স্বাধীনতার মাসে ভারতজুড়ে আন্দোলন ও বিক্ষোভ
Share on:
গত ৯ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় আর জি কর মেডিকেল কলেজের ৩১ বছরের এক চিকিৎসককে ধর্ষণ করে হত্যা করার ঘটনা ঘটেছে। এ নিয়ে শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, ভারতজুড়ে ব্যাপক আন্দোলন ও বিক্ষোভ চলছে।
বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে বিরোধী দলগুলো রাজপথে ব্যাপক সমাবেশ ঘটাচ্ছে। অন্যদিকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও পথে নেমে অভিযুক্তের ফাঁসির দাবি জানিয়েছেন। তিনি এ ঘটনায় বিরোধীদের ষড়যন্ত্রও আবিষ্কার করে জনতাকে এর বিরুদ্ধে সতর্ক করেছেন।
ঘটনাটি এমন সময়ে ঘটল যখন দেশটি স্বাধীনতার মাস উদযাপন করছে। গত ১৫ আগস্ট ছিল ভারতের স্বাধীনতা দিবস। আনন্দবাজার পত্রিকায় দেবাশীষ ভট্টাচার্য লিখেছেন, ‘স্বাধীনতা তুমি কার?’ সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের দেশখ্যাত ভারতে এ ধরনের নারী নিপীড়নের ঘটনা নতুন কিছু নয়। আলজাজিরা ২০২২ সালের এক প্রতিবেদনের বরাতে লিখেছে, ভারতে প্রতিদিন ৯০ জন ধর্ষণের শিকার হন।
নিহত চিকিৎসক রাধাগোবিন্দ কর তথা আরজি কর মেডিকেল কলেজে স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। ৮ আগস্ট রাতে নির্ধারিত দায়িত্ব পালনকালে বিশ্রামের জন্য সেমিনার কক্ষে যান তিনি। সেখানেই তাঁকে প্রথমে ধর্ষণ, পরে হত্যা করা হয়। মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ এটিকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছিল। পরে ময়নাতদন্তে ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড বলেই প্রমাণিত হয়। ঘটনার প্রতিবাদে পেশাজীবী ডাক্তার ও নারীরা প্রথমদিকে বিক্ষোভ শুরু করেন। পরে সর্বস্তরের লোক তাদের সমর্থন জানায়। প্রতিবাদের উল্লেখযোগ্য দিক হলো অজস্র নারী রাতের আঁধারে রাস্তায় নেমে পড়ে। কোথাও কোথাও ব্যাপক ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে। স্লোগানগুলোতে বিশেষত নারীদের অগ্নিঝরা ক্ষোভের প্রকাশ দেখা গেছে। পোস্টারে ‘মেয়েরা রাত দখল করো’, ‘আমরা ইনসাফ চাই’ ইত্যাদি লিখে নারীদের রাস্তায় নেমে পড়ার আহ্বান জানানো হয়।
আনন্দবাজার পত্রিকায় অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক মনোবিদ লিখেছেন, ‘রাত দখলের এই ভাবনা আপাতভাবে প্রতীকী। এক রাতের। কিন্তু এক রাতের ডাকে শামিল হওয়ার পেছনে অনেক রাতের ভয়ের অধ্যায় রয়ে গিয়েছে।’ স্বাভাবিকভাবেই এ ঘটনা বিশ্বব্যাপ আলোড়ন তুলেছে।
এরই মধ্যে এ ঘটনায় একজন গ্রেপ্তার হয়েছে। লাশের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন বলছে, একাধিক লোক এর সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে। পেশায় সে একজন সিভিক ভলান্টিয়ার; রাজ্য পুলিশের অধীন এ বাহিনী রাজ্য সরকারের নিজস্ব কর্মী। ফলে সবারই আঙুল এখন রাজ্য সরকারের দিকে।
এরই মধ্যে আদালতে এ নিয়ে মামলা হয়েছে। কলকাতা হাইকোর্ট তদন্তের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন সিবিআইকে দায়িত্ব দিয়েছে; কলকাতা পুলিশকে নয়। এতেও রাজ্য পুলিশের প্রতি জনআস্থা ও ক্ষোভ কোন পর্যায়ে আছে, তা বোঝা যায়। রাজ্যের সিপিএম আজ থেকে দুই দিনের বিক্ষোভ পালনের ঘোষণা দিয়েছে। অন্যদিকে বিজেপিপন্থি একটি নারী সংস্থা ভাঙচুরের প্রতিবাদে আজ মোমবাতি জ্বালানোর ঘোষণা দিয়েছে।
সরকার হাসপাতালটির বিতর্কিত অধ্যক্ষ সন্দ্বীপ ঘোষের প্রতি কঠোর না হওয়ায় ঘটনা আরও জটিল হয়ে উঠেছে। জানা গেছে, দায়িত্ব থেকে ইস্তফা দেওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাঁকে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ বানানো হয়েছে। স্বয়ং আদালত প্রশ্ন তুলেছেন– ঘটনার পর কেন হাসপাতাল সুপার ও অধ্যক্ষ বিষয়টি পুলিশের কাছে জানালেন না। এদিকে ভারতীয় মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন দেশজুড়ে ২৪ ঘণ্টার জন্য সেবা স্থগিত রাখার ডাক দিয়েছে। ফলে পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল রূপ নিচ্ছে। জনসাধারণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে।
এর আগেও ভারতে ধর্ষণের একাধিক ঘটনা ঘটেছে। ২০০২ সালে গুজরাটে দাঙ্গার সময় বিলকিস বানু নামে এক মুসলিম নারী দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন। দুই বছর আগে মোদি সরকার ঘটনায় জড়িত ১১ জন ধর্ষককে মুক্তি দেয়, যদিও গণঅসন্তোষের কারণে তাদের পুনরায় জেলে নেওয়া হয়। মাওবাদী কর্মী সনি সরি পুলিশি নিপীড়নের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলেন, যাঁর ওপর জেলহাজতে ব্যাপক বর্বরতা চালানো হয়েছিল। তাঁর গুপ্তস্থানে পাথর ঢুকিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। ২০১২ সালে চলন্ত বাসে ২২ বছরের এক শিক্ষানবিশ নারীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল। এ নিয়ে সারাদেশে তোলপাড় দেখা দেয় এবং অভিযুক্তদের ফাঁসি কার্যকর হয়।
সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচনে মমতার দল তৃণমূল কংগ্রেস বেশ ভালো ফল করেছে। ২০১১ সাল থেকে রাজ্য ক্ষমতায় আছে দলটি। শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে সংঘটিত তীব্র আন্দোলনের পর অনুষ্ঠিত বিধানসভা নির্বাচনে সিপিএমের ৩৪ বছরের শাসনের
অবসান ঘটিয়ে ক্ষমতায় আসেন মমতা। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও বিরোধী বিজেপিকে ব্যাপক ব্যবধানে হারান তিনি। কিন্তু তার পরপরই তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষক নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এ নিয়ে বহু চাঞ্চল্যকর মামলা রাজ্য হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টেও বিচারাধীন। এখন দেখার বিষয়, আর জি কর কাণ্ড তার সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধীদের কতটুকু সুবিধা এনে দেয়।