মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: শনিবার ১০, অগাস্ট ২০২৪

‘সেই তো পালালি, শুধু শুধু লোক হাসালি’

Share on:

সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি আলোচিত-সমালোচিত বিষয় হলো সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন। নিকট অতীতেও আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি সংস্কারের জন্য আন্দোলন করেছিল।


সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি আলোচিত-সমালোচিত বিষয় হলো সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন। নিকট অতীতেও আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি সংস্কারের জন্য আন্দোলন করেছিল। সে আন্দোলনে তারা কোনোভাবেই দাবি করেনি যে, সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি পুরোপুরি বাতিল করতে হবে। কিন্তু তদানীন্তন সরকার খানিকটা আগ বাড়িয়েই ২০১৮ সালে এক পরিপত্র জারির মাধ্যমে পুরো কোটা পদ্ধতিই বাতিল করে দেয়। যা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের জন্য এক মহাবিজয় বা মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মতোই মনে হয়। মনে করা হয়েছিল যে, সরকারি চাকরিতে কোটা বিষয়ক জটিলতার একটা স্থায়ী সমাধান হয়ে গেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের পিছু ছাড়েনি। কারণ, সরকারের জারিকৃত পরিপত্রে সংক্ষুব্ধ হয়ে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের পক্ষে দেশের উচ্চ আদালতে মামলা করা হয়। ফলে বিষয় নিয়ে নতুন জটিলতা সৃষ্টি হয়। যা কারো কাম্য ছিল না।

অবশ্য আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা দাবি করেছেন যে, তারাও বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি বাতিলে দেশের উচ্চ আদালতে মামলা করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু মামলাটি এই বলে প্রত্যাখ্যাত হয় যে, চাকরিতে কোটা দেয়া না দেয়ার এখতিয়ার সম্পূর্ণ সরকারের। তাই এ বিষয়ে আদালতের কিছু বলার নেই। কিন্তু সরকার পরিপত্র জারি করে কোটা বাতিল কার পর সরকারি পরিপত্র চ্যালেঞ্জ করে করা মামলা আদালতে গৃহীত হয়েছে। বিষয়টি পুরোপুরি আদালতের এখতিয়ারভুক্ত। তাই আদালতের সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। কিন্তু আদালত পরিপত্র বাতিল করে রায় ঘোষণার পর আওয়ামী সরকার যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তাতে বিষয়টির স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। কারণ, ঘোষিত রায়ে সরকারি পরিপত্র বাতিল হলেও সরকার এই রায়ে খুশি হয়েছে বা স্বাগত জানিয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের মন্ত্রীদের কথাবার্তায় এমনটিই মনে হয়েছে। যা জনমনে রীতিমতো সন্দেহের সৃষ্টি করেছে।

মূলত আদালতের রায়ের পর সাধারণ শিক্ষার্থীরা যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তাতে সরকার পক্ষ তো উষ্মা প্রকাশ না করে রীতিমতো খুশিই হওয়ার কথা। কারণ শিক্ষার্থীরা কোটা পদ্ধতি বাতিল করার দাবি জানিয়ে সরকারের জারিকৃত পরিপত্রের প্রতিই সমর্থন জানিয়েছে। তাই এই বিষয়ে সরকারের সাথে শিক্ষার্থীদের কোনো বিরোধ থাকার কথা নয়। কিন্তু সরকার পক্ষ শিক্ষার্থীদের সাথে গায়ে পড়ে ঝগড়া বাধিয়ে পুরো পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে বলেই মনে করা হচ্ছে। ফলে দেশের আত্মসচেতন মানুষ আদালতের ঘোষিত রায়কে সরকার প্রভাবিত হলে সন্দেহ করতে শুরু করেছেন। মূলত সাবেক সরকারই জনগণের কাছে বিচার বিভাগকে বিতর্কিত করে তুলেছে। আর সার্বিক দিক বিবেচনায় এ দায় সরকার কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।

