছে নৌকায়, গুদারাঘাটে, অলিতে-গলিতে। বাকিদের লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে আড়ত-গুদামসহ নানা আজায়গা-বেজায়গায়।
এখন অবশ্যই জনগণকে অন্তত এতটুকু জানান দেয়া দরকার ২০০৯ সাল থেকে আইন, বিচার, প্রশাসন, পুলিশসহ বিভিন্ন পদে বিশেষ কিছু লোককে কেন পদায়ন-পদোন্নতি দিয়ে রাখা হয়েছিল। এ তালিকায় বিচারপতি থেকে শুরু করে সেনাপতি, পুলিশপতি, সচিব, গভর্নর, ব্যবসায়ীদের নাম প্রকাশ বর্তমান সরকার থেকেই করা যায়। আত্মীয়করণ-দলীয়কৃত প্রশাসনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছিল অবশ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের মাধ্যমে। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ক্ষমতায় আসার পর ২০১১ সালে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী বিলের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করা হয়। এর হোতা তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। ওই মহামান্য বা তার কাণ্ডকীর্তি কি বিচারের বাইরেই থেকে যাবে? তিনি স্বপদ থেকে পদত্যাগ করলেই সমাধান হয়ে যাবে? তিনি দেশের ১৯তম প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব নেন ২০১০ সালে। সাত মাস ১৮ দিনের দায়িত্বকালে যেসব রায় দিয়েছিলেন, তার মধ্যে এ রায়টিই পরের ১৪ বছরের শাসনব্যবস্থার গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করে দিয়েছিল।
শেখ হাসিনাকে ঘিরে রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট আইন, পুলিশ, প্রশাসন, ব্যবসায়, রাজনীতি, ঘাট-টার্মিনাল সব সেক্টরেই কায়েম হয়েছে। সেই সিন্ডিকেট সদস্যরা একদম অচেনা-অজানা-অদেখা নয়। আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবে দেখা হতো মেজর জেনারেল (অব:) তারিক আহমেদ সিদ্দিককে। ২০০৯ থেকে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টার দায়িত্বে থেকে সামরিক বাহিনীর যে সর্বনাশ শেখ হাসিনা পরিবারের এই সদস্য করেছেন, বাহিনীটি কতদিনে তা কাটিয়ে উঠতে পারবে অনুমানই করা যাচ্ছে না। ভিন্নমত সন্দেহে মেধাবী কত অফিসারের ক্যারিয়ার বরবাদ করে দিয়েছেন তিনি! কত গুমের ছক তার করা! ২০১৯ সালে আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে কিছুটা উঠে আসে তারিক আহমেদ সিদ্দিকের গুমকর্মের কথা। এ ছাড়া আলোচিত গোপন কারাগার ‘আয়না ঘর’ তৈরিতেও যারপরনাই ভূমিকা তার।
আয়না ঘরের নির্যাতনের ভুক্তভোগীদের অন্যতম লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব:) হাসিনুর রহমান (বীর প্রতীক)। গত ৬ আগস্ট তিনি নিজের একাধিকবার গুম হওয়ার ঘটনা তুলে ধরেন। আর এর মূল হোতা হিসেবে দায়ী করেন মেজর জেনারেল (অব:) তারিক আহমেদ সিদ্দিককে। এর বাইরে পুলিশ, সিভিল প্রশাসন, এমনকি নির্বাচন কমিশন পর্যন্ত ধ্বংস করাও ছিল আওয়ামী লীগের অ্যাজেন্ডা। আর সেই অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করার কাজে সেনাবাহিনীর একটি অংশকে আজিজ বাহিনীতে পরিণত করা হয়েছে। ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত আইজিপি শহীদুল হক বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের এক ধুমতাল তৈরি করেন। বেনজীর এতে আরো ছন্দ আনেন। তাকে বলা হতো বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘সবচেয়ে প্রভাবশালী আইজিপি’। র্যাবের ডিজি থাকাকালে ক্রসফায়ারে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী হত্যার বহু রেকর্ড আছে তার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বেসামরিক প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালনকারী পরস্পরের সহযোগীই ছিল। তাদের সম্মিলিত সমন্বয়েই চলেছে বিরোধী দলের কর্মী ও প্রার্থীদের গ্রেফতার, বিরোধীদের ওপর সরকারি দলের হামলা এবং নির্বাচনে প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষেত্রে দ্বৈতনীতিসহ অনেক কিছু। রকিব উদ্দিন থেকে হাবিবুল আউয়াল পর্যন্ত সবাই কমিশনে বসে একই কাজ করেছেন।
এভাবে পদে পদে, সেক্টরে সেক্টরে দানব তৈরির কাণ্ডারিরা এখন অনেকেই যথা পরিণতিতে দেশ ছাড়া। ইতিহাসের প্রয়োজনে এদের একটি শ্বেতপত্র দরকার। যেখানে অবশ্যই থাকবে শেখ হাসিনার পোষ্য কাছের-দূরের দানবদের কথা। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানবে দানবিক শাসন কায়েমের হোতা-পার্টনারদের সম্পর্কে। বর্তমান প্রজন্ম প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করে তো জেনেছেই।
দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের খাদক আবুল কালাম আজাদ ও আহমদ কায়কাউসকে চেনেন এ সেক্টরের সবাই। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব হিসেবে ২০১৫ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি নিয়োগ পান আবুল কালাম আজাদ। গাছের উপরেরটা খেয়ে তলারটাও খেতে পরে জামালপুর-৫ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে এমপি বনে যান তিনি। কায়কাউস ২০১৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর থেকে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব হিসেবে প্রশাসনে আধিপত্য বিস্তারের এক আনাও বাকি রাখেননি। ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ পদে থেকে অব্যাহতি নিয়ে পরে বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক পদে নিয়োগ বাগিয়ে নেন। এরপর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বিভিন্ন পদে দীর্ঘদিন থাকা সরকারের মুখ্য সচিব হিসেবে নিয়োগ পান তোফাজ্জল হোসেন মিয়া। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে মাঠ প্রশাসন ছারখারে ব্যাপক অবদান তার। তিনি মূলত প্রয়াত এইচ টি ইমামের পর মাঠ প্রশাসনে নতুন দানব হিসেবে আবির্ভূত হন। কোটা সংস্কার ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন চলাকালে শিক্ষার্থীদের ওপর দমন-পীড়ন ও হত্যাকাণ্ডে শেখ হাসিনার অন্যতম সহযোগী হিসেবে তিনি নীতিনির্ধারণী ভূমিকা পালন করেন।
পররাষ্ট্র সচিবের কেদারা থেকে মিজারুল কায়েস, শহীদুল হক, মাসুদ বিন মোমেনদের কাণ্ডকীর্তির খবরও আছে। ব্যবসায়-বাণিজ্যসহ গোটা অর্থ খাত ধ্বংসে সালমান এফ রহমান, পলাতক সাবেক গভর্নর ও অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদারসহ বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানের কয়েক হোমড়াচোমড়ার মাফিয়াতন্ত্র জেনেও না জানার মতো থাকতে হয়েছে।
আওয়ামী লীগের শাসনে দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে দলীয়করণ এবং রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন মরহুম হোসেন তৌফিক ইমাম (এইচ টি ইমাম)।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিপরিষদ সচিব এইচ টি ইমাম ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনপ্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা ও ২০১৪ সালে রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পান। তার তত্ত্বাবধানে কোনো রাখঢাক ছাড়াই প্রশাসনের ব্যাপক দলীয়করণ ঘটে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অধীন প্রতিষ্ঠান জাতীয় টেলিযোগাযোগ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র (এনটিএমসি) যাত্রা শুরু করে ২০১৩ সালের ৩১ জানুয়ারি। ২০১৭ সালের ৬ মার্চ থেকে মেজর জেনারেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) জিয়াউল আহসান এনটিএমসির মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময়ে তিনি সরকারের হয়ে নাগরিকদের ফোনকল ও ইন্টারনেটে বিভিন্ন যোগাযোগ অ্যাপে আড়িপাতা এবং ইন্টারনেট ব্যবস্থা ও ইন্টারনেট অপারেটর নিয়ন্ত্রণের কাজ করেন। এ সংস্থা থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে হেনস্তা, গ্রেফতার, গুম-খুনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হতো বিরোধীদলীয় মতকে।
প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে বিধি অনুযায়ী নিরপেক্ষ ভূমিকায় থাকার কথা থাকলেও উচ্চপর্যায়ের প্রশাসনে দলীয় কর্মীর মতোই ভূমিকা রেখেছেন তারা। ১৫ বছরের আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারব্যবস্থা স্বৈরতান্ত্রিক বা কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল মূলত দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার। ব্যাপক আকার পেয়ে দুর্নীতি, বাড়তে বাড়তে গোটা ব্যবস্থাকেই গ্রাস করেছে। আইন ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো হয়ে পড়েছে দুর্নীতির সুরক্ষাদাতা। একপর্যায়ে সরকারসংশ্লিষ্টরাও বুঝে যান, কোনো কারণে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হলে তার মূল্য তাদের জন্য মারাত্মক হবে।
এ প্রজন্ম ও কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী তুর্কিদের কাছে এ সংক্রান্ত বহু তথ্য আছে। সেই বিবেচনায় সময়ের এবং দেশের প্রয়োজনে দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি শ্বেতপত্র তৈরি ও প্রকাশ মোটেই কঠিন কাজ নয়।