মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: বৃহস্পতিবার ৫, সেপ্টেম্বর ২০২৪

শহীদ জিয়ার রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্য ও আজকের উদ্দীপ্ত বিএনপি

Share on:

আজকের বিশ্বে রাজনৈতিক দল হচ্ছে শাসন কাঠামোর কেন্দ্রবিন্দু। ‘আধুনিক গণতন্ত্র রাজনৈতিক দলের কাছে অকল্পনীয়ভাবে নিরাপদ।’ (স্কাটস্নাইডার : ১৯৪২ : ১) শাসনব্যবস্থা পরিচালনার জন্য রাজনৈতিক দল অপরিহার্য।


লর্ড ব্রাইস যৌক্তিকভাবেই বলেন, ‘রাজনৈতিক দল ছাড়া প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র কার্যকর করার আর কোনো পথ আজো উদ্ভাবিত হয়নি।’ (ব্রাইস : ১৯২১ : ১১৯) কাক্সিক্ষত রাষ্ট্রগঠনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলো পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। ‘তারা অর্জন করে রাজনৈতিক বৈধতা, হয়ে ওঠে সমঝোতার বাহন, নিশ্চিত করে জাতীয় সংহতি এবং আনে অব্যাহত স্থিতিশীলতা।’ (লাপলামবরা এবং উইনার : ১৯৬৬) রাজনৈতিক দলের আদর্শ, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনুযায়ী রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একটি জাতির ভৌগোলিক অবস্থান, জাতীয় পরিচিতি এবং সমসাময়িক পরিবেশ পরিস্থিতি রাষ্ট্রিক লক্ষ্যের নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায়। রাজনৈতিক দলগুলোর এই কার্যকলাপ সামাজিক বিজ্ঞানে ‘রাষ্ট্রগঠন’ বা ‘জাতিগঠন’ প্রক্রিয়া বলে অভিহিত। বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রত্যাশিত রাষ্ট্র বা জাতি গঠনে সবচেয়ে জনপ্রিয় দল বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর পাদভূমিতে দাঁড়িয়ে সেই লক্ষ্য উদ্দেশ্যের পুনঃঅনুরণন অনুভূত হচ্ছে বিপ্লব-পরবর্তী বাংলাদেশে।

১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর জিয়াউর রহমান বিএনপি গঠনের পর দীর্ঘকাল ধরে সরকার ও বিরোধী দল উভয় ক্ষেত্রে বিএনপি তার উদ্দিষ্ট সমৃদ্ধ রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বানসি কুবুথা (ইন্টারনেট ২০১৬), গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিক দলের পাঁচটি করণীয় নির্ধারণ করেছেন : ১. সমাবেশের স্বাধীনতার অগ্রায়ণ; ২. গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার উন্নয়ন; ৩. নাগরিক সাধারণকে সরকারি ব্যবস্থা সম্পর্কে অবহিতকরণ; ৪. ব্যক্তিস্বাধীনতা বিকাশ এবং ৫. ক্ষমতাসীন দলের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে বিএনপি গণতান্ত্রিক সমাজের লক্ষ্যে উল্লিখিত কার্যক্রম দায়িত্বশীলতার সাথে অব্যাহত রেখেছে। সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং গণতান্ত্রিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সবপর্যায়ে বিএনপি পালন করেছে নিরবচ্ছিন্ন ভূমিকা। যারা মনে করেন, বন্দুকের নল থেকে বিএনপির জন্ম তারা দেখেছেন বন্দুকের মুখে বিএনপির বিজয়। দেশের বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান সফল বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির উত্থানে বেগম খালেদা জিয়ার ভূমিকাকে মুখ্য মনে করেন। তিনি মন্তব্য করেন, She (Khaleda Zia) succeeded in transforming the BNP from a state sponsored sarkari party to an opposition party. (Rounaq Jahan: 2015: 31)

