সম্পাদকীয় প্রকাশনার সময়: রবিবার ১, সেপ্টেম্বর ২০২৪

শিল্প খাতের বিকাশে উদ্যোগ নিতে হবে

Share on:

দেশের শিল্প খাত পুরোপুরি ব্যক্তিনির্ভর একটি খাত। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ ব্যতীত এ খাতের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ কঠিন। বিগত সরকারের আমলে দুর্বল ব্যাংক ব্যবস্থাপনা, ঋণখেলাপি, রিজার্ভ সংকট ও বিনিময় হারের অস্থিতিশীলতা দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।


এগুলো অর্থনীতিতে এক ধরনের স্থবির পরিবেশ তৈরি করে। ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণনির্ভরতা বেড়ে যাওয়ায় ব্যক্তি খাত বিনিয়োগবঞ্চিত হয়। পর্যাপ্ত গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকায় তখন উৎপাদনও বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে শিল্প খাতসহ অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক হয় নিম্নমুখী। এ পরিস্থিতি দেশী-বিদেশী বিনিয়োগে তৈরি করে প্রতিবন্ধকতা। এ কারণে বাড়েনি শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান।

কভিড-পরবর্তী সময়ে দেশের শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি ঊর্ধ্বমুখী ছিল। কিন্তু তা আর ধরে রাখা যায়নি। সর্বশেষ গত তিন অর্থবছরে এ খাতের প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে কমে আসছে, যা অর্থনীতির জন্য মোটেই ভালো নয়। এ সময়ে বিনিয়োগ, প্রাথমিক পণ্য আমদানি ও বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল আমদানিও হ্রাস পেয়েছে। সিমেন্ট শিল্পের ক্লিঙ্কার, টেক্সটাইল ও ইঞ্জিনচালিত মোটর শিল্পের উৎপাদনও নেতিবাচক ধারায় নেমে এসেছে। কাঠ ও ফার্নিচার জাতীয় বিলাসপণ্যের বাজারেও ছিল ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি।

বাংলাদেশে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগে সবচেয়ে বড় বাধা দুর্নীতি। এরপর রয়েছে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা দিতে আইনের দ্রুত প্রয়োগের অভাব, সিদ্ধান্ত গ্রহণে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও মাত্রাতিরিক্ত সময়ক্ষেপণ, দুর্বল অবকাঠামো ও গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট, জমির অভাব ও ক্রয়ে জটিলতা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় অংকের ঋণ জোগানে সক্ষমতার অভাব এবং স্থানীয়দের সঙ্গে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের যোগসূত্র ও সমন্বয়ের অভাব। এগুলোর বাইরে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সুশাসনের অভাবও দায়ী।

এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করতে এখন দরকার সরকারের সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ। আর্থিক ও ব্যাংক খাতের সংস্কার সাধন করে বিনিয়োগ উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করা। শিল্প খাতে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে চলমান অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা দ্রুত কাটিয়ে উঠতে হবে। আর যেসব কারণে আমরা অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছিলাম, সেগুলো সমাধানের মাধ্যমেই এগোতে হবে। তাহলে দেশে একটি ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি হবে, যা হবে শিল্প ও বিনিয়োগবান্ধব।

শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি কমতে থাকা অর্থনীতির জন্য মোটেই ভালো দিক নয়। কেননা কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ জিডিপিতে এ খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ খাতের প্রবৃদ্ধি কমে গেলে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে কমে আসার চিত্র সরকারি পরিসংখ্যানেই উঠে এসেছে। বিবিএসের তথ্যানুসারে, ২০২০-২১ অর্থবছরে শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ২৯ শতাংশ। পরের বছর ২০২১-২২ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ। পরবর্তী সময়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পতনের ধারা অব্যাহত থাকায় এ খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। সর্বশেষ গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিল্পের প্রবৃদ্ধি গত চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে নেমে আসে। সে বছর প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ।