কোটা বিষয়ক জটিলতা নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার শুরু থেকে দায়িত্বশীলতার পরিচয় ও ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিয়েছে। এমনকি তাদের উড়ণচন্ডী মনোভাবের কারণেই পুরো পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করে। শিক্ষার্থীরা কোটা পদ্ধতি পুরোপুরি বাতিল না চাইলেও সরকার তা বাতিল করে দেয়। এর মধ্যে ছিল সদ্য বিদায়ী সরকারের সুগভীর ষড়যন্ত্র। অথচ আমাদের দেশের সংবিধানে অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠীর জন্য কোটার কথা বলা আছে। এতে অভিজ্ঞমহল থেকে সন্দেহ করা হচ্ছে যে, সরকারি পরিপত্র উচ্চ আদালতে বাতিল হওয়ার ফাঁকফোঁকর রেখেই সরকারি পরিপত্র জারি করা হয়েছে। বাস্তবেও হয়েছে তাই। অভিযোগ রয়েছে সরকার পক্ষ উচ্চ আদালতে পরিপত্র জারির পক্ষে জোরালো অবস্থান গ্রহণ করতে রহস্যজনকভাবেই বিরত থেকেছে। আদালতে কোটা বাতিলের প্রেক্ষাপটও সরকার যথাযথভাবে উপস্থাপন করেনি। মূলত আদালতে সরকারের কোনো জোরালো অবস্থান না থাকায় সরকারের ঘোষিত পরিপত্র আদালতে বাতিল হয় বলে মনে করেন অভিজ্ঞমহল। যা সরকারের রহস্যজনক ভূমিকার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।

সরকার পরিপত্র জারি করে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি পুরোপুরি বাতিল করলেও আমাদের সংবিধানের ২৯ (৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এই অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই (ক) নাগরিকের যেকোনো অনগ্রসর অংশ যাহাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করিতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে তাহাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান প্রণয়ন (খ) যে শ্রেণির কর্মের বিশেষ প্রকৃতির জন্য তাহা নারী বা পুরুষের পক্ষে অনুপযোগী বিবেচিত হয়, সেই রূপ যে কোন শ্রেণির নিয়োগ বা পদ যথাক্রমে পুরুষ বা নারীর জন্য সংরক্ষণ করা হইতে রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।’ সরকারি চাকরিতে বিভিন্ন পদে নিয়োগদানের জন্য এই দু’টি বিধান বা কোটা প্রচলন আছে। এখানে দেশের অনগ্রসর শ্রেণি, অঞ্চল, ধর্মীয় বা উপসম্প্রদায়গত শ্রেণি অথবা কর্মে নারী-পুরুষের প্রকৃতিভেদে মোট ৪টি কোটা প্রণয়নের সুযোগ রয়েছে। সংবিধানে ২৮(৪) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যেকোনো অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত করিবে না।’ মূলত এমনটাই হলো কোটার বিধান।

সংবিধানে মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ ২৬ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, এই ধারার বিধানাবলীর সহিত অসামঞ্জস্য সকল প্রচলিত আইন যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, এই সংবিধান প্রবর্তন হইতে সেই সকল আইনের ততখানি বাতিল হইয়া যাবে। ২. রাষ্ট্র এই ভাগের কোনো বিধানের সহিত অসামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো আইন প্রণয়ন করিবেন না এবং অনুরূপ কোনো আইন প্রণীত হইলে তাহা এই ভাগের কোনো বিধানের সহিত যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততোখানি বাতিল হইয়া যাইবে। সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে-সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সকল আশ্রয় লাভের অধিকারী। ২৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেÑ ১. কেবলমাত্র ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ ও নারী-পুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে নাগরিকের প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।

উপরের আলোচনা থেকে এ কথা স্পষ্টতই প্রমাণিত হয় আমাদের সংবিধানে পরোক্ষভাবে কোটার কথা বলা থাকলেও মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ের পূর্ব পর্যন্ত যে কোটা পদ্ধতি বিদ্যমান ছিল তা সংবিধানের সাথে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ নয়। আর কোটা পদ্ধতি এমনভাবে বিন্যস্ত ছিল যা কোনোভাবেই ইনসাফপূর্ণ ছিল না বরং বিশেষ বিশেষ শ্রেণি ও গোষ্ঠীকে অনৈতিক ও অসাংবিধানিক সুবিধা দেয়ার জন্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই এ কোটা পদ্ধতি প্রণয়ন করা হয়েছিল। যা ছিল সংবিধানের সাথেও সাংঘর্ষিক এবং ন্যায় ও ইনসাফের পরিপন্থী। আর বিদ্যমান পদ্ধতিতে মেধাবীদের সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ ছিল খুবই সীমিত।

