মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: বুধবার ২৫, সেপ্টেম্বর ২০২৪

সৃজনশীল প্রকাশনা শিল্পের উন্নয়ন ও সুরক্ষায় করণীয়

Share on:

বাংলাদেশে সৃজনশীল প্রকাশনা শিল্প দেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের অন্যতম বাহক। জাতির মননশীলতা ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে শিল্পটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু বিভিন্ন সমস্যা ও সীমাবদ্ধতার কারণে এ শিল্প প্রত্যাশিত মাত্রায় বিকশিত হতে পারেনি।


সৃজনশীল প্রকাশনা খাতের টেকসই উন্নয়ন দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও চিন্তার বৈচিত্র্যকে প্রভাবিত করে। তাই রাষ্ট্র সংস্কারের পাশাপাশি এ খাতের সংস্কারেও যথাযথ মনোযোগ দেওয়া উচিত। এ শিল্পের শত শত সমস্যার মধ্যে মোটা দাগে সাতটি বিষয়ে অগ্রাধিকার সময়ের দাবি।

১. প্রকাশকদের আলাদা সংগঠন

সৃজনশীল প্রকাশনা শিল্পের সুরক্ষায় স্বাধীন সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনিবার্য। ২০২২ সাল পর্যন্ত ‘বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি’ নামে সৃজনশীল প্রকাশকদের পৃথক সমিতি ছিল। কিন্তু সমিতির সর্বশেষ কমিটির স্বেচ্ছাচারিতায় সদস্যদের কাছে এর গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে গিয়ে ঠেকে। সেই সুযোগই গ্রহণ করে ‘বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি’ (বাপুস)। তাদের এক মামলায় প্রকাশকদের সমিতিটি বিলুপ্ত হয়। উল্লেখ্য, বাপুস মূলত নোট-গাইড বইয়ের প্রকাশক ও বিক্রেতাদের সংগঠন। এর সদস্য সংখ্যা প্রায় ২৬ হাজার; যার মধ্যে প্রায় ২০০ (০.০১%) সৃজনশীল প্রকাশকসহ সব মিলিয়ে প্রকাশকের সংখ্যা প্রায় ২ হাজার।

পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা– পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট পৃথক দুটি সত্তা। কিন্তু প্রতাপশালী সিন্ডিকেট দুই ভিন্ন সত্তাকে এক ছাতার নিচে থাকতে বাধ্য করেছে। এ সিন্ডিকেটের প্রধান ছিলেন রাজধানীর এক ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা। তিনি ৯ বছর ধরে বিনা ভোটে সমিতির সভাপতির পদ দখলে রেখেছিলেন। গণঅভ্যুত্থানকালে ছাত্র-জনতার ওপর তাঁর গুলি চালানোর সচিত্র সংবাদ ১ সেপ্টেম্বর সমকালে প্রকাশিত হয়েছে। এমন একটি সংগঠনের অধীনে থেকে সৃজনশীল প্রকাশকদের পক্ষে বুদ্ধিবৃত্তিক দায়সম্পন্ন ব্যবসা পরিচালনা অসম্ভবপ্রায়।

সৃজনশীল প্রকাশনা স্বভাব ও কার্যক্রমের দিক থেকে অন্য যে কোনো প্রকাশনা থেকে মৌলিকভাবে পৃথক। লেখক-প্রকাশক সম্পর্কের ধরন, বিক্রয় ও বিতরণের চ্যানেল, ব্যবসার পরিবেশ বা সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা– কোনো দিক থেকেই সৃজনশীল প্রকাশনার সঙ্গে অন্য প্রকাশনা খাতের মিল নেই। তবুও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ নানা দেশের সংগঠনগুলো বিশ্লেষণ করে আমাদের মনে হয়েছে, প্রকাশক ও বিক্রেতাদের আলাদা সংগঠনই শ্রেয়। তবে অর্থনৈতিকভাবে অপেক্ষাকৃত দুর্বল সৃজনশীল প্রকাশকদের সুরক্ষায় প্রকাশক সমিতির গঠনতন্ত্রে কিছু পরিবর্তন আনতে হবে।

