শ্রীলঙ্কার সামনে কী অপেক্ষা করছে?
Share on:
শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে প্রথম বামপন্থী প্রেসিডেন্ট অনূঢ়া দিশানায়েকে। নির্বাচনের ফল ঘোষিত হওয়ার পরদিনই শপথ গ্রহণ করলেন। উপমহাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমতার ভিত্তিতে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা দেশটি গত কয়েক বছরে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
এর ধারাবাহিকতায় ঘটে গেছে একটি গণবিদ্রোহ। জনগণের ক্ষোভ দেশটির রাজনীতির পাশা পাল্টে দিয়েছে। দেশটির সামনে কী অপেক্ষা করছে?
পাশা পাল্টানোর নির্বাচন
নির্বাচনী প্রচারণার সময় দিশানায়েকে সব জায়গায় পরিবর্তনের কথা বলেছেন। যাঁরা পরিবার, সম্পদ আর সরকারের ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে ক্ষমতা দখল করেন, বলেছেন তাঁদের হটিয়ে দেওয়ার কথা। সেই উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেন যে জনগণই কেবল সেই শক্তি ধারণ করেন।
প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা দুর্নীতি, তহবিল তছরুপের অভিযোগে এমনিতে কাতর ছিল। দিশানায়েকে মানুষের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছেন যে দুই রাজনৈতিক পক্ষের বাইরে তৃতীয় বিকল্প বেছে নিতে হবে।
সব মিলিয়ে দিশানায়েকের নেতৃত্বে তাঁর দল এক নাটকীয় বিজয় অর্জন করল। ২২৫ আসনের সংসদে বর্তমানে মাত্র তিনটি আসনের দলের প্রধান এখন দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। ১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকে সরকারের বিরুদ্ধে দলের সশস্ত্র অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়েছিল। এবার জনগণ প্রত্যক্ষ ভোটে তাঁদের হাতে এই টালমাটাল সময় অতিক্রমের ভার দিয়েছেন।
দ্বিতীয় গণনা
নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৭৬ শতাংশ। যথেষ্ট ভালো এই হার। কিন্তু শ্রীলঙ্কার নির্বাচনী আইন অনুযায়ী, প্রথম দফা গণনায় ৫০ শতাংশ ভোট না পেলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন না। দিশানায়েকে এই গণনায় পেয়েছিলেন ৪২ শতাংশ ভোট। নিকটবর্তী প্রার্থী সাজিথ প্রেমাদাসা ১০ শতাংশে পিছিয়ে ছিলেন।
শ্রীলঙ্কায় প্রেফারেন্সিয়াল ব্যালট পদ্ধতি প্রচলিত আছে। ভোটাররা তিনজন প্রার্থীকে তাঁদের পছন্দের ক্রম অনুসারে টিক দিতে পারেন। শ্রীলঙ্কায় আগের কোনো নির্বাচনই দ্বিতীয় গণনায় যেতে হয়নি। এইবার প্রথম এমন হলো। এই দুই প্রার্থীকে ভোটারদের মধ্যে কতজন দ্বিতীয় বা তৃতীয় পছন্দ হিসেবে রেখেছিলেন, তা গণনা করা হলো। সেই গণনায় শেষ পর্যন্ত দিশানায়েকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন।
ঋণের চ্যালেঞ্জ
কিন্তু প্রেসিডেন্টের জন্য সামনে বড় চ্যালেঞ্জ আছে। বিশ্লেষকেরা বলেছেন, বিশেষ করে দেশটি আইএমএফের বেলআউট প্রোগ্রামের ব্যাপারে তাঁর অবস্থান কী হবে? শর্ত অনুযায়ী, দ্বীপরাষ্ট্রটি ২০২৮ সাল থেকে এই ঋণ পরিশোধ শুরু করতে প্রস্তুত হওয়ার কথা।