স্বাধীনতার পরপর যে রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় তা রাষ্ট্র বা জাতি গঠন প্রক্রিয়ার বদলে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সাধন করে। এ ক্ষেত্রে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে ‘জাতীয় সরকার’ অগ্রাহ্যকরণ ও পরবর্তীকালে ‘বাকশাল’ গঠন তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। ১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্টের ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে যে সামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, স্বাভাবিকভাবে তা রাষ্ট্রিক লক্ষ্য ও গণতন্ত্রের জন্য অনুকূল ছিল না। সামরিক কর্তৃত্বের পরিবর্তন এবং রাজনৈতিক শূন্যতায় রাষ্ট্রিক সঙ্কট দেখা দেয়। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার বিপ্লবে তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান জিয়াউর রহমান ক্ষমতার পাদপীঠে স্থাপিত হন। নিপাতনে সিদ্ধ ঘটনার মতো সেই ‘সৈনিক রাজনীতিবিদ’ হয়ে দাঁড়ান রাষ্ট্র গঠন বা জাতি গঠন প্রক্রিয়ার কর্ণধার। সামরিক বাহিনীর রাজনীতি অধ্যয়নের বিশ্ববিশ্রুত পণ্ডিত এস পি হান্টিংটন এ ধরনের ব্যক্তিত্বকে লক্ষ করে মন্তব্য করেন : A great leader is one, who can imagine, turning a conflict into equal opportunities for adversaries in a situation where people can make a living trading peacefully, violence become costly choices.

তৃতীয় বিশ্বে রাজনীতির প্রতিপাদ্য বিষয় ক্ষমতায় আরোহণ এবং প্রতিষ্ঠিত থাকার জন্য অনবরত প্রতিপক্ষের প্রতি আক্রমণ, মিথ্যাচার, কটাক্ষ এবং দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ। দলীয় সরকারের কাজ হয়ে দাঁড়ায়, ‘রাষ্ট্রীয় সম্পদের কর্তৃত্বপূর্ণ বণ্টন’। রাষ্ট্রের চিরস্থায়ী স্বার্থ ও সমৃদ্ধির বদলে ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থ প্রাধান্য অর্জন করে। ইতিহাস প্রমাণ করে, ‘বাংলাদেশকে সুস্থ, স্বাভাবিক, স্বাধীন, সার্বভৌম, শক্তিমান, সমৃদ্ধিমান ও প্রগতিশীল রাষ্ট্ররূপে গড়ে তোলার’ যথার্থ কর্মসূচি কোনো রাজনৈতিক দলই গ্রহণ করেনি। (আবুল কাশেম ফজলুল হক : ২০০৮) সৈনিক রাজনীতিবিদ জিয়াউর রহমান এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমধর্মী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। শাসন ক্ষমতায় জনগণকে সম্পৃক্ত করার জন্য তিনি যে রাজনৈতিক দল গঠন করেন তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় ‘রাষ্ট্র গঠন’ তথা জাতি গঠন। বিএনপির ঘোষণাপত্র, গঠনতন্ত্র ও নির্বাচনী ইশতেহার পর্যালোচনা করলে এই রাষ্ট্রিক লক্ষ্যই প্রতিভাত হয়।

গঠনতন্ত্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অংশের ২(ক) ধারায় বলা হয়েছে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদভিত্তিক ইস্পাতকঠিন গণ-ঐক্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা, রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা ও গণতন্ত্র সুরক্ষিত এবং সুসংহত করা।’ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে গঠনতন্ত্রের একই অংশের (ঙ) ধারায় বলা হয়েছে ‘এমন এক সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করা যেখানে গণতন্ত্রের শিকড় সমাজের মৌলিক স্তরে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হয়।’ বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান একজন সামরিক ব্যক্তিত্ব হওয়া সত্ত্বেও ব্যক্তিজীবনে ও জাতীয়পর্যায়ে গণতন্ত্রের প্রমাণ রেখেছেন। বাকশাল কর্তৃক বর্জিত বহুদলীয় গণতন্ত্র তিনি পুনঃপ্রবর্তন করেন। অথচ গণতন্ত্রের তথাকথিত মানসধারীরা গণতন্ত্রের কবর দিয়েছেন। স্বাধীনতার প্রাথমিক সময়কালে বিশেষত বিকারগ্রস্ত ব্যক্তিতন্ত্রের বিগত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগ যে নিকৃষ্ট কদাচার প্রকাশ করেছে তা অবর্ণনীয়। অথচ বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন, এমন উদাহরণ বিরল।