নিকট অতীতের বিদ্যমান কোটা পদ্ধতিতে মেধাবীরা সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে বৈষম্যের শিকার হওয়ার কারণে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই সাধারণ শিক্ষার্থী, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু করে। শুরুতে সরকার এই আন্দোলনকে মোটেই পাত্তা দিতে চায়নি বরং রাষ্ট্রীয় শক্তির প্রয়োগ ও দলীয় শক্তির যুগপৎ ব্যবহার করে এই আন্দোলনকে ভিন্নখাতে নেয়ার চেষ্টা করে। ফলে সারাদেশে সৃষ্টি হয় এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির। এক্ষেত্রে হানাহানিও কম হয়নি। শেষ পর্যন্ত সরকার শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। শিক্ষার্থীদের দাবি ও বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি বাতিল হলেও এক্ষেত্রে সরকার রীতিমতো কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করে। সরকার শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে কোটা পদ্ধতি সংস্কার না করে পুরো কোটা পদ্ধতিই বাতিল করে দেয়। যা কোনোভাবেই সংবিধান সম্মত হয়নি বলে মনে করেন সংবিধান বিশেষজ্ঞরা। মূলত সরকার অনেকটা আইনের ফাঁক-ফোঁকর রেখেই বিদ্যমান কোটা কাঠামো বাতিল করে পরিপত্র জারি করে। যাতে বিষয়টি উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যায়। আমাদের চরম দুর্ভাগ্য যে, শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের পক্ষে সরকারি পরিপত্রের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেয়া হয়। এই মামলা খুব আন্তরিকতার সাথে পরিচালনা করা হয়নি বলে মহলবিশেষে অভিযোগও রয়েছে। আরও অভিযোগ রয়েছে, সরকার কোটা পদ্ধতি বাতিল করে জারিকৃত পরিপত্রের স্বপক্ষে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করেনি। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। দেশের উচ্চ আদালত সরকারি পরিপত্র বাতিল করে রায় দিয়েছে। কিন্তু এই রায়ে সরকার পক্ষ সংক্ষুব্ধ হওয়ার কথা থাকলেও তারা এই রায়ে বগল বাজাতে শুরু করেন এবং কোটা সংস্কারের দাবিদারদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অশোভনমূলক কথাবার্তা বলা শুরু করেন। ফলে জনমনে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নের সৃষ্টি হয় যে, আদালত ঘোষিত রায় সরকার প্রভাবিত যা ইচ্ছার প্রতিফলন। আর এ প্রশ্নের সৃষ্টি হওয়ার জন্য সরকারের উদাসীনতা ও দায়িত্বহীনতাকেই দায়ী করছেন আত্মসচেতন মহল।

কোটা সংস্কার, কোটা বাতিল ও পুনর্বহাল নিয়ে যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিল তা নিয়ে সরকার ও আন্দোলনকারীদের পরস্পর মুখোমুখি হওয়ার কোনো যৌক্তিক কারণ ছিল না। কারণ সরকার শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই কোটা পদ্ধতি বাতিল করে পরিপত্র জারি করেছিল। যা ছিল শিক্ষার্থীদের দাবির অনুকূলেই। তাই মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে যখন আপিল বিভাগে আপিল করা হয়, সরকার ও শিক্ষার্থীরা একই অবস্থানে অবস্থান করা যৌক্তিক ছিল। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে শিক্ষার্থী এবং সরকার মুখোমুখি অবস্থান গ্রহণ করে। এমনকি হয়ে ওঠেন একে-অপরের রীতিমতো প্রতিপক্ষ। যা সরকারের দ্বিচারিতা ও ফ্যাসীবাদী মানসিকতার পরিচয় বহন করে। অথচ সরকার ও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে যুগপৎভাবেই লড়া উচিত ছিল। কিন্তু আমাদের চরম দুর্ভাগ্য এত সহজ সমীকরণ থাকা সত্ত্বেও সরকার ও আন্দোলনত শিক্ষার্থীরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারেননি বরং পরস্পর বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করার কারণেই গোটা দেশই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ফলে প্রভূত সংখ্যক লোকের প্রাণহানি এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদহানির ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারকে সারাদেশে জরুরি অবস্থা গ্রহণ করতে হয়েছে। বন্ধ করতে হয় ইন্টারনেট পরিষেবাও। একটি অতি সামান্য বিষয়কে কেন্দ্র করে প্রভূত সংখ্যক প্রাণহানি ও গোটা দেশ অচল হওয়ার ঘটনা অতীতে কখনো হয়েছে বলে জানা যায় না।

