শিক্ষা ও সংস্কৃতি প্রকাশনার সময়: সোমবার ৫, অগাস্ট ২০২৪

সংকট উত্তরণে অন্তর্বর্তীকালীন উদ্যোগ নিয়ে ভাবতে হবে

Share on:

দুটি ছবি দেখে হতভম্ব হয়েছি। প্রথমটি রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদের। সারা বিশ্ব দেখেছে তার প্রসারিত দুই হাত, খোলা বুক। সামনে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে প্রস্তুত সারি সারি পুলিশ। তাদেরকে সে যেন ডেকে বলছে, করো, এই বুকে গুলি করো। মৃত্যুতে আমার ভয় নেই।


দ্বিতীয় ছবিটি একটি কম বয়সী মেয়ে, পিঠে ঝোলানো ব্যাগ। সম্মুখে ধেয়ে আসা পুলিশ ভ্যান। সেটিকে দুই হাত দিয়ে সে প্রতিহত করবে। তার মুখ দেখা যায় না, কিন্তু আমি শুনতে পাই সে যেন বলছে, চালাও গাড়ি, চালাও গুলি। এই লড়াই থেকে আমি হটছি না।

মনে পড়ে, ১৯৮৯ সালে চীনের তিয়েনআনমেন চত্বরে গণহত্যার কথা। অন্য সবকিছু ভুলে গেছি কিন্তু ভুলিনি অজ্ঞাতনামা এক যুবকের কথা, সবেগে এগিয়ে আসা ট্যাংকবহরের সামনে সে দাঁড়িয়ে একা। যেন বলছে, আসো, পারো তো আমাকে হত্যা করো, তোমাকে আমি ভয় করি না।

দেশের মানুষ যখন একবার ভয়কে জয় করতে শেখে, তাকে পরাস্ত করা অসম্ভব। বঙ্গবন্ধু নিজেই সে কথা বলে গেছেন। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মানুষ একবার মৃত্যুকে বুকে তুলে নিয়ে প্রমাণ করেছিল, একবার মরতে যখন শিখেছি, দাবিয়ে রাখতে পারবে না। আজকের যে বাংলাদেশ, সেখানে এই ছবি কি আমাদের সেই একই বার্তা দিয়ে গেল?

এর উত্তর এই মুহূর্তে দেওয়া যাবে না। কিন্তু এ কথা তো পরিষ্কার, এক ভয়াবহ দুর্যোগের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। চলতি গণবিক্ষোভ যদি ক্রমে বিস্তৃত হয়, এর পেছনে যে গণরোষ অনুঘটক হিসাবে কাজ করেছে, তার মীমাংসা না হলে বাংলাদেশ আবার জ্বলে উঠবে।

কোটা প্রশ্নে যে আন্দোলন ছিল সীমিত আকারের ছাত্র বিক্ষোভ, তা এখন রাজনৈতিক সংকটে রূপ নিয়েছে। ক্ষমতাসীন মহল ধরে নিয়েছে, শুধু শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব। কিন্তু তা যে সম্ভব নয়, আবু সাঈদের প্রসারিত দুই হাত ও পিঠে স্কুলব্যাগ ঝোলানো ওই মেয়ের ছবিটি দেখেই তা অনুমান করা যায়।

সবচেয়ে বড় ভয় বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে। আমরা হয়তো এই মুহূর্তে সংকটের গভীরতর দিকটি খোলা চোখে ধরতে পারছি না। কিন্তু অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, এই সংকট যদি দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতি এমন এক সর্বনাশা খাদের নিচে পড়ে যাবে যে তা থেকে উদ্ধারের কোনো সহজ পথ খোলা থাকবে না।

