শান্তি ও মুক্তির পথ
Share on:
বাংলাদেশে গত কয়েক দিনে যা ঘটেছে তা নজিরবিহীন। কবি শামসুর রাহমানের ভাষায়, ‘অদ্ভুত উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’। সেই একই কথার প্রতিধ্বনি লক্ষ করা যাচ্ছে এখন। স্বাভাবিক অবস্থায় কোটা আন্দোলন শুরু হয়েছিল। তা অস্বাভাবিক অবস্থায় পর্যবসিত হয়।
ঘটনাবলি প্রথম থেকে এ পর্যন্ত যদি কেউ পর্যবেক্ষণ করেন; তাহলে দেখতে পাবেন- কিভাবে কারসাজি করে, উদ্ধত ও শক্তিমদমত্ততা একটি শান্তিপূর্ণ এবং স্বাভাবিক আন্দোলন নির্মমতায় ঠেলে দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রক্ষমতার শীর্ষপর্যায় থেকে পাতি নেতাদের মন্তব্য খেয়াল করলে সেখানে ঔদ্ধত্যের প্রমাণ মিলবে।
আন্দোলনটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেছে। বিশেষ করে বিরোধী দলগুলো বর্তমান সরকারের সময়ে কোনো দাবি-দাওয়া আদায় করতে পারেনি। এমনকি একটি সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচনের দাবিও ব্যর্থ করে দেয়া হয়েছে। এছাড়া নাগরিকদের নানা দাবি-দাওয়ার ইস্যুও সরকার শক্ত হাতে দমন করেছে। এ ক্ষেত্রে শক্তি প্রয়োগে সরকার কোনো কার্পণ্য করেনি। কোনো একটি আন্দোলনও দৃশ্যমান সফলতা নিয়ে আসতে পারেনি। কিন্তু ছাত্রদের কোটা আন্দোলনটি সম্পূর্ণ ভিন্নমাত্রা নিয়ে হাজির।
কারফিউ দিয়েও প্রথমে আন্দোলন থামানো যায়নি। নরসিংদী, নারয়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে কারফিউ উপেক্ষা করে মানুষ বিক্ষোভ করে। কারফিউয়ের দ্বিতীয় দিনে নরসিংদীতে চারজন নিহত হয়। নারায়ণগঞ্জে নিহত একজন। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জায়েদা খাতুনের বাসভবনে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। ঢাকায় প্রগতি সরণিতে বিক্ষোভ হয়েছে। বনশ্রীতে আগুন জ্বলতে দেখা যায়। তার মানে, কারফিউয়ের মধ্যেও বিক্ষোভ করেছে আন্দোলনকারীরা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, প্রয়োজনে কারফিউয়ের মেয়াদ বাড়িয়ে দেয়া হবে। সেই সাথে বাড়বে অফিসের ছুটি। নাগরিক সাধারণের প্রশ্ন- এভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ আরোপ করে থাকার কি সার্থকতা না ব্যর্থতা? এভাবে দেশ চলতে পারে না। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, সরকার রক্তপাতের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার থাকার নৈতিক অবস্থান হারিয়েছে।
বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, কষ্ট ও ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এ আন্দোলনে। রক্তপাতের জবাবে জনগণও অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটিয়েছে। যেকোনো আন্দোলনে ক্ষোভের প্রকাশ এভাবে ঘটে। ক্রোধও মানুষকে বিপথে পরিচালিত করে।
রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা পুলিশের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। পুলিশের আগ্রাসী আচরণের শিকার হয়েছে সাধারণ মানুষও। এর সাথে যুক্ত হয়েছে নানা ধরনের বঞ্চনা। বিশেষ করে নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি। এখন এক কেজি সবজি মানুষকে কিনতে হয় ১০০ টাকা দিয়ে। প্রায় প্রতিটি সবজির দাম আকাশছোঁয়া। কৃষিপ্রধান এ দেশে আরো বেশ কিছু পণ্যের দাম এত বেশি হওয়ার কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায় না। আন্দোলনে বিক্ষুব্ধ মানুষের চেহারা দেখা গেছে। তারা হাজারে হাজারে রাস্তায় নেমে এসেছেন। মুখোমুখি হয়েছেন প্রথমত পুলিশের। ছাত্রদের সাথে মিলে পুলিশের বুলেট, টিয়ার শেলের জবাব দিয়েছেন।