কোটা সংস্কার বিষয়ক আন্দোলন; যে আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সরকার কর্তৃক পরিপত্র জারি করে পুরো কোটা বাতিল, বাতিলাদেশের বিরুদ্ধে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগে রিট মোকদ্দমা দায়ের ও রায়, রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল এবং কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন কর্মসূচি মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে স্বারকলিপি এবং ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। মূলত দু’দিনের আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক। কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এসব কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করার কোন সুযোগ নেই। কিন্তু এক্ষেত্রে ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে সরকার পক্ষেরই। সরকার শিক্ষার্থীদের কোন পাত্তাই দেয়নি বা স্বাভাবিক মেনে নেয়নি বরং তারা এ আন্দোলন নিয়ে রীতিমত তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছে। এমনকি বল প্রয়োগের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমনের হুঙ্কারও দেয়া হয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শান্তিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও দ্রুত সার্বিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। আর এর মধ্যেই ঘটে গেছে এক দুঃখজনক ঘটনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনত শিক্ষার্থীর ওপর চালানো হয়েছে নির্মম ও নিষ্ঠুর হামলা। ফলে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে। সারাদেশে ছাত্রবিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে এবং একপর্যায়ে তা ধ্বংসাত্মক রূপ নেয়। এতে পুরো দেশই অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। এতো কিছুর পরও ক্ষমতাসীনদের বোধদয় ঘটেনি বরং তারা শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবিগুলোকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে। আন্দোলন জোরাল হয়ে উঠলে তারা ‘আদালতের বাইরে কিছু করা সম্ভব নয়’ বলে জিদ ধরে বসেন। এমতাবস্থায় শিক্ষার্থীরা সারা দেশে কমপ্লিট সাটডাউন কর্মসূচি ঘোষণা করলে সার্বিক পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়। ছাত্র আন্দোলনে গোটা দেশই অচল হয়ে পড়ে। আন্দোলন দমাতে পুলিশ গুলি ছুড়তে হয়। ফলে সারা দেশেই ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার পোড়মাটি নীতি গ্রহণ করে। সে ধরাবাহিকতায় সরকার সারাদেশে জরুরি অবস্থা, বিজিবি ও সেনা মোতায়েন করে। কিন্তু সরকার শুরু থেকে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিলে এই ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পারতো। এভাবে ঝরে পড়ত না এতগুলো তাজা প্রাণ।

তবে এ বিষয়ে সরকারের শেষ রক্ষা হয়নি বরং বিষয়টি নিয়ে তারা রীতিমত ত্রাহিমধুসূদন অবস্থায় পড়ে। অনেকটা বাধ্য হয়েই তারা এ বিষয়ে ইতিবাচক হয়ে ওঠেন। যা সরকারের বোধদয় বা বিলম্বিত উপলব্ধি বলে মনে করা হলেও বাস্তবতা ‘ঠেলার নাম বাবাজী’ বলেই মনে করা হচ্ছে। বাধ্য হয়েই তারা শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টে আপিল বিভাগে শুনানি এগিয়ে আনেন। সরকার আন্দোলনত শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের রায় বাতিলের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। মূলত সরকারের বাধ্য হয়ে ইতিবাচক অবস্থানের কারণেই সুপ্রিম কোর্টের আপ্রিল বিভাগ হাইকোর্টে রায় বাতিল করে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি সংস্কার করে রায় প্রদান করেন। রায়ে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৫%, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ১% এবং প্রতিবন্দী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১% সংরক্ষণের আদেশ প্রদান করা হয়। যা শিক্ষার্থীদের দাবির সাথে প্রায় সঙ্গতিপূর্ণ। অথচ সরকার চলমান সমস্যা সমাধানে পূর্ব থেকেই আন্তরিক হলে দেশ ও জাতিকে এতো বড় মূল্য দিতে হত না। প্রাণহানির ঘটনাও ঘটত না ব্যাপকভাবে। কিন্তু স্বৈরাচারি ও বাকশালীদের সে সৌভাগ্য নয়নি। ফলে ঝড়ে পড়েছে অগণিত তাজা প্রাণ।