বাংলাদেশের অর্থনীতির মন্দাবস্থার আভাস চলতি সংকটের আগে থেকেই পাওয়া যাচ্ছিল। আমাদের মোট জাতীয় প্রবৃদ্ধি যে সরকার-নির্ধারিত ৭ দশমিক ৫ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবে না, সে বিষয়ে বিশ্বব্যাংক আগেই আমাদের সাবধান করেছিল। তার কারণ কী, সেটা জানাতে এ বছর এপ্রিলে বিশ্বব্যাংক অর্থনীতির মোদ্দা সংকটের চারটি দিকের কথা উল্লেখ করেছিল: উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি, আমদানি নিয়ন্ত্রণ এবং আর্থিক খাতের ঝুঁকি। সে সময়েই বিশ্বব্যাংক আভাস দিয়েছিল, দেশের জাতীয় প্রবৃদ্ধি কমে ৫ দশমিক ৬ শতাংশে দাঁড়াবে। তারা অবশ্য চলতি রাজনৈতিক সংকট থেকে উদ্ভূত অর্থনৈতিক জটিলতা তাদের হিসাবে রাখেনি। সরকারি-বেসরকারি উপাত্ত অনুসারে সেই জটিলতার চিত্রটি পরিষ্কার হওয়া শুরু হয়েছে।

একটি অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার ধরনের কিছু করা যায় কি না, তা নিয়ে ভাবতে হবে। যদিও এ ধরনের জাতীয় সরকার আগে কখনো এ দেশে হয়নি। যদি তেমন কিছু করা যায়, তবে এই স্বল্পমেয়াদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে এজেন্ডা থাকবে একটাই—চলতি সংকট সমাধানে আশু ব্যবস্থা এবং একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা। তবে সবকিছুর আগে এ ধরনের একটি সরকারের ব্যাপারে সবাইকে একমত হতে হবে।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের কথাই ধরুন। আইএমএফের কাছ থেকে পাওয়া তৃতীয় দফা ঋণ ধরে জুনের শেষ নাগাদ এই মজুতের পরিমাণ ছিল ২৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন। এটি সরকারি হিসাব। আইএমএফ ও অন্যান্য সূত্র বলছে, আসলে এই রিজার্ভের পরিমাণ আরও কম। এক হিসাবে দেখছি, ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের পরিমাণ ১৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি নয়, যা দিয়ে দুই মাসের আমদানি চাহিদা মেটানোও কঠিন হবে। রিজার্ভ কমে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক রেটিং এজেন্সি এসএন্ডপি বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং কমিয়ে দিয়েছে। এর ফলে চার ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে: ঋণ প্রাপ্তির খরচ বৃদ্ধি, টাকার মূল্যমান হ্রাস, বৈদেশিক বিনিয়োগ হ্রাস ও আন্তর্জাতিক অর্থবাজারে অংশগ্রহণের সুযোগের সংকোচন। এর কোনোটাই খুব ভালো কথা নয়।

সমস্যা আরও আছে। অভ্যন্তরীণ খাতে, বিশেষত পোশাকশিল্পে, উৎপাদন হ্রাস, রেমিট্যান্সের কমতি, ব্যাংকিং খাতে তারল্যসংকট ইত্যাদি আমাদের আরও কঠিন গ্যাঁড়াকলে ফেলে দিতে পারে। বিনিয়োগ খাতে দেখা দিতে পারে অনাস্থা। দিতে পারে কেন বলছি, সেই অনাস্থার প্রকাশ ইতিমধ্যেই দেখছি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন আমাদের অন্যতম বাণিজ্যিক অংশীদার। ইইউ বাংলাদেশের সঙ্গে ‘পার্টনারশিপ অ্যান্ড কো-অপারেশন অ্যাগ্রিমেন্ট’ সম্পাদনে অনাগ্রহ দেখিয়েছে। কারণ, চলতি রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা। ব্রিটিশ পার্লামেন্টেও আমাদের রাজনৈতিক হানাহানি নিয়ে কথা উঠেছে। শ্রমিকদলীয় বাংলাদেশি-ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য রূপা হক বিক্ষোভ দমনে বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন, ‘এই সরকারকে আমরা বিশ্বাস করতে পারি না।’

অনুমান করি, ইউরোপীয় বিনিয়োগকারীদের মনোভাব খুব ভিন্ন কিছু নয়। একজন বাংলাদেশি-আমেরিকান বাজারবিশেষজ্ঞ আমাকে বলেছেন, এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে আকর্ষণীয় বিনিয়োগ ঠিকানা হিসেবে বাংলাদেশ তার স্থান হারাবে। অনিশ্চয়তার মুখে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে নতুন বিনিয়োগে আগ্রহী হবে না। তারা বরং শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম বা ওমানে ছুটবে, যেখানে বাংলাদেশের সমমান বা তার চেয়েও আকর্ষণীয় শর্তে বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে।

অর্থনীতির এই হাল সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে, তা বলাই বাহুল্য। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিদের অনুরোধ করা হচ্ছে তাঁরা যেন সরাসরি, আরও বেশি পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠান। ইন্টারনেট যদি বন্ধ থাকে, সে অর্থ তাঁরা কীভাবে পাঠাবেন?