জিয়া যেমন কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নের দিকে দৃষ্টি দিয়েছেন, ঠিক তেমনি জাতির আস্থা, বিশ্বাস ও লালিত মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠা করেছেন। বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের জন্য নাগরিক পরিচয় সুনির্দিষ্ট করেছেন। সংবিধানের মৌলনীতির সংস্কার ঘটিয়ে বাস্তবতার প্রমাণ রেখেছেন। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিরাষ্ট্রীকরণ করে রাষ্ট্রকে বিপুল লোকসান থেকে রক্ষা করেছেন। পাশ্চাত্যমুখী উন্নয়ন কৌশল অনুসরণ করে শিল্পায়ন ও বিনিয়োগের অবারিত সুযোগ সৃষ্টি করেছেন। (সৈয়দ সিরাজুল ইসলাম : ১৯৮৬)। মুসলিম বিশ্বের সাথে বিশেষ সম্পর্ক স্থাপনে সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছেন। বাস্তবে বাংলদেশ জাতিরাষ্ট্র এই বিশেষ সম্পর্ক দিয়ে অভাবনীয়ভাবে উপকৃত হয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মান ও মর্যাদা বিশেষভাবে বৃদ্ধি পায়। ১৯৭৮ সালে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশের আসন লাভ উল্লেখযোগ্য ঘটনা। বাংলাদেশ সম্পর্কিত বিদেশী গবেষণায় এর স্বীকৃতি রয়েছে।

গতানুগতিক রাজনৈতিক কর্মসূচির পরিবর্তে গোটা জাতিকে উদ্বেলিত করার জন্য জিয়াউর রহমান দেশপ্রেমমূলক গণমুখী কার্যক্রম গ্রহণ করেন। খাদ্য উৎপাদন দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা নেন। খাল কাটার কর্মসূচি গ্রহণ করেন। নিজের সস্তা জনপ্রিয়তার কথা না ভেবে রক্ষণশীল বাংলাদেশ সমাজে জন্মনিয়ন্ত্রণের আহ্বান জানান। নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করেন। যুবকদের কর্মমুখী করার জন্য কার্যক্রমে তাদের সম্পৃক্ত করেন। জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সুদূরপ্রসারী চিন্তা থেকে ‘গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী’ গঠন করেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তালুকদার মনিরুজ্জামান এ পদক্ষেপকে সম্ভাব্য ‘সিটিজেন আর্মি’ বা নাগরিক সেনাবাহিনীর প্রথম পদক্ষেপ বলে মনে করেন। সামগ্রিকভাবে গোটা জাতির মুক্তি ও উন্নয়নের জন্য ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। গঠিত রাজনৈতিক দল-বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) রাষ্ট্রিক তথা সার্বিক লক্ষ্য হিসেবে এই ১৯ দফা কর্মসূচিকে গ্রহণ করা হয়।

বিএনপি ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় এই ১৯ দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিচ্যুতি যে ঘটেনি তা নয়। তবে নীতিগতভাবে ১৯ দফা কর্মসূচি এগিয়ে নেয়া হয়। এই কর্মসূচিকে যদি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে দেখা যাবে, এতে একটি আদর্শিক রাষ্ট্রীয় লক্ষ্য রয়েছে। প্রথমত, বাংলাদেশের স্বাধীনতা, অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার শপথ এখানে রয়েছে। দ্বিতীয় দফায় বর্ণিত প্রতিশ্রুতি এরূপ : ‘শাসনতন্ত্রের চারটি মূলনীতি অর্থাৎ সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি সর্বাত্মক বিশ্বাস ও আস্থা, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারে সমাজতন্ত্র জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে প্রতিফলন করা।

