সংবিধান সংশোধন ছাড়া রাষ্ট্র সংস্কার অসম্ভব
Share on:
আমি বহু বছর আগে থেকেই দৃঢ়ভাবে বলে চলেছি, বাংলাদেশের সংবিধানে এমন কিছু গুরুতর ত্রুটি রয়ে গেছে, যেগুলো এ দেশের রাষ্ট্র-চরিত্রকে স্বৈরাচারী ও গণবিরোধী করে তুলেছে বারবার।
আমাদের সংবিধানের প্রধান ত্রুটি ৭০ ধারার বিধান। ক্ষমতাসীন কিংবা বিরোধী দল– সব সংসদ সদস্যের ওপর দলীয় প্রধানের একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রয়োগের এ ধারা সদস্যদের ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতা পুরোপুরি হরণ করে নিয়েছে। দলীয় প্রধানের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কথা বললে কিংবা ভোট দিলে সংসদের সদস্যপদ বাতিল হওয়ার এই বিধান সংসদকে করে তুলেছে খয়ের খাঁর ফোরাম। অতএব, ৭০ ধারার বিধানটি সংশোধন করে শুধু ‘নো-কনফিডেন্স মোশন’-এর ক্ষেত্রে দলকে সমর্থন করার বাধ্যবাধকতা বহাল রেখে অন্যান্য আইন প্রণয়ন ও মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করতেই হবে। নইলে সংসদ সত্যিকারভাবে কখনোই স্বাধীন হবে না।
সংবিধানের আরেকটি গুরুতর ত্রুটি প্রধানমন্ত্রীকে ‘নির্বাচিত একনায়ক’-এর ক্ষমতা দিয়ে সর্বশক্তিমান করে ফেলার ব্যবস্থা। ১৯৭২ সালে যখন সংবিধানটি প্রণয়ন করা হয় তখন প্রধানমন্ত্রীর আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত সংবিধান প্রণয়ন কমিটি সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন করে যখন সেটা বঙ্গবন্ধুর কাছে পেশ করেছিল, তখন খসড়ার যেখানেই প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার বিষয়গুলো বর্ণিত হয়েছে, সেখানেই বঙ্গবন্ধু নিজের হাতে কেটেছেঁটে ওগুলোতে পরিবর্তন করে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাকে রাষ্ট্রপতির তুলনায় একচ্ছত্র করার ব্যবস্থা করেছিলেন। যার ফলে রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতাহীন ‘শিখণ্ডী’ বানিয়ে ফেলা হয়েছিল। ব্যাপারটি আমাকে বলেছিলেন ওই কমিটির সদস্য দৈনিক আজাদীর সম্পাদক প্রফেসর খালেদ (প্রয়াত)। কাটাকুটি করা খসড়াটি যখন কমিটির কাছে ফেরত এসেছিল, তখন কামাল হোসেনসহ কারও সাহস হয়নি বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে করা পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কিছু বলা। এভাবেই ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর রাষ্ট্রপতির তুলনায় প্রধানমন্ত্রীকে ভারসাম্যহীন ও পরম ক্ষমতাশালী করে সংবিধানটি পাস হয়েছিল।
তারপর ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা কায়েম হয়েছিল। একদলীয় ‘বাকশাল’ পদ্ধতিকে শক্তিশালী করার প্রয়োজনের কথা বলে প্রধানমন্ত্রীর সব ক্ষমতা রাষ্ট্রপতিকে তো দেওয়া হয়েছিলই, আরও অনেক ক্ষমতা যোগ হয়েছিল; রাষ্ট্রপতি যাতে কথিত সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় কোনোভাবেই বাধা-বিঘ্নের সম্মুখীন না হন। মাত্র চার মিনিটে ওই চতুর্থ সংশোধনী সংসদে পাস করা হয়েছিল কোনো আলোচনা ছাড়াই।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবার নিহত হলে রাষ্ট্রপতির ওই অপরিসীম ক্ষমতা ভোগ করেছেন খন্দকার মোশতাক, জিয়াউর রহমান, এইচএম এরশাদ। জিয়াউর রহমান এবং এইচএম এরশাদ সংবিধানের খোলনলচে অনেকখানি বদলে ফেললেও ‘রাষ্ট্রপতির অপরিসীম ক্ষমতা’ কাটছাঁটের কোনো উদ্যোগ নেননি নিজেদের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ রাখার প্রয়োজনে।
১৯৯১ সালে নির্বাচনে জিতে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর খালেদা জিয়ার প্রথম পছন্দ ছিল বিদ্যমান রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখা। যে কারণে তিনি দীর্ঘ পাঁচ মাস ‘তিন জোটের রূপরেখা’ অনুসরণে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তনে সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নেননি। শেষ পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ এবং বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমতের চাপে আগস্টে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন।