রাষ্ট্র একটি বৃহৎ প্রতিষ্ঠান। কোনো স্বাধীন রাষ্ট্রে একাধিক স্বাধীনসত্তা থাকতে পারে না। রাষ্ট্রভেদে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গ প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীন বলে দাবি করা হলেও তা রাষ্ট্রের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে। রাষ্ট্র যদি অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীনভাবে চলতে দেয় তাহলেই এসব প্রতিষ্ঠান স্বাধীনভাবে চলতে পারে। যার বাস্তব প্রমাণ সরকারি চাকরি বিষয়ক মহামান্য আপিল বিভাগের সাম্প্রতিক রায়। যা সবার জন্য শিক্ষণীয়। এরপরও যারা বিষয়টিকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পারছে না, তাদের আর কখনোই বোধদয় হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। মূলত ‘আকলমান্দ কী লিয়ে ইশারা কাফি’।

যা হোক শিক্ষার্থীদের কোটা বিষয়ে আন্দোলন নিয়ে সরকার যেভাবে ইঁদুর-বিড়াল খেলার আশ্রয় নিয়েছে তা বিজ্ঞচিত হয়নি বলেই মনে করেন অভিজ্ঞ মহল। সরকার বিষয়টি নিয়ে পয়েন্ট অব নো-রিটার্নে গেলেও শিক্ষার্থীদের তীব্র আন্দোলনের যে অবস্থান ধরে রাখতে পারেনি বরং তাদেরকে একসময় রাস্তায় নামতেই হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিয়ে অনেককে ‘নাকে খত’ দিয়ে বিষয়টির সুরাহা করতে হয়েছে। কিন্তু তাতেও সমস্যার সমাধান হয়নি বরং জটিলতা আরো বেড়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলন রূপ নিয়েছে ৯ দফায়। পরে তা সরকারের পদত্যাগের একদফায় এসে ঠেকেছে। কিন্তু এতেও স্বৈরাচারি ও ফ্যাসীবাদী শক্তির বোধদয় হয়নি বরং তারা পেশিশক্তির জোরেই ক্ষমতায় টিকে থাকার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়েছে। এতে দেশে ব্যাপক হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হলেও অগণতান্ত্রিক ও জনগণের ম্যান্ডেটবিহীন সরকারের শেষ রক্ষা হয়নি বরং সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে লজ্জাজনকভাবে পদত্যাগ করে দেশ থেকে রীতিমত পলায়ন করতে হয়েছে। যা তার ব্যক্তিত্ব ও পদমর্যাদার সাথে মোটেই সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। এমনকি মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী ও প্রাচীন রাজনৈতিক দলের দাবিদার আওয়ামী লীগের জন্যই রীতিমত বিব্রতকর।

কোটা সংস্কার বিষয়ক আন্দোলনকে আওয়ামী লীগ সরকার কোনভাবেই গুরুত্ব দেয়নি বরং ‘ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা’ করার ফ্যাসীবাদী ও স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতা থেকেই নিজেরাই নিজেদের জন্য মরণফাঁদ তৈরি করেছে। অথচ তারা বাস্তবতা উপলদ্ধি করতে পারলে অবস্থা ভিন্নতর হতে পারতো। আওয়ামী লীগ নিজেদের আত্মসম্মান বজায় রেখেই সমস্যার যৌক্তিক সমাধানের সুযোগ ছিল কিন্তু তাদের আপোষহীন ও মাফিয়াতান্ত্রিক মনোভাবের কারণেই তা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকারকে আপোষ করতেই হয়েছে। বিদায় নিতে হয়েছে অত্যন্ত লজ্জাজনকভাবে। তাই তো রসিক জনকে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘সেই তো নথ খসালি, শুধু শুধু লোক হাসালি।’ যা সকল অগণতান্ত্রিক ও ফ্যাসীবাদী শক্তির আগমী দিনের করণীয় নির্ধারণে যথাযথ সহায়ক বলে মনে করেন দেশের আত্মসচেতন মানুষ।

দৈনিক সংগ্রাম