হতাহত মানুষের সারিতে ছাত্রদের চেয়ে সাধারণ মানুষের সংখ্যা বেশি দেখা গেছে। তাদের লক্ষ্য ছিল পুলিশ। তারা যেমন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য দেখামাত্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, অনেক ক্ষেত্রে তারা রাস্তা থেকে পুলিশকে বিতাড়িত করেছেন। সবচেয়ে আক্রান্ত হয়েছে পুলিশ ফাঁড়ি। বহু জায়গায় তাদের স্থাপনায় আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। মানুষের ক্ষোভের দিকটি বিবেচনায় না নিয়ে বরাবরের মতো একে নাশকতা হিসেবে চিহ্নিত করলে বড় ভুল হবে। জনমানুষের ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। ছাত্রদের দাবি থেকে তাদের বঞ্চনা কোনো অংশে কম নয়।
সরকার মানুষের ন্যায্য দাবিকে কোনোভাবে স্বীকৃতি দিতে চায় না। অথচ আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী পক্ষে থাকে, তখন আন্দোলনের নামে তাদের কাজে সব কিছু জায়েজ হয়ে যায়। এদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন, এরশাদবিরোধী আন্দোলন এবং এক-এগারোর আন্দোলনে দৃষ্টিপাত করলে এর সত্যতা মিলবে। আন্দোলনকারীরা এখন দুর্বৃত্ত ও দুষ্কৃতকারী বলে অভিহিত হচ্ছে। মনে রাখা দরকার, ক্ষমতার মদমত্ততা কখনো ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে পারে না। দেশের একজন সর্বজনশ্রদ্ধেয় বুদ্ধিজীবী বলেছেন, ‘শান্তিপূর্ণভাবে শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে সমস্যার সমাধান করা যেত। এর পরিবর্তে দলীয় ছাত্রসংগঠনের পেটোয়া বাহিনীকে সাধারণ ছাত্রদের ওপর লেলিয়ে দিয়ে সরকার নিজেই তৃতীয় পক্ষের অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে এবং আন্দোলনকে সহিংস রূপ দিয়েছে।’
এখন ক্ষমতাসীনরা আন্দোলনে লুঙ্গিপরা লোক দেখছেন। স্কুলপড়–য়া ছাত্রও নিহত হয়েছে। নিহতদের তালিকায় বিভিন্ন পেশার মানুষের নাম রয়েছে। তার মানে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনটি গণ আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল। বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরী বলেছেন, ‘এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে তাতে করে আন্দোলনের ইস্যু পরিবর্তন হয়ে গেছে। মানুষ এসব হত্যার বিচার চায়। হত্যাযজ্ঞ চালানো সরকারকে তারা আর ক্ষমতায় দেখতে চায় না।’
ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে সব বিরোধী দল সম্মিলিতভাবে সরকারের পদত্যাগ দাবি করে আসছে। গত ৭ জানুয়ারি ডামি নির্বাচনের সময়ে, আন্দোলনটি প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছেছিল। এখনকার মতো তখনো সরকার কঠোর শক্তি প্রয়োগে ওই আন্দোলন দমন করে। খুব সঙ্গতভাবে বিরোধী দলগুলো কোটা আন্দোলনের প্রতি নৈতিক সমর্থন জানায়। আর এখন যখন রক্তপাতের মাধ্যমে সরকার ক্ষমতায় থাকতে চাইছে, তখন বিরোধী দল ফের সরকারের পদত্যাগ দাবি করছে। এটি খুব কষ্টের কথা যে, সরকার নজিরবিহীন বেপরোয়া পদক্ষেপের মাধ্যমে উল্টো পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকারের এসব পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে :
১. সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি। ২.রক্তপাতের মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকা। সরকারি হিসাবেই ২০০-র মতো মানুষ হত্যা হয়েছে। তবে অভিযোগ এই যে, বহু মৃত্যু অপ্রকাশ্য ও অচিহ্নিত রয়েছে।
৩. বরাবরের মতো হামলা-মামলা ও গ্রেফতারের মাধ্যমে আন্দোলন মোকাবেলা করা। আন্দোলন শুরু হওয়ার পর এ পর্যন্ত অসংখ্য মামলা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে হাজারো মানুষ। তাদের মধ্যে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরসহ বিরোধী দলের অসংখ্য নেতাকর্মী। সরকার ক্ষুব্ধ মানুষের প্রতিক্রিয়া বিরোধী দলের নাশকতা বলে চালিয়ে দিতে চাইছে।