২. ভর্তুকি ও আর্থিক সহায়তা

বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে ঋণপ্রাপ্তির সুবিধা থাকলেও এর শর্তাবলি প্রকাশকদের জন্য সহায়ক নয়। ফলে বৃহত্তর প্রকাশকরা এ ঋণের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। প্রকাশনা শিল্পের সুষ্ঠু বিকাশে বইমেলায় বিক্রির ভিত্তিতে প্রকাশকদের মৌসুমি ঋণের বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।

গত কয়েক বছরে বইয়ের উৎপাদন খরচ প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। অথচ এ সময়ে বইয়ের দাম মাত্র ২৫ শতাংশ বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। এই বৃদ্ধিও পাঠকদের জন্য আর্থিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এ অবস্থায় সৃজনশীল প্রকাশকদের জন্য বিদেশি কাগজ আমদানিতে বিদ্যমান শুল্ক প্রত্যাহারের পাশাপাশি ভর্তুকি বা স্বল্পমূল্যে কাগজ ক্রয়ের সুযোগের মাধ্যমে বইয়ের দাম কমিয়ে আনা দরকার।

৩. সরকারি বই ক্রয়ে স্বচ্ছ নীতিমালা

বিগত বছরগুলোতে সরকারি বই ক্রয়ের নামে সিন্ডিকেটের লুটপাটের পথ সুগম করা হয়েছে। ক্রয় প্রক্রিয়ায় বইয়ের মান নয়; প্রকাশকের নামই ছিল প্রধান বিবেচ্য। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র ও গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের বই ক্রয় কমিটির কাঠামোও সরকারের ঘোষিত ক্রয় নীতিমালার পরিপন্থি। ২০২০ সালে ১৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘বঙ্গবন্ধু কর্নার’ স্থাপনে ৬৫ হাজার ৭০০টি স্কুলে বই কেনা হয়েছিল, যা কতিপয় আমলা ও প্রকাশকের লুটপাটের প্রকল্পে পর্যবসিত।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে এসইডিপি প্রকল্পের প্রায় ৩০০ কোটি টাকার বই ক্রয়ের প্রথম ধাপে ৯৬টি বই নির্বাচিত হয়েছিল। কিন্তু বেশির ভাগই ছিল গুটিকয়েক প্রকাশকের নামে-বেনামে নিবন্ধিত প্রকাশনীর বই। অধিকাংশ বই আর্থিক লেনদেনের ভিত্তিতে তালিকাভুক্ত হয়েছে বলে অভিযোগ। এ প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপের ক্রয় প্রক্রিয়ার আগেই বইয়ের তালিকা পুনর্মূল্যায়ন এবং যোগ্যতা, স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে বই ক্রয় করতে হবে।

বস্তুত যে কোনো বই ক্রয়ের আগে অভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন আবশ্যক, যার ভিত্তি হবে বইয়ের মান। বই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় আমলা, স্বার্থসংশ্লিষ্ট লেখক বা প্রকাশকের পরিবর্তে সর্বসাম্প্রতিক প্রকাশনাগুলোর বিষয়ে ওয়াকিবহাল, গ্রন্থপ্রেমী ও সুপণ্ডিত ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।

৪. জাতীয় গ্রন্থনীতির যুগোপযোগীকরণ ও দ্রুত বাস্তবায়ন

১৯৯৪ সালে মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত ‘জাতীয় গ্রন্থনীতি’ দীর্ঘ দুই দশক পর ২০১৫ সালে সংশোধিত হয়। কিন্তু গত ১০ বছরে এর ২৯টি প্রস্তাবনার একটিও কার্যকর হয়নি। বিশ্বের চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রেক্ষাপটে এবং দেশে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী জাতীয় জীবনের পরিবর্তনের আলোকে লেখক, প্রকাশক ও বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটির মাধ্যমে জাতীয় গ্রন্থনীতির পুনর্মূল্যায়ন ও যুগোপযোগীকরণ জরুরি। এ নীতির সুষ্ঠু বাস্তবায়নই পারে প্রকাশনা শিল্পকে বিশ্বমানে উন্নীত করতে।