২০২২ সালের এপ্রিলে শ্রীলঙ্কা দেশ হিসেবে ঋণখেলাপি হয়ে যায়। এর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ফুরিয়ে গিয়েছিল। সরকারি ঋণ গিয়ে দাঁড়ায় ৮৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এর অর্ধেক ছিল বিদেশি ঋণদাতাদের পাওনা। মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয় ৭০ শতাংশের কাছাকাছি। ভোক্তা বাজারে পণ্যের ঘাটতি দেশজুড়ে বড় আকারের অস্থিরতার সূত্রপাত ঘটায়।
দশকব্যাপী রাজাপক্ষে পরিবার দেশ শাসন করেছে। অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতিতে ক্ষুব্ধ জনগণের এক গণবিদ্রোহে সে সময়কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে দেশ ছেড়ে পালান। ২০২৩ সালে অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহের সরকার আইএমএফ থেকে বেলআউট হিসেবে ২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার গ্রহণ করে। ঋণ নেওয়া হয় চীন, ভারত ও আরব আমিরাত থেকে।
দিশানায়েকে কী বলেন
দিশানায়েকের সামনে দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করা হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই প্রথমবারের মতো তাঁরা একটি দেশ পরিচালনার জন্য ম্যান্ডেট পেয়েছেন। তাঁরা এমনকি কখনো কখনো বিরোধী দলেও ছিলেন না। সশস্ত্র আন্দোলনে তাঁদের অভিজ্ঞতা আছে। বহাল রাষ্ট্রব্যবস্থাকে উৎখাত করার জন্য লড়াই আর সেই রাষ্ট্রকে সংবিধান মেনে পরিচালনার মধ্যে তফাত আছে।
দলটি মার্ক্সবাদী প্রবণতার। বিপ্লবী গণরাজনীতি থেকে মোড় ঘুরিয়ে নিয়মতান্ত্রিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় এই প্রথম অভিজ্ঞতা হবে তাঁদের। কীভাবে আইএমএফসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক বোঝাপড়া সামলানোর মতো নীতি প্রণয়ন করবেন তাঁরা, তা দেখার জন্য সবাই আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন।
দিশানায়েকে অবশ্য প্রচারণার সময় বলেছেন যে তিনি শ্রীলঙ্কার ঋণ পরিশোধ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখবেন। দেশের অর্থনৈতিক নীতিমালায় কোনো পরিবর্তন আনার সময় আইএমএফের সঙ্গে আলোচনা করা হবে বলে জানিয়েছেন।
সাধারণ নির্বাচন আসছে
দিশানায়েকে নতুন প্রেসিডেন্ট। তাঁর প্রথম কাজগুলোর মধ্যে একটা হবে সাধারণ নির্বাচনের ডাক দেওয়া। নতুন প্রেসিডেন্টের মাত্র তিনটি সংসদীয় আসন রয়েছে। এই সংখ্যা দিয়ে স্বাধীনভাবে একটি কার্যকর সরকার গঠন করা যাবে না।
এখন বর্তমান সংসদে অন্য দলের ২২২ জন সংসদ সদস্য আছেন। নতুন নির্বাচনে দিশানায়েকের জোট আশা করা যাচ্ছে ভালো করবে। এ নিয়ে দিশানায়েকে আশাবাদী বলে মনে হয়।
বিবিসি সিনহালাকে বলেছিলেন যে ক্ষমতায় আসার পরই তিনি সংসদ বিলোপ করবেন। তাঁদের নীতিমালার জন্য প্রয়োজন একেবারে এক নতুন শুরুর, ‘জন–আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে যে সংসদের কোনো যোগ নেই, তাকে টেনে নেওয়ার কোনো মানে হয় না।’ তবে এর মধ্যবর্তী সময়ে যদি বিরোধী দল সংসদে নতুন প্রেসিডেন্টকে সহযোগিতা না করে, তাহলে দেশের শাসনব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। নতুন করে একটি অস্থিতিশীল ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির ঝুঁকির কথাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
(তথ্যসূত্র: ডয়েচ ভ্যালে, বিবিসি, ফার্স্টপোস্ট, ফ্রান্স টোয়েন্টিফোর, দা ইন্টারপ্রিন্টর, সিবিসি।)