বর্তমানে দেশে ২৫ লাখ ৯০ হাজার বেকার আছেন। ২০২৩ সাল শেষে গড় বেকারের সংখ্যা ছিল ২৪ লাখ ৭০ হাজার। এর মানে গত বছরের তুলনায় এখন দেশে বেকারের সংখ্যা বেশি। দেশে বেকারত্ব বাড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের অভাব। বিনিয়োগের প্রতিকূল পরিবেশ থাকায় শিল্প খাতের তেমন প্রসার ঘটেনি, কর্মসংস্থানও তৈরি হয়নি। ২০২১-২৩ পর্যন্ত তিন বছরে বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি, যা সার্বিক শিল্প প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বিবিএসের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে জিডিপির তুলনায় বিনিয়োগ হার ছিল ৩২ শতাংশের কিছু বেশি। পরের ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা নেমে আসে ৩০ দশমিক ৯৫ শতাংশে। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও তা ৩০ দশমিক ৯৮ শতাংশে সীমাবদ্ধ ছিল।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো চালু হলেও নতুন শিল্প খাতে আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি। গত কয়েক বছরে পুরনো কারখানা যে হারে বন্ধ হয়েছে তার বিপরীতে নতুন শিল্প-কারখানা চালু হয়নি। মাঝখানে করোনা মহামারীর কারণে দুই বছরের মতো অনেক কারখানা বন্ধ ছিল এবং অনেকে আবার স্বল্প সক্ষমতা নিয়ে কাজ করেছে।

২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বৈশ্বিক সরবরাহ চেইন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এতে শিল্প সম্প্রসারণ আরো বাধাগ্রস্ত হয়েছে। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে যুক্ত হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে চলা রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা। এতে নতুন বিনিয়োগে উৎসাহ পাচ্ছেন না দেশীয় বিনিয়োগকারীরা। বরং অনেকেই দেশের অর্থ বৈধ ও অবৈধ উপায়ে বিদেশে পাচার করে অন্য দেশে বিনিয়োগ করেছে। সাম্প্রতিক অনিশ্চয়তায় আশা পাচ্ছেন না বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও। এতে শিল্প খাতে কাঙ্ক্ষিত সম্প্রসারণ হচ্ছে না। তৈরি পোশাকসহ বেশ কয়েকটি খাতে আমরা যে বিশেষ অঞ্চল সৃষ্টি করে বিদেশী বিনিয়োগ এনেছি নতুন খাতগুলোকে সে রকম আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করতে পারছি না। তাছাড়া বাংলাদেশের ঋণমান সূচকও কমেছে। এতে বৈদেশিক বিনিয়োগের গন্তব্য হিসেবে আকর্ষণ কমেছে বাংলাদেশের।

স্বাভাবিকভাবে দেশে বিনিয়োগ বাড়লে অর্থনীতিতে গতিশীলতা ও কর্মসংস্থান বাড়ে। এজন্য বিনিয়োগে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে সেগুলোকে দ্রুত দূর করে বিনিয়োগ সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টিতে সরকারকেই ভূমিকা নিতে হবে। শুধু এক-দুটি পদক্ষেপ নিলেই হবে না। সামগ্রিকভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। এছাড়া দেশী বিনিয়োগকারীদের হাত ধরেই বিদেশী বিনিয়োগ আনা সহজ। এ কারণে দেশী উদ্যোক্তাদের সঙ্গে বিদেশী উদ্যোক্তাদের একটি সেতুবন্ধ গড়ে তুলতে হবে। এতে বিদেশী বিনিয়োগ আসা সহজ হবে। বিনিয়োগ আকর্ষণে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর করা জরুরি। দেশে সরকার বদল হলে নীতিরও বদল হয়ে যায়। ফলে বিনিয়োগকারীরা সমস্যায় পড়েন। সরকার পরিবর্তনে বিনিয়োগে যাতে কোনো প্রভাব না পড়ে, সেজন্য রাজনৈতিক সমঝোতার ভিত্তিতে অভিন্ন নীতি প্রণয়ন জরুরিও।

দৈনিক বণিকবার্তা