সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে সরকার ও নির্বাচন
Share on:
বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নির্বাচনের যে পদ্ধতি কয়েক শতাব্দী ধরে অনুসৃত হয়ে আসছে, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট বা এফপিটিপি। ঘোড়দৌড়ের পদ্ধতি থেকে কথনটি এসেছে।
এই পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচনে কোনো একটি কনস্টিটুয়েন্সি বা সংসদীয় আসনে একাধিক প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে যিনি প্রদত্ত ভোটের সর্বাধিক অংশ পাবেন তিনি নির্বাচিত ঘোষিত হবেন।
তবে বিভিন্ন দুর্বলতার কারণে নির্বাচনের এই পদ্ধতি বহু দেশে পরিবর্তিত হয়েছে। পরিবর্তিত এমন একটি পদ্ধতির নাম সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি। ইংরেজিতে যাকে প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন বা পিআর সিস্টেম বলা হয়। এই পদ্ধতিতে নির্বাচন হয় ব্যক্তি-প্রার্থীর পরিবর্তে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। ৩০০টি কনস্টিটুয়েন্সি থাকবে না। বাংলাদেশ হবে একটি একক কনস্টিটুয়েন্সি। নির্বাচনে যে দল মোট প্রদত্ত ভোটের যত শতাংশ পাবে সেই অনুপাতে সংসদে আসন লাভ করবে। যেমন ‘ক’ দল মোট প্রদত্ত ভোটের ৫০ শতাংশ ভোট পেলে আসন পাবে ৫০×৩ =১৫০টি, ‘খ’ দল ৪০ শতাংশ ভোট পেলে আসন পাবে ৪০×৩ =১২০টি, ‘গ’ দল ৫ শতাংশ ভোট পেলে আসন পাবে ৫×৩ =১৫টি এবং ‘ঘ’ দলও ৫ শতাংশ ভোট পেলে আসন পাবে ৫×৩ =১৫টি। এভাবে সংসদের ৩০০টি আসন পূরণ হবে। কোনো একটি দল শূন্য দশমিক ৩৪ শতাংশ ভোট পেলে তার আসন হবে মাত্র ১টি। ১৮৯৯ সালে বেলজিয়াম এই পদ্ধতিটি প্রথম প্রবর্তন করে। অধুনা বিশ্বের প্রায় ১০০টির অধিক দেশ কোনো না কোনো প্রকারের পিআর পদ্ধতি অনুসরণ করছে।
পিআর পদ্ধতির অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে– এখানে নির্বাচনী অনিয়ম, অপকর্ম, সহিংসতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। নির্বাচনী কর্মকর্তা, পুলিশ বা প্রশাসনকে অবৈধ অর্থ দিয়ে পক্ষে টানা সম্ভব হয় না। প্রার্থীর মৃত্যুজনিত কারণে উপনির্বাচনের প্রয়োজন হয় না। নারীর সংরক্ষিত আসনে ভিন্নভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান আবশ্যক হবে না। নমিনেশন দাখিল কেন্দ্রীয়ভাবে হবে।
বিদ্যমান ব্যবস্থায় একটি রাজনৈতিক দল ২২ শতাংশ ভোট পেয়ে এবং অবশিষ্ট ৭৮ শতাংশ ভোটারের সমর্থন ব্যতিরেকেই সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করতে পারে। পিআর পদ্ধতিতে এটি কখনোই সম্ভব হবে না। বিদ্যমান পদ্ধতিতে ৬০ শতাংশ ভোটারের সমর্থন ছাড়া কেবল ৪০ শতাংশ ভোটারের সমর্থনেই ৩০০টি আসন পূরণ সম্ভব। পিআর পদ্ধতিতে ১০০ শতাংশ ভোটারের সমর্থনে সরকার গঠিত হোক বা না হোক, ১০০ শতাংশ ভোটারের সমর্থনেই সংসদ গঠিত হবে।
পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনী ব্যয় অনেক হ্রাস পাবে। এই পদ্ধতিতে নারীর জন্য অমর্যাদাকর লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যমূলক ৫০/৬০টি আসন ভিন্নভাবে সংরক্ষিত রাখার প্রয়োজন হবে না। ৩০০ আসনের মধ্যেই নারীর জন্য অনূর্ধ্ব ৬০টি আসন ব্যবস্থিত থাকলে প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে আইন দ্বারা বাধ্য করা যাবে যে, নির্বাচন কমিশনের কাছে দলের পক্ষে দাখিলকৃত তালিকায় প্রতি ১০ জনের প্রথম ২ জন বা শেষ ২ জন নারী হবেন। তাহলে সে দলের পক্ষে নারী প্রার্থী হবেন ৩০০ জনের মধ্যে ৬০ জন। ১৯৭২ সালের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১৮ কোটি মানুষ। এমন বিবেচনায় সংসদের আসন সংখ্যা ৩৫০/৪০০-তে বর্ধিত করা যেতে পারে।