তৃতীয় দফায় একটি আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে গড়ে ওঠার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছে।

চতুর্থ দফায় বলা হয়েছে কৃষি উন্নয়ন ছিল জিয়াউর রহমান ঘোষিত কৃষি পরিকল্পনার অপরিহার্য অংশ। পঞ্চম অধ্যায়ে কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামীণ তথা জাতীয় অর্থনীতিকে জোরদার করার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। সপ্তম দফায় সবার জন্য অন্তত মোটা কাপড় সরবরাহ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। অষ্টম দফায় সব নাগরিকের জন্য বাসস্থান দেয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছে। ৯ নম্বরে জাতিকে নিরক্ষরতার অভিশাপমুক্ত করার কথা বলা হয়েছে।

১০ নম্বরে সব দেশবাসীর জন্য ন্যূনতম চিকিৎসার বন্দোবস্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। এভাবে পরবর্তী দফাগুলোতে নারীর যথার্থ মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, যুবসমাজকে জাতি গঠনে উদ্বুদ্ধকরণ, শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি সাধন, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ, স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণ এবং ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সব নাগরিকের অধিকার পূর্ণ সংরক্ষণ করার কথা বলা হয়েছে। সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে জনসেবা ও দেশ গঠনের মনোবৃত্তি গঠনে উৎসাহিত করার কর্মসূচি দেয়া হয়েছে। গতানুগতিক রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি থেকে অধিকাংশে ১৯ দফা কর্মসূচি একটু ভিন্নতর এই অর্থে যে, এখানে রাজনীতিকরণের চেয়ে রাষ্ট্রীয়করণের দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে। আরো স্পষ্ট করে বলা যায়, রাষ্ট্র গঠন অথবা জাতি গঠন প্রক্রিয়ায় সমাজকে অধিকতর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ১৯ দফার শেষের দিকে দুর্নীতিমুক্ত ও ন্যায়নীতিভিত্তিক সমাজব্যবস্থা কায়েমের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালানোর পরিকল্পনা ঘোষিত হয়েছে। এসব কর্মসূচির মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে একটি আত্মনির্ভরশীল, স্বকীয় সত্তায় উদ্ভাসিত জাতি হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য নির্ধারণ করে বিএনপি।

বিএনপি নিশ্চিতভাবেই দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল। বিগত কয়েক দশকে যেসব গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিজয়ী হয়েছে বিএনপি। তথাকথিত এক-এগারোর ষড়যন্ত্রের পর যেসব নির্বাচন হয়েছে তার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নির্বাচনকে নির্বাসনে পাঠিয়েছে। ২০১৪-এর ভোটারবিহীন নির্বাচন, ২০১৮-এর নিশীথ নির্বাচন এর প্রমাণ। সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তথা জুলাই বিপ্লবের পর সবাই বিশ্বাস করে, আগামী নির্বাচনে বিএনপি নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করবে। বিগত দেড় যুগে গুম, খুন, হত্যা, নির্যাতন ও নিপীড়ন সত্ত্বেও বিএনপির প্রতিবাদী অবস্থান সুদৃঢ় রয়েছে। শুধু ক্ষমতায় আরোহণ একটি রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য হতে পারে না। ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির যে বদনাম ছিল দীর্ঘ এক যুগের বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তা বদলে দিয়েছে। শত শত মানুষের রক্তঋণের মধ্য দিয়ে সূচিত হয়েছে নতুন অধ্যায়।