কিন্তু সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীতেও সুপরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রপতির সব ক্ষমতা সাংবিধানিকভাবে প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়। বরং প্রধানমন্ত্রীর আরও অতিরিক্ত ‘প্রসিড্যুরাল ক্ষমতা’ যুক্ত হয়। যে কারণে ১৯৯৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ বিচারপতি সাহাবুদ্দীনকে রাষ্ট্রপতি মনোনয়নের প্রস্তাব দিয়েছিল, তখন তিনি মন্তব্য করেছিলেন, মাজার জিয়ারত ছাড়া রাষ্ট্রপতির কোনো ক্ষমতা নেই। ভাগ্যের পরিহাস, জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন না করার সিদ্ধান্তের জের ধরেই ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতির পদ হারাতে হয়েছিল। ১৯৯১ সালে সংবিধান সংশোধন কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন কর্নেল অলি আহমদ। বছরখানেক আগে কর্নেল অলি এ ব্যাপারে তাদের ভুল স্বীকার করে বক্তব্য দিয়েছিলেন।
১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে শেখ হাসিনা অনেকখানি গণতান্ত্রিক আচরণ মেনে চললেও ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর তিনি যেভাবে সাড়ে ১৫ বছর ধরে স্বৈরাচারী হয়ে উঠলেন, তার দায়ভার সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীকেও নিতে হবে। বিশেষত ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত হওয়ার পর তিন-তিনটি নির্বাচনকে জালিয়াতির মাধ্যমে বরবাদ করতে পারায় শেখ হাসিনা ধরাকে সরা জ্ঞান করতে শুরু করেছিলেন। সংবিধানের বর্তমান অবয়বে ‘সাংবিধানিকভাবে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর প্রধানমন্ত্রী’র এই অফুরন্ত ক্ষমতাকে লাগাম পরানোর ব্যবস্থা না করলে রাষ্ট্র সংস্কার কি আদৌ সম্ভব হবে? বর্তমান ফরাসি সংবিধানে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার যে ভারসাম্য রয়েছে, তা এ ব্যাপারে আমাদের পথ দেখাতে পারে।
বর্তমান সংবিধানে কিছু পরিবর্তন ‘ফরজ’ হয়ে পড়েছে। যেমন– ১. দু’বারের বেশি কাউকে প্রধানমন্ত্রী হতে না দেওয়া। এর সঙ্গে আরেকটি বিষয় যোগ করা উচিত। পাঁচ বছর পরপর নির্বাচন দেওয়ার পরিবর্তে চার বছর পরপর সংসদীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করা।
২. সংবিধানে নির্বাহী বিভাগের কাছে যেভাবে বিচার বিভাগকে নির্ভরশীল করে রাখা হয়েছে, তাও অবিলম্বে সংশোধন করতে হবে। বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সর্বস্তরের বিচারকদের নিয়োগ, বদলি, বেতন-ভাতাদি ও চাকরিচ্যুতি জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে করতে হবে; যে কমিশন গঠিত হবে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সিদ্ধান্তে। হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতিদের নিয়োগ প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার আওতায় রাখা যাবে না। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সুপারিশের ভিত্তিতে এসব নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি।
৩. জনগণের সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন। এ ব্যাপারেও ফরাসি সংবিধান আমাদের পথ দেখাতে পারে।
৪. সংসদীয় নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক সদস্য নির্বাচন পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে। প্রয়োজনে সংসদে দুটো কক্ষ রাখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে, যেখানে সংখ্যানুপাতিক ভোটের ভিত্তিতে ১০০ সদস্যের উচ্চকক্ষের সদস্য সংখ্যা রাজনৈতিক দলগুলো পাওয়ার ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। ৩০০ সদস্যের নিম্নকক্ষে বর্তমান পদ্ধতিতে সংসদ সদস্য নির্বাচনের ব্যবস্থা অব্যাহত রাখা যেতে পারে।
৫. সংসদে ৫০ জন নারী সদস্যের রিজার্ভ আসন রাখার বিধান বাদ দিয়ে এক-তৃতীয়াংশ সদস্য নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকতে হবে; যেখানে নারীরা সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবেন। রোটেশন ভিত্তিতে প্রতিটি নির্বাচনে দেশের প্রতিটি জেলায় এক-তৃতীয়াংশ আসনে শুধু নারীদের নির্বাচন করার বিধান করতে হবে।
৬. অবিলম্বে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও অন্যান্য উপদেষ্টা নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে বিচার বিভাগকে জড়ানো যাবে না।
উল্লিখিত সংশোধনীগুলোর ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ প্রণয়ন করতে হলে অবিলম্বে দেশের প্রথিতযশা সংবিধান বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করে একটি ‘সংবিধান পুনর্লিখন কমিশন’ গঠন করতে হবে। কমিশনের সুপারিশগুলোকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য একটি গণভোট অনুষ্ঠানের প্রয়োজনও অনস্বীকার্য। পরবর্তী সময়ে নির্বাচিত সংসদে এ সংশোধনীগুলোকে অনুসমর্থনের (রেটিফিকেশন) মাধ্যমে আইনগত বৈধতা দিতে হবে।