এ পদ্ধতিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আগ্রহী রাজনৈতিক দল প্রার্থীদের তালিকা ওপেন লিস্ট বা ক্লোজড লিস্ট আকারে নির্বাচন কমিশনে দাখিল করতে পারে। ওপেন লিস্টে ভোটার এবং দলের সদস্যরা আগেই জেনে যাবেন দলের প্রার্থী কারা। এর ভালোমন্দ উভয় দিকই আছে। জনগণের জন্য ভালো, তারা প্রার্থীদের গুণাগুণ আগাম বিশ্লেষণ করে দলের সক্ষমতা নির্ধারণ করতে পারবেন। মন্দ দিক হলো, দলের ভেতরে এতে অনাকাঙ্ক্ষিত কোন্দল-রেষারেষি হতে পারে। ক্লোজড লিস্টের সুবিধা হচ্ছে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হওয়ার আগে দলের প্রার্থী কারা ছিলেন তা গোপন থাকবে। ফলে দলের ভেতর সম্ভাব্য কোন্দল বা রেষারেষি পরিহার করা সম্ভব হবে। নির্বাচন সহজ, শান্তিপূর্ণ ও অবাধ হবে।
পিআর পদ্ধতিতে কোনো দলের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ (১৫০টির অধিক) আসন লাভ করে এককভাবে সরকার গঠন সম্ভব নাও হতে পারে; তবে সে ক্ষেত্রে কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে হবে। কোয়ালিশন সরকার গঠন সম্ভব না হলে তাৎক্ষণিক সংসদ ভেঙে না দিয়ে সর্বোচ্চ সংখ্যক আসনপ্রাপ্ত দলকে অবিলম্বে সরকার গঠনের অনুমোদন দেওয়া যেতে পারে। এতে শূন্যতার তাৎক্ষণিক সংকট পরিহার করা যাবে। সংখ্যালঘু দল কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে না পারলে ২-৩ বছর পর একই পদ্ধতিতে আবার সাধারণ নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। সরকার গঠন এবং আইন পাস বা বিভিন্ন অনিবার্য উদ্দেশ্যে সংখ্যালঘু দলকে লিগ্যাল ফিকশনের মাধ্যমে ১৫১টি আসন প্রাপ্ত মর্মে সাময়িকভাবে গণ্য করা যেতে পারে। সাময়িক এমন ব্যবস্থা সংবিধান বা যথোপযুক্ত আইনি বিধান দ্বারা করা যায়।
স্বাধীন ভারতে বিগত ৭৫ বছরে কোনো সামরিক শাসন বা গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতন হয়নি। গণতন্ত্রের চর্চা ছিল নিরবচ্ছিন্ন। অন্যদিকে স্বাধীন পাকিস্তান অতঃপর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অবাধ চর্চা মূলত কখনোই হয়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অসাংবিধানিক অবস্থানকে পরবর্তীকালে র্যাটিফাই করে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হয়েছিল। দুটি নির্বাচন সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অধিকতর স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। ২০০৭ সালে কথিত সেনাসমর্থিত বেসামরিক সরকার দুই বছর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। একটি নির্বাচন ছাড়া কাজের কাজ আর কিছুই করতে পারেনি। আসলে দুর্ভেদ্য প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ছাড়া জনপ্রত্যাশিত অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন কঠিন। ইতিহাস বলে, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান হবে, স্বৈরাচারের পতন হবে, পৌরাণিক ফিনিক্স পাখির মতো ভষ্ম থেকে নতুন স্বৈরাচার উঠে আসতে পারে।
অনেকেই বলছেন, নির্বাচন ব্যবস্থাকে আমূল ঢেলে সাজাতে হবে, সংস্কার করতে হবে। আমার অভিমত, প্রথমে বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা বা বন্দোবস্তে মৌলিক পরিবর্তন ও সংস্কার প্রয়োজন হবে। তাহলে নির্বাচন ব্যবস্থা সেই আদলে অনিবার্যভাবেই পরিবর্তিত হবে। পিআর ব্যবস্থা কার্যত নির্বাচন পদ্ধতি নয়। এটি সংসদে আসন বণ্টনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধিত্বকে সর্বজনীন করার লক্ষ্যে উদ্ভাবিত একটি উন্নততর পদ্ধতি। তবে পিআর পদ্ধতি প্রবর্তিত হলে নির্বাচন পদ্ধতি সেই ব্যবস্থার সঙ্গে নিজেকে শুধরে নিয়ে অনুসরণ করবে। বলা প্রয়োজন, জনঘন বাংলাদেশের জনগণের সমজাতীয়তা বা সমরূপতা (হোমোজেনিটি) দেশের রাজনীতি ও নির্বাচনে পিআর পদ্ধতি প্রবর্তনের জন্য অত্যন্ত অনুকূল।