৪. সরাসরি গুম ও নির্যাতনের পথ অনুসরণ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে সাদা পোশাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। নির্যাতনের পর তাকে রাস্তায় ফেলে দেয়া হয়। আরো কয়েক সমন্বয়কারীর ব্যাপারেও একই অভিযোগ আসছে।
৫. প্রতারণার কৌশল। সরকার বলেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা আন্দোলন প্রত্যাহার করেছেন। দেখা গেল, অনেক কিছু মিলছে না। এর সমর্থনে যথাযথ রেফারেন্স ব্যবহার করা হচ্ছে না। টিভিতে যে তিনজন সমন্বয়ককে দেখানো হয়; তাদের অবস্থান ও কার্যক্রম নিয়ে প্রথমে সন্দেহ দেখা দেয়। এখনো মানুষের মধ্যে এ সন্দেহের ঘোর কাটেনি। সরকার বিশ্বাসযোগ্য এমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি যাতে মানুষ আশ্বস্ত হতে পারেন।
৬. ক্ষমতার স্বার্থে সারা দেশে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেয় সরকার। বানোয়াট অভিযোগ দিয়ে ইন্টারনেট বন্ধের ঘটনা বৈধ করার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে দেশের মানুষ সরকারের এই কথা বিশ্বাস করেছে বলে মনে হয়নি।
৭. সরকার কারফিউয়ের পাশাপাশি সব অফিস-আদালত বন্ধ ঘোষণা করে।
৮. আন্দোলনের প্রাক্কালে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো থেকে ছাত্রদের বল প্রয়োগ করে বিতাড়ন করা হয়।
এত কিছুর পরও শাসকদল যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাইছে। এক পথচারী বলেছেন, ক্ষমতাসীনদের মধ্যে দেশপ্রেমের ছিটেফোঁটাও দেখা যাচ্ছে না। বিরোধী রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়া যেন সরকারের মুখ্য উদ্দেশ্য। সরকারের আক্রমণের মুখ্য নিশানা এখনো আগের মতো বিএনপি-জামায়াত। অথচ দল দু’টি ছাত্রদের বঞ্চনার প্রতি শুধু সমর্থন জানিয়েছে। ছাত্ররাও কোনোভাবে দলগুলোর সাথে তাদের সম্পৃক্ততা প্রকাশ করেনি। এ সরকারের পুরো সময়জুড়ে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার লক্ষণ দেখা গেছে। বিগত ৫০ বছরের তুলনায় গত ১৫ বছরে কয়েকগুণ বেশি রাজনৈতিক কারণে হত্যার শিকার হয়েছেন মানুষ। দেশের শীর্ষ বুদ্ধিজীবীরা বলছেন, ক্ষমতায় থাকার জন্য এত রক্তপাত আগে কেউ ঘটায়নি। রক্তপাত শুধু রক্তপাত ঘটায়, ক্ষমতা চিরস্থায়ী করে না।
নাগরিক সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে বিভক্তি শান্তি অর্জনের পক্ষে বাধা। অন্যদিকে সরকার কৌশল করে সমাজে বিভক্তি তৈরি করে রেখেছে। কোটাপ্রথাও এমনি একটি বঞ্চনা ছিল। মুক্তিযোদ্ধা কোটা সরকার নিজের স্বার্থে রেখেছে। ১ শতাংশের কম মানুষের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা বিস্ময়কর। এতে করে খুব সামান্য একটি অংশকে মাত্রাতিরিক্ত সুবিধা দেয়া, অন্যদিকে বৃহত্তর অংশকে বড়দাগে বঞ্চিত করা হয়। একই অবস্থা আমরা রাষ্ট্র্রের বিভিন্ন পর্যায়ে দেখে আসছি। সরকার যেকোনো সুবিধা দেয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য দেয়। এটি অবশ্যই সমাজের অস্থিরতা বাড়ায়। এভাবে কখনো সমাজে বা দেশে শান্তি আনা সম্ভব নয়।
সরকার রাজ্য শাসনে সমতার নীতি গ্রহণ করলে ভালো। বিভক্ত করে বঞ্চিত করে রাজ্য শাসন করলে সবসময় অশান্তি ফিরে আসবে। এটি প্রগতির জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াবে। কোটাপ্রথা অনেকটা উচ্ছেদ হয়েছে উচ্চ আদালতের রায়ে। এভাবে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করা প্রয়োজন।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