সত্যিকারের বিপ্লব ঘটিয়েছে ‘কোমলমতি’ ছাত্রছাত্রীরা
Share on:
শেখ হাসিনা তাঁর সর্বশেষ ভাষণে বলেছিলেন, ‘কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে যেসব ঘটনা ঘটেছে, তা খুবই বেদনাদায়ক ও দুঃখজনক।’
তাঁর হঠাৎ কিন্তু কাঙ্ক্ষিত বিদায়ের পর যখন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বিজয়োল্লাসে মেতে না থেকে পুলিশ আর পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের ঘাটতি পূরণ করছে; দেশের সড়ক, রাজপথের যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছে, আবর্জনা পরিষ্কার করছে, তখন আমাদের গণমাধ্যম বলছে, ‘ঢাকার রাজপথে ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করছে “কোমলমতি” ছাত্রছাত্রীরা।’
কিন্তু বাংলায় যখন আমরা কম বয়সের মানুষদের ‘কোমলমতি’ বলি, তখন তাদের নরম বা তরল কিংবা কাঁচা বুদ্ধির মানুষ বলেই চিত্রিত করার চেষ্টা করি। আমাদের ধারণা, পাকা বয়স না হলে বুদ্ধিও পাকা হয় না। পাকা বয়সের লোকেরা যেটা সারা জীবনেও করতে পারে না বা করার হিম্মত রাখে না, সেটা কম বয়সের একটা মানুষ চোখের নিমেষে করে ফেললেও আমরা ভাবি কোমলমতিকে কেউ ‘চালাচ্ছে’। পেছনে কারও হাত আছে। পাকা বয়সের মানুষেরা সারা দিন পয়সার ধান্দায় থাকে বলে মনে করে শিশু–কিশোরদেরও কেউ ‘ফান্ডিং’ করছে। সত্যিকারের বিপ্লবে যে বিরিয়ানি লাগে না, এটা তাদের মাথাতেই ঢুকবে না। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন দেখার পরেও না।
পুলিশবিহীন একটা দেশের কথা দুনিয়ায় এখন কেউ কল্পনাও করতে পারে না। সে রকম এক পরিস্থিতিতে খালি হাতে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ আর রাস্তা পরিষ্কার রাখার যে দৃষ্টান্ত তারা তৈরি করল, আমরা যুদ্ধ থেকে ফিরেও সেটা করতে পারিনি; যদিও তখন আমাদের হাতে হাতিয়ার ছিল।
২০২২ সালের অক্টোবরে ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা নানা দাবিতে তাদের বিদ্যায়তনের সামনের রাস্তায় বিক্ষোভ দেখালে ‘সত্য অনুসন্ধানী’ কিছু সংবাদমাধ্যম শিরোনাম করে, ‘কোমলমতি ভিকারুননিসার শিক্ষার্থীদের রাস্তায় নামাল কে’। শিক্ষার্থীরা তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য বাধ্য হলে যে নিজেরায় রাস্তায় নামতে পারে, সেটা ‘পাকা বয়সের’ মানুষদের মাথাতেই ঢোকে না।
বছর তিনেক আগের কথা (অক্টোবর, ২০২১); ঢাকা–ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে ধামশুর হালিমুন্নেছা চৌধুরাণী মেমোরিয়াল বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে যাতায়াতের রাস্তাটি খানাখন্দে ভরে গিয়েছিল। একসময় চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এগিয়ে আসে বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তারা স্বেচ্ছাশ্রমে রাস্তাটাকে চলাচলের উপযোগী করে তোলে। রবি ও সোমবার দুই দিন বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ের অর্থায়নে ইটের সুরকি ফেলে রাস্তাটুকু সংস্কার করে।
সেই দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তাই আজকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নানা দেয়ালে যারা লিখছে, ‘কোমলমতিরা হুজুগে মেতেছে’, তারা ভুল। তাদের বয়স হলেও যে মতি (বুদ্ধি) হয়নি, সেটা নতুন করে মনে করিয়ে দেওয়ার দরকার নেই। এ ঘটনার উল্লেখ করার কারণ হচ্ছে আমরা যে অনেক ভাগ্যে একটা দুর্দান্ত সাহসী আর গড়তে জানা প্রজন্ম পেয়েছি এবং সেটা যে দেশের সর্বত্র বিরাজমান, সেটা মনে করিয়ে দেওয়া।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক বিজয়ে আমরা এমন মাতোয়ারা হয়েছিলাম যে বিজয়টা আর সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে যেতে পারেনি। যুদ্ধফেরত তখনকার তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে এবারের তরুণ প্রজন্মের ফারাক এখানেই। ২০২৪–এর আন্দোলনের পর মাথা ঠান্ডা রেখে ধান্দাবাজির ঊর্ধ্বে উঠে মানুষের জন্য কাজ করে যাওয়ার যে দৃষ্টান্ত এই তরুণেরা দিনের পর দিন রেখে যাচ্ছেন, তার কোনো সমান্তরাল উদাহরণ পৃথিবীতে আছে কি?