অন্য বড় সমস্যা আন্তর্জাতিক চাপ। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, একাধিক বিদেশি সরকার ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ছাত্র বিক্ষোভ দমনে ব্যাপক শক্তির ব্যবহারের তীব্র নিন্দা করেছে। জাতিসংঘ বলেই দিয়েছে, শক্তি ব্যবহার নিয়ে সরকার যে ব্যাখ্যা দিয়েছে তা তারা বিশ্বাস করে না, তাদের কাছে ভিন্ন প্রমাণ রয়েছে। আরও শক্তভাবে সরকারের প্রতি তার অনাস্থার কথা জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। তারা মৃতের যে হিসাব সরকার দিয়েছে, তা সত্য নয় বলে জানিয়েছে। সবচেয়ে বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বিক্ষোভ দমনে জাতিসংঘ শান্তি মিশনের যান ব্যবহারে। ভুলে মুছে দেওয়া হয়নি বলে পররাষ্ট্র দপ্তর যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তা খুবই হাস্যকর। ভাবা হচ্ছে, খুব সচেতনভাবেই, আন্তর্জাতিক অনুমোদন প্রমাণের জন্য এই যান ব্যবহার করা হয়েছে।

বাংলাদেশের ওপর বিদেশি সরকার বা সংস্থার এই চাপ উপেক্ষা করা কঠিন। আমরা চীন নই, তিয়েনআনমেন চত্বরে রক্তপাত ঘটানোর পর বিদেশি সমালোচনা উপেক্ষা করার শক্তি তার আছে, সে শক্তি আমাদের নেই। আজ হোক অথবা কাল, অর্থ অথবা অস্ত্রের জন্য সেই বিদেশিদের কাছেই হাত পাততে হবে।

এই অবস্থায় সংকটের আশু সমাধানের কথা আমাদের ভাবতে হবে। চলতি ক্ষমতাসীন মহলের পক্ষে এই সমস্যা সমাধান করা সম্ভব, এ বিষয়ে বিক্ষোভকারীদের মধ্যে প্রবল সন্দেহ রয়েছে। যে সরকার তাদের ‘পাখির মতো গুলি করে মারে,’ তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় বসার আগ্রহ তাদের নেই। ‘হারুনের ভাতের হোটেলে’ বন্দুক ঠেকিয়ে আন্দোলন প্রত্যাহারের যে নাটক করা হয়েছে, তাতে সরকারের সদিচ্ছার ব্যাপারে সন্দেহ আরও গভীরতর হয়েছে। ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ থেকে অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদকে বদলি করে সরকার শুধু তাদের ভুল সিদ্ধান্ত স্বীকার করে নিয়েছে, কিন্তু তাতে সংকটের মোচন হয়নি।

তাহলে এই সংকট থেকে বেরোনোর পথ কী?

এই পরিস্থিতিতে অশাসনতান্ত্রিক কোনো পক্ষ সুবিধা নিক বা ক্ষমতা গ্রহণ করুক, তা কাম্য নয়। তাহলে এই সংকট গভীরতর হবে। সে অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। অতএব আমাদের ভিন্ন উপায় ভাবতে হবে। অতীতের অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে বলছি, সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি রাজনৈতিক সমাধান বা বন্দোবস্তে আসতে হবে।

একটি অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার ধরনের কিছু করা যায় কি না, তা নিয়ে ভাবতে হবে। যদিও এ ধরনের জাতীয় সরকার আগে কখনো এ দেশে হয়নি। যদি তেমন কিছু করা যায়, তবে এই স্বল্পমেয়াদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে এজেন্ডা থাকবে একটাই—চলতি সংকট সমাধানে আশু ব্যবস্থা এবং একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা। তবে সবকিছুর আগে এ ধরনের একটি সরকারের ব্যাপারে সবাইকে একমত হতে হবে।

প্রথম আলো