মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: শুক্রবার ২, অগাস্ট ২০২৪

সাইবার জগৎ ও সাম্প্রতিক সাইবার যুদ্ধ

Share on:

আশির দশকের কথা। বাংলাদেশের সেনানিবাসগুলোতে তখন হাতেগোনা কয়েকটি ভবনের দুই-একটি কক্ষে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বা এসি ছিল। কারও বাসায় তখন এসি দেখেছিলাম বলে মনে পড়ে না। এমন পরিস্থিতিতে প্রতিটি সেনানিবাসেই হঠাৎ একটি করে কক্ষে এসি বসানোর সিদ্ধান্ত হলো।


শুধু এসি নয়, মেঝেতে চিরাচরিত কার্পেটের বদলে প্লাস্টিকের বিশেষ মেট বসল। বাইরের আলো ও ধুলোবালি প্রতিরোধের জন্য গাঢ় রঙের ভারী পর্দা লাগানো হলো। দিনরাত ২৪ ঘণ্টা বিশেষ প্রহরী নিয়োগের ব্যবস্থা করা হলো। সবাই বলাবলি করতে লাগল, কে এই ভিআইপি, যিনি আসার আগেই এত আয়োজন?

না, কোনো ভিআইপি নয়। এমনকি কোনো মানুষও নয়। সে বিশেষ কক্ষে ঠাঁই পেল দুই-তিনটি করে কম্পিউটার। সব সেনানিবাসে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চৌকস দুই-তিনজন অফিসারকে ঢাকায় পাঠানো হলো কম্পিউটারের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য। তারা প্রশিক্ষণ নিয়ে এলেন। সে কী ভাব তাদের! এরপর নির্বাচিত কয়েকজনকে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করলেন। সেই কম্পিউটার রুমে ঢুকতে হতো হাত-মুখ ধুয়ে ও জুতা-স্যান্ডেল খুলে। অনুমতি ছাড়া কিছু স্পর্শ করা যেত না।

এক দিন সাহস করে এক সিনিয়র অফিসারকে জিজ্ঞেস করে ফেললাম—স্যার, এই দেশে এত মানুষ! এখানে কম্পিউটার দিয়ে কী হবে? সবাই বেকার হয়ে যাবে না? বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসা ওই সিনিয়র মহাজ্ঞানীর মতো ভাব নিয়ে উত্তর দিলেন, ভবিষ্যতে অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করবে এই কম্পিউটার? এমনকি সাইবার ওয়ার নামে এক ধরনের যুদ্ধ হবে। আমিও বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ালাম। বললাম—ইয়েস স্যার, থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। কিন্তু বুঝলাম না কিছুই।

এরপর কেটে গেছে প্রায় চার দশক। চাকরি ছেড়েছি তাও দুই দশক। বদলে গেছে অনেক কিছুই। আজন্ম শিল্প, সাহিত্য, ইতিহাস আর রাজনীতি নিয়ে পড়ালেখা করা আমিও মোবাইল, কম্পিউটার, ইন্টারনেট ছাড়া জীবন চিন্তা করতে পারি না। তবে সাইবার জগতে কতটা ডুবেছিলাম, তা বুঝেছি ২৪/৭-এ; অর্থাৎ ২৪ সালের সপ্তম মাসের (জুলাই) ২৪ তারিখে। বিদেশে সপ্তাহের সাত দিন ও রাতদিন ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে এমন বিপণিবিতান ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে ২৪/৭ আখ্যা দেওয়া হয়। বাংলাদেশের ২৪ সালের সপ্তম মাসের ইতিহাস কীভাবে আখ্যায়িত হবে, তা হয়তো সময় বলে দেবে। তবে সপ্তাহজুড়ে ২৪ ঘণ্টা চোখের পাতা এক করতে পারেননি এমন অসংখ্য মানুষের কথা হয়তো কোনো দিনই ভুলবে না সচেতনসমাজ। আজ এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ১৬ জুলাই রংপুরে পুলিশের গুলিতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আবু সাঈদ নিহত হওয়ার পরবর্তী ২৪ ঘণ্টা যে বাংলাদেশ আমরা দেখেছি, সে বাংলাদেশ অনেকেরই অচেনা ছিল। আনুমানিক ২৪ বছরের যুবক আবু সাঈদ যেন চাবুক মেরে এক ঘুমন্ত পৃথিবীকে জানিয়ে দিয়েছে, এ যুগের তরুণসমাজ বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে সরে ২৪ ঘণ্টা সাইবার জগতে ঘুমিয়ে থাকে বলে যে ধারণা ছিল, তা ভুল। তারা জেগে আছে এবং এই পৃথিবীর সবকিছুই বুঝে। তাদের সাইবার জগৎই এখন চালিকাশক্তি।