পুলিশবিহীন একটা দেশের কথা দুনিয়ায় এখন কেউ কল্পনাও করতে পারে না। সে রকম এক পরিস্থিতিতে খালি হাতে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ আর রাস্তা পরিষ্কার রাখার যে দৃষ্টান্ত তারা তৈরি করল, আমরা যুদ্ধ থেকে ফিরেও সেটা করতে পারিনি; যদিও তখন আমাদের হাতে হাতিয়ার ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহর ১৯৭৭ সালের জুলাই মাসে ঘণ্টা পাঁচেকের জন্য অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিল। পুলিশ দেখা যাচ্ছিল না। সেই সুযোগে যে লুটপাট হয়েছিল, তা সভ্যতার ইতিহাসে আর দেখা যায়নি। ব্ল্যাকআউটের সময়, লুটপাট, ভাঙচুর এবং আগুন থেকে আনুমানিক ৩০০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছিল। ব্ল্যাকআউটের সময় লুটপাট ও ধ্বংসের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত অনেক ব্যবসা আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি।
যাঁরা বয়সের গর্বে এখনো মাটিতে পা ফেলতে ইতস্তত বোধ করছেন, তাঁদের বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর বুদ্ধি (যদি থাকে) খুঁজতে হবে। সারা জীবন তরুণদের শুনিয়েছেন বা শিখিয়েছেন, এবার তাঁদের কথা মন দিয়ে শুনুন। শেখার আছে তাঁদের কাছেও। তাঁদের হাতে দায়িত্ব ছেড়ে দিন, গড়ার সুযোগ দিন। কখনো মনে হতে পারে, ওদের কাজটা কেতাদুরস্ত হচ্ছে না, ভুল হচ্ছে। নিজেদের ভুলে তো একজীবন ভুগলেন; তরুণদেরও ভোগানোর সময় দিন।
ভাবুন, এই প্রজন্মের কাছে আমাদের মুখোশ খুলে গেছে। আমাদের পল্টি খাওয়া কালচার তারা ঘৃণা করে। তাঁরা লক্ষ করেছেন, একই মালিকের একই সাংবাদিক দল ২৭ জুলাই যে আন্দোলনকে ‘তাণ্ডব’ বলছেন, ৬ আগস্ট তাকেই বলছেন ‘ছাত্র–অভ্যুত্থান’।
এই প্রজন্মের দুঃখ হচ্ছে, তাদের সেই শিক্ষকসমাজের কাছে ফিরতে হবে, যাদের বড় একটা অংশ ছিল জুলুমকারীদের সেবক। না, তাঁদের কেউই একাত্তরের মতো নিরুপায় ছিলেন না। বরং নিজেরাও ছিলেন ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির ধারক–বাহক। নিজেদের না বদলালে, তওবা না কাটলে ঔপনিবেশিক খোলস ভেঙে বেরিয়ে আসা সাহসী শিক্ষার্থীদের চোখের দিকে তাকানোর সাহস আমরা কোথায় পাব?