হামলা-মামলা, জেল-জুলুম ও অন্যায়-অত্যাচার বিএনপিকে অ্যাসিড টেস্টের মাধ্যমে খাঁটি সোনায় পরিণত করেছে। বিএনপির বিরুদ্ধে একটি বড় অভিযোগ এই যে, তারা জাতির আশা-আকাক্সক্ষার অনুকূলে গণ আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। তবে এতে কারো দ্বিমত নেই যে, বিএনপি তাদের ত্যাগ-তিতিক্ষা ও আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই আন্দোলনের ভিত্তিভূমি নির্মাণ করেছে। দেশ আজ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে একটি কঠিন সময় অতিক্রম করছে। বিএনপি আজ সফলতার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। কিন্তু বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র থেমে নেই। পরাজিত স্বৈরাচারের দেশজ প্রতিভূ এবং সম্প্রসারণবাদ নানা কূটকৌশলে বিএনপির নিশ্চিত বিজয়কে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্র করছে। দুঃসময়ের দিনগুলোতে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, শক্ত সংগঠন ও কর্মীবাহিনীর আত্মত্যাগ বিএনপিকে রক্ষা করেছে। তাই ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। সেই সাথে বিএনপি নেতৃত্ব ও সংগঠন রাষ্ট্র সংস্কারের গণদাবিকে এগিয়ে নিতে ইতোমধ্যেই ভিশন-২০৩০ গ্রহণ করেছে। দীর্ঘ দেড় দশকের দুঃশাসনের ফলে যে রাষ্ট্রিক সংস্কার অনুভূত হচ্ছে তা বিএনপি অনুমোদন করে। সেই লক্ষ্যে প্রফেসর ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ‘যৌক্তিক’ সময় দিতে প্রস্তুত বিএনপি। তবে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংস্কার কর্মসূচি ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চেয়েছেন। এক নদী রক্ত পেরিয়ে যে গণবিপ্লব অনুষ্ঠিত হয়েছে তার অনিবার্য লক্ষ্য হচ্ছে নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকার গঠন। প্রায় পাঁচ দশক আগে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যে গণমুখী ১৯ দফা কর্মসূচি দিয়েছিলেন তার ভিত্তিতে এবং গণদাবিকে সমন্বিত করে ভবিষ্যৎ নির্বাচিত বিএনপি সরকার নিশ্চয়ই প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন করবে। বর্তমান সময়-সমস্যা, পরিবেশ-পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে সব কিছু। ক্ষমতা লক্ষ্য কিন্তু ক্ষমতার রাজনীতিই যেন মুখ্য না হয়ে দাঁড়ায়। পতিত শাসক দলের বিপরীতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে একটি সুশাসন, ন্যায় ও সমতাভিত্তিক সমাজের একটি রূপকল্প তথা ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র গঠন পরিকল্পনা প্রস্তুত রয়েছে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জিল্লুর আর খানের একটি গ্রন্থের শিরোনাম হচ্ছে Bangladesh : Crisis to Crisis. সত্যিই আমাদের সঙ্কটকাল যেন শেষ হয় না। বিপ্লব-উত্তর বাংলাদেশ আরেক সঙ্কটময় সময় অতিক্রম করছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির ৪৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর পাদভূমিতে দাঁড়িয়ে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান জনগণকে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার আকুল আবেদন জানিয়েছেন। গণ অভ্যুত্থানের চেতনায় দেশে জবাবদিহির গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় গুরুত্ব দিয়েছেন। শুধু ক্ষমতার পরিবর্তন নয়, রাষ্ট্র ও রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন নিশ্চিত করাই এখন বিএনপির মূল লক্ষ্য বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বিএনপি নেতৃত্ব। প্রত্যাশিত নির্বাচনে জনগণের রায় পেতে মন জয় করার নির্দেশনা দিয়েছেন ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের কর্ণধার তারেক রহমান। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রিয় উচ্চারণ ছিল ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার, শেষ বাংলাদেশ, জীবন বাংলাদেশ, আমার মরণ বাংলাদেশ।’ বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের তাই হোক ব্রত।

দৈনিক নয়াদিগন্ত