বছরে আগস্ট মাসে বাংলাদেশে শোকের আবহ থাকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় ২৪ জনের মৃত্যু ও ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট বাংলাদেশের ৬৩ জেলায় সিরিজ বোমা হামলা আমাদের জাতীয় ঐক্য, সংহতি ও নিরাপত্তাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে। বিশ্ব ইতিহাসে দেখা যায়, ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট হিরোশিমায় ও ৯ আগস্ট নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপসহ বহু গণহত্যা, প্রাণঘাতী যুদ্ধ ও দুর্ঘটনার কারণে আগস্ট একটি অভিশপ্ত মাস বলে বিবেচিত। আগস্টের আগের মাস জুলাই। এতদিন বাংলাদেশের হলি আর্টিসান বেকারিতে ২০১৬ সালের ১ জুলাই জঙ্গি হামলা ও দেশি-বিদেশি নাগরিকদের হত্যার ঘটনা এই জুলাই মাসটিকেও কলঙ্কিত করে রেখেছিল। সেই কলঙ্ককে অনেকগুণ বাড়িয়ে জুলাই একটি কালো মাসের তকমা পেল।

সব ছাপিয়ে ২৪/৭ অর্থাৎ ২৪ সালের সপ্তম মাস বিশেষ স্মরণীয় হয়ে থাকবে সাইবার যুদ্ধের কারণে। যে যুদ্ধের কথা প্রথম শুনেছিলাম ৪০ বছর আগে অর্থাৎ সেই আশির দশকে, সামরিক পোশাক পরা শুরুর দিনগুলোতে। এবারের সাইবার যুদ্ধের শুরুটা হয়েছিল সাইবার জগতেরই এক বাঘা যোদ্ধার (সাংবাদিকের) প্রশ্ন ও তার উত্তরকে কেন্দ্র করে। চোখের পলক পড়ার আগেই যেন মন্ত্রী পলকের মন্ত্রণালয়ের কল্যাণে প্রতিষ্ঠিত সাইবার অবকাঠামো যোগে সেই তথ্য পৌঁছে গেল আন্দোলনরত কোটি তরুণ-তরুণীসহ আবালবৃদ্ধবণিতার কাছে।

তবে এখানেও সামান্য সাইবার যুদ্ধ হলো। কেউ কেউ দাবি করেন, সাংবাদিকের প্রশ্নটি বাদ দিয়ে শুধু উত্তরটি এমনভাবে সাইবার জগতে ছড়িয়ে দেওয়া হলো, যা এ যুগের তরুণসমাজ পছন্দ করেননি। অন্যদিকে সেই উত্তরটিকে আবার উপজীব্য করে এবং উত্তরের আগের অংশ ও পরে অতিরিক্ত কিছু শব্দ যোগ করে ঝাঁজালো স্লোগান রচনা করল তরুণসমাজ এবং গলা ছেড়ে সেই স্লোগান দিয়ে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে দিল। এরপর আরেকটি সাইবার যুদ্ধের অভিযোগ আসে। বলা হয়, তরুণসমাজ প্রকৃতপক্ষে যে স্লোগানে আকাশ বাতাস ভারী করেছিল, তার শেষ অংশটুকু বাদ দিয়ে বাজারে ছড়িয়ে দেয় সরকারি সাইবার যোদ্ধারা। এতে স্লোগানের অর্থই পাল্টে যায় এবং এই অর্থ স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষে চলে যায়। ফলে বিপরীত মেরুতে চলে যায় দুটি পক্ষ।

