শাসন ব্যবস্থায় সংসদীয় পদ্ধতির সংস্কার জরুরি
Share on:
বাংলাদেশের গণতন্ত্রের আখ্যানটি দেশের জটিল রাজনৈতিক ইতিহাস এবং আর্থসামাজিক চ্যালেঞ্জের প্রতিফলন। ঐতিহাসিক স্বাধীনতা সংগ্রাম, দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ও স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক শাসনের লক্ষ্যে নিরন্তর সংগ্রাম ও আন্দোলনের মধ্যে তার প্রতিফলন দেখা যায়।
স্বাধীনতার পর দেশের শাসন ব্যবস্থা হিসেবে ওয়েস্টমিনস্টার মডেলের সংসদীয় সরকার ব্যবস্থাকে গ্রহণ করা হয়েছিল। সেই সঙ্গে সংসদীয় তদারকি ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে মার্কিন কংগ্রেসের অনুকরণে মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির বিধান রাখা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে ব্রিটেন, ভারতসহ ওয়েস্টমিনস্টার মডেলের অন্যান্য দেশেও অনুরূপভাবে মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির বিধান প্রবর্তন করা হয়েছে।
স্বাধীনতার পর যে স্বপ্ন নিয়ে সংবিধানে বহুদলীয় সংসদীয় সরকার ব্যবস্থাকে গ্রহণ করা হয়েছিল, তা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ দীর্ঘ ১৫ বছর বারবার সামরিক অভ্যুত্থানে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়েছে। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর ঐকমত্যের ভিত্তিতে পুনরায় সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক আদর্শ এবং আকাঙ্ক্ষার পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, নির্বাহী বিভাগের আধিপত্য এবং জবাবদিহির অভাবে গণতান্ত্রিক নীতিগুলো সমুন্নত রাখা এবং নাগরিক অধিকার রক্ষার জন্য নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে।
নব্বই পরবর্তী সময়ে অনুষ্ঠিত সাতটি নির্বাচনের মধ্যে পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম ও নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে। কিন্তু প্রধান বিরোধী দল ও জোট সংসদ বর্জন এবং সরকার তার ইচ্ছামতো বিল পাস করার পথ বেছে নেওয়ায় সংসদীয় তদারকি কার্যক্রম দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ফলে প্রত্যাশা অনুযায়ী সংসদ কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেনি।
দশম সংসদ থেকে নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। দশম, একাদশ ও দ্বাদশ সংসদে কার্যকর বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল। সংসদীয় বিতর্ক, সাধারণ আলোচনা, রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর ধন্যবাদ জানিয়ে আলোচনা সর্বত্র প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যই প্রতিধ্বনিত হতো। প্রধানমন্ত্রীর হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, সংসদ সদস্যদের ওপর নিয়ন্ত্রণ, সম্পদ বণ্টনে কর্তৃত্ব, ব্যক্তিগত ক্যারিশমা ইত্যাদি কারণে প্রধানমন্ত্রী ক্রমান্বয়ে ‘সুপ্রিম লিডার’ হয়ে উঠেছিলেন। মন্ত্রিসভা ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যকার ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা কার্যত ‘প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকার ব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠিত করেছিল।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর শাসন নিরাপদ ও নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক এবং সামরিক-বেসামরিক এলিটদের নিয়ে যে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত গড়ে তুলেছিলেন; ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে তা ভেঙে পড়ে। নতুন এক রাজনৈতিক বন্দোবস্তের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সংসদ ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান রয়েছে। তবে আন্দোলনকারীরা মনে করেন, নির্বাচনের মাধ্যমে কোনো দলের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার আগে জবাবদিহি ও রাজনৈতিক শান্তি প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বিদ্যমান রাষ্ট্র কাঠামোর সংস্কার জরুরি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শপথ নেওয়ার পর রাষ্ট্রনৈতিক সংস্কারের বয়ানটি ক্রমান্বয়ে আরও জোরালো হয়ে উঠেছে। এ অবস্থায় জাতীয় সংসদকে শক্তিশালী করতে কিছু ক্ষেত্রে সংস্কার বা পরিবর্তন করা প্রয়োজন।
প্রথমত, নির্বাহী বিভাগ ও সংসদের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ জন্য একই ব্যক্তির দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ রহিত এবং সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংশোধন করে অর্থ বিল ও মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর ভোট প্রদান ব্যতীত অন্য সব ক্ষেত্রে সদস্যদের ভোটদানের স্বাধীনতা প্রদান করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের বিধান বাতিল করে রাজনৈতিক দলগুলোকে সাধারণ আসনে নির্দিষ্ট সংখ্যক (৩০% হতে পারে) নারী প্রার্থী মনোনয়নের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আরোপ করা যেতে পারে।
তৃতীয়ত, জাতীয় সংসদের মোট আসন সংখ্যা অপরিবর্তিত রেখে দেশের ৩০০টি একক নির্বাচনী এলাকা থেকে বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতিতে সদস্য নির্বাচন এবং ৫০টি আসনে আনুপাতিক ভোটের ভিত্তিতে দলীয় তালিকা থেকে সদস্য নির্বাচনের ব্যবস্থা প্রবর্তন। এতে নির্বাচনী এলাকায় নতুন নেতৃত্বের পথ সুগম হবে।
চতুর্থত, সাধারণ আসনের পরিবর্তে দলীয় প্রার্থী তালিকা থেকে নির্বাচিত সদস্যদের মধ্য থেকে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হওয়ার বিধান করা যেতে পারে। এতে তারা সংসদীয় আসনের ভারমুক্ত হয়ে সংসদ পরিচালনায় আরও মনোযোগী হতে পারবেন।
পঞ্চমত, সংসদে নাগরিক সম্পৃক্ততা বৃদ্ধির জন্য সংসদীয় কমিটির বৈঠকে গণশুনানির বিধান করা যেতে পারে; সেখানে অংশগ্রহণকারী আইনজ্ঞ, বিষয়সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও নাগরিক প্রতিনিধিদের হালনাগাদযোগ্য তালিকা করা যেতে পারে।
ষষ্ঠত, সংসদীয় রীতি-পদ্ধতির সংস্কার এবং সংসদের সঙ্গে নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সংবিধান ও জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি-বিধির সংস্কার করতে হবে।
মনে রাখতে হবে, সংসদ বিচ্ছিন্ন কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিবেশের মধ্য থেকেই সংসদকে কাজ করতে হয়। সাধারণভাবে সংসদীয় ব্যবস্থায় পার্লামেন্টের ম্যান্ডেট, সাংগঠনিক কাঠামো (কমিটি ব্যবস্থা, পার্লামেন্টারি পার্টি), সংসদীয় রীতি ও পদ্ধতি একই রকমের হলেও রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে সব দেশে পার্লামেন্ট একইভাবে কার্যকর
হয় না। বিশেষভাবে যেসব দেশে রাজনৈতিক বহুত্ববাদ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে; নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ; বিরোধী দল সরকারের অনুগামী; সুশীল সমাজের রাজনৈতিক ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ কিংবা রাজনৈতিক স্বাধীনতা বিপন্ন; আমলাতন্ত্রের পেশাদারিত্ব ও সুশাসন ব্যাহত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছে গণতন্ত্রের আবেদন গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে, সেসব দেশে সংসদীয় ব্যবস্থা উৎকর্ষ অর্জন করতে সক্ষম হয় না।