৫. স্বার্থবিরোধী আইনের সংস্কার ও প্রকাশকবান্ধব আইন

প্রকাশনা শিল্পের অগ্রগতির পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে বাস্তবতাবর্জিত একাধিক আইন। আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন তখনই কার্যকর হয়, যখন তা অংশীজনের মতামত ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে প্রণীত হয়। প্রকাশনা-সংশ্লিষ্ট কপিরাইট আইনসহ (২০২৩) যেসব আইন যুগের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, সেগুলো পুনর্মূল্যায়ন ও সংস্কারের মাধ্যমে বাস্তবসম্মত ও প্রকাশনাবান্ধব করা আবশ্যক, যাতে এসব আইন প্রকাশনা শিল্পের টেকসই বিকাশ, সৃজনশীল স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৬. কমিটি ঢেলে সাজিয়ে প্রকাশকদের নেতৃত্বে বইমেলা

‘অমর একুশে বইমেলা পরিচালনা কমিটি’র ৩৩ সদস্যের মধ্যে ১৫ জন বাংলা একাডেমির, পাঁচজন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের, তিনজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং মাত্র চারজন প্রকাশক প্রতিনিধি। ‘সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব’রা মূলত স্টল বণ্টনে খবরদারি করতেন। এ প্রেক্ষিতে বইমেলার নীতিমালা ও কমিটির সংস্কার দরকার। এ নীতিমালার ২১.১৩ ক. ধারা মানবাধিকারের লঙ্ঘনমূলক। এই ধারাবলেই ২০২৩ সালের বইমেলায় আদর্শের স্টল বরাদ্দ বাতিল করা হয়।

অন্যদিকে কর্মকর্তাদের অনীহা ও গাফিলতিতে গ্রন্থকেন্দ্রের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত জেলা পর্যায়ের অধিকাংশ বইমেলা থাকে ক্রেতাশূন্য। বইমেলার মূল উদ্দেশ্য যেহেতু বইয়ের প্রচার, প্রসার, বিক্রি ও বিপণন– এসব বিষয়ে প্রকাশকদেরই বেশি আন্তরিক ও দক্ষ হওয়ার কথা। প্রসঙ্গত ‘কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা’র আয়োজক কলকাতার প্রকাশকরা। তাই বইমেলাগুলো প্রকাশকদের হাতে ছেড়ে দেওয়া সময়ের দাবি। এতে কেবল বইমেলার অভিজ্ঞতাই উন্নত হবে না; প্রকাশনা শিল্পের মানোন্নয়ন, সৃজনশীলতা বৃদ্ধি ও বইমেলার প্রভাব বাড়বে। এ বিষয়ে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রকাশকদের কাছে কর্মকৌশল ও পরিকল্পনা চাইতে যেতে পারে।

৭. দুর্নীতিবাজদের বিচার এবং দায়সম্পন্ন প্রকাশকদের ক্ষমতায়ন

স্বৈরাচারী শাসনামলে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে দুর্নীতিবাজ কিছু প্রকাশক সাধারণ প্রকাশকদের হয়রানি ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে প্রকাশনা শিল্পের বিকাশের পথ রুদ্ধ করেছেন। প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে ভবিষ্যতে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারেন। বিচারহীনতার সংস্কৃতি নতুন নতুন দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়নের উদ্ভাবন ও বিস্তারে সহায়ক। প্রকাশনা খাতের দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীদের যথাযথ বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি।

স্বচ্ছ ও বুদ্ধিবৃত্তিক দায়সম্পন্ন যেসব প্রকাশক বিগত সরকার দ্বারা নিগৃহীত হয়েছেন, তাদের মূল্যায়ন ও ক্ষমতায়নের মাধ্যমে প্রকাশনা শিল্পকে গণঅভ্যুত্থানের চেতনায় এগিয়ে নেওয়া সম্ভব।

করোনা-পরবর্তী সময়ে সৃজনশীল বইয়ের বিক্রয়াবনতি, মুদ্রণ কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি এবং স্বৈরাচারের অনুসারী সিন্ডিকেটের লুটপাটের ফলে এ শিল্প মুমূর্ষুপ্রায়। স্বতন্ত্র ও কার্যকর সংগঠনের অনুমোদন, আর্থিক সহায়তা এবং বিভিন্ন নীতিমালার যুগোপযোগীকরণ ছাড়া এ শিল্পের সঠিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই বর্তমান সরকারের উচিত এ শিল্পের বিশেষত্ব বুঝে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে প্রকাশনা শিল্পকে শক্তিশালী ও টেকসই করে তোলা, যা একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

দৈনিক সমকাল