এ সময় সাইবার জগতে ছড়িয়ে পড়া গুরুত্বপূর্ণ এক রাজনীতিবিদের বেফাঁস মন্তব্য আগুনে ঘি ঢালে। তার মতে, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষ শক্তিকে শায়েস্তা করতে স্বাধীনতা সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা তার দলের ছাত্র সংগঠনই যথেষ্ট। এই ছাত্র সংগঠন তখন কারও ইশারায় কিংবা কোনো কোনো নেতা-নেত্রীকে খুশি করতে মাঠে নামে। বরাবরের মতো পুলিশও ছিল এমন ভূমিকায়, যা আবার তরুণসমাজ মেনে নিতে পারেনি। এরপরের ইতিহাস জ্বালাও, পোড়াও, ধ্বংস, হত্যা, আগুন, লুটপাট, টিয়ার গ্যাসের শেল, গুলি, দুই শতাধিক মৃত্যু, অসংখ্য নিখোঁজ আর সহস্র আহতের আর্তনাদের করুণ উপাখ্যান।

এর মধ্যে সাইবার জগতের প্রতীকী স্থাপনা সরকারি টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মাণ ও সম্প্রচার কেন্দ্র (বিটিভি ভবন) এবং জাতীয় ডাটা সেন্টারে আগুন দিয়ে লুটপাট করা হলো। আগুন জ্বালিয়ে ধ্বংস করা হলো মেট্রো রেলস্টেশন, টোল প্লাজা, সেতু ভবনসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। নির্বিচারে হতাহতের শিকার হলেন সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারী, শিক্ষক, আইনজীবী, কর্তব্যরত পুলিশ, সাধারণ ছাত্রছাত্রী, ঘরে থাকা শিশু, মহিলা, সাধারণ মানুষসহ প্রতিবাদী ছাত্রছাত্রীরা। ধনসম্পদের হিসাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হয়তো হাজার হাজার কোটি টাকা। তবে মানুষের জীবনের হিসাবে এ এক অপরিসীম, অমূল্য ক্ষতি। এ শুধু যার যায়, সে-ই বুঝে।

বন্ধ হয়ে যায় সরকারি টেলিভিশনে সম্প্রচার আর ইন্টারনেট সংযোগ। এবার সাইবার জগতের যুদ্ধ কিছুটা বন্ধ হলেও শুরু হয় গুজবের সুনামি। কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রী পালিয়ে যাবেন, এমনকি পালিয়ে গেছেন বলেও গুজব রটায়। শেষমেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীসহ আধাসামরিক সব বাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হস্তক্ষেপে পরিবেশ ধীরে ধীরে শান্ত হতে থাকে।

এ ঘটনায় নিরাপত্তার দুটি দুর্বলতা ঘুরেফিরে আলোচনায় আসছে বারবার। প্রথমত বাংলাদেশ টেলিভিশন অবকাঠামোতে কী করে এমনটা ঘটানো সম্ভব হলো? অবকাঠামো ধ্বংস না করে হামলাকারীরা প্রধানমন্ত্রীর পালানোসহ কোনো একটি স্পর্শকাতর গুজব যদি টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করত, তাহলে কী ঘটত? মনে পড়ে ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট টেলিভিশন ও রেডিও সম্প্রচার কেন্দ্র দখল করে বিপথগামীরা কী ঘোষণা দিয়েছিল, আর কী ছিল সেই ঘোষণার প্রভাব। সুতরাং বাস্তবিক ও সাইবার হামলা থেকে রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যমকে আরও সুরক্ষা বলয়ে রাখতে হবে।

দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো আমাদের ইন্টারনেট সংযোগ বা সেবা আজ কতটা নিরাপদ? কার হাতে এই নিরাপত্তার দায়িত্ব? আকাশে স্যাটেলাইট, ভূমিতে ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রসহ লক্ষ-কোটি ডাটা সেন্টার ও সার্ভার, মাঠে মাঠে মোবাইল ফোনের টাওয়ার, সমুদ্রের তলদেশে মেরিন কেবল, উপকূলে মেরিন কেবল ল্যান্ডিং স্টেশন—কে কোথায় কীভাবে এই ইন্টারনেট অবকাঠামোগুলোর নিরাপত্তা দিচ্ছেন? নাকি ইন্টারনেট খোলা আকাশের মতোই নিরাপদ? যদি তাই হয়, আমরা কেন ইন্টারনেট থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম? যে ইন্টারনেট ছাড়া আমদানি-রপ্তানি অচল, ব্যাংকের লেনদেন ও রেমিট্যান্স আসা বন্ধ, মিডিয়া পঙ্গু, সেই ইন্টারনেট শুধু কি গুজব ছড়ানো ঠেকাতে বন্ধ ছিল? বাস্তবে ইন্টারনেট বন্ধের কী সুফল ও কুফল পেয়েছে দেশ ও জাতি? অন্যদিকে তখন ভিপিএনসহ আরও বহু প্রযুক্তির কথা মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে যায়। আসলে এখন আর তথ্য প্রবাহকে বাধা দেওয়ার কোনো সুযোগই কারও হাতে নেই। এটা মাথায় রেখেই তৈরি হতে হবে আগামী দিনের সাইবার ব্যবস্থা ও যোদ্ধাদের।

একটি বিদেশি টেলিভিশনের সংবাদ বিশ্লেষণে একজন মিডিয়া বিশেষজ্ঞ বলেন, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে নির্মিত শতসহস্র ফুটেজ বা কনটেন্ট তারা পেয়েছেন। স্যাটেলাইট ইমেজ ও অন্যান্য প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণ তথা পোস্টমর্টেম করে মাত্র তিনটি ফুটেজকে তাদের কাছে শতভাগ সঠিক বলে প্রতীয়মান হয়েছে। সেই তিনটি ফুটেজ তারা আবার বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থাসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পুনরায় মিলিয়ে দেখেছেন। তারপর ১০০ ভাগ নিশ্চিত হয়েই তারা সেই তিনটি ফুটেজ প্রচার করেছেন। এর একটি হলো রংপুরের আবু সাঈদের মৃত্যুর দৃশ্য। এরপরও যদি আবু সাঈদের মৃত্যুর পেছনে কোনো জজ মিয়াকে দায়ী করা হয়, তবে কেউই তা মানবে না। এটাই হলো আজকের মিডিয়া, এটাই হলো আজকের সাইবার যুদ্ধ। সুতরাং যারা যেভাবে তদন্ত করছেন, খতিয়ে দেখছেন, চার্জশিট সাজাচ্ছেন, প্রতিবেদন লিখছেন, অনুগ্রহ করে সাইবার জগতের সাহায্য নিন। নইলে মানুষই আবার সাইবার জগতের কল্যাণে আমাদের ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলবে। সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো না বলে এখন আর উপায় নেই। কোদালকে এখন কোদালই বলতে হবে, খননযন্ত্র বলে আর চালানো যাবে না। কারণ সাইবার জগৎ জীবন্ত ছবি আর হাজার হাজার তথ্য দিয়ে তরুণদের ঠিকই জানিয়ে দেবে—কোনটা কোদাল আর কোনটা খোদাইযন্ত্র। সুতরাং ভুলতে হবে আগের সব তন্ত্রমন্ত্র।

দৈনিক কালবেলা