শেখ হাসিনার বিদায়, এ যেন নতুন সুর্যোদয়
Share on:
ক্ষমতা স্থায়ী নয়। জোর করে ক্ষমতায় আসা যায়, অনেক দিন থাকাও যায়। কিন্তু এক সময় বিদায় অনিবার্য হয়। জনগণের কাছে প্রত্যাখ্যাত হতে হয়। শেখ হাসিনার করুণ বিদায়ের মধ্য দিয়ে তা আরেকবার প্রমাণ হলো।
বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু যখন সপরিবারে নিহত হলেন, তখন তিনি ও তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা বিদেশে ছিলেন। তাই প্রাণে বেঁচে গিয়েছেন। প্রতিকূল পরিবেশে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সহৃদয়তায় সেখানে আশ্রয় পেয়েছিলেন। ১৯৮১ সালে সেখান থেকে দেশে ফিরলেন। সেদিন বাংলার মানুষের মধ্যে সে কী উচ্ছ্বাস! আমি তখন আওয়ামী লীগের কেউ না। আওয়ামী লীগের রাজনীতি থেকে আমার যোজন যোজন দূরত্ব। তার পরও আমি শেরেবাংলা নগরে অনুষ্ঠিত শেখ হাসিনার সংবর্ধনা সভায় গিয়েছিলাম। তাঁর কথা ও কান্না আমাকেও স্পর্শ করেছিল। তখন আমার মনে হয়েছিল, শেখ হাসিনা বাংলার মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই পাবেন। এমন কথা আওয়ামী লীগের অনেক কট্টর সমালোচকের মুখেও শুনেছি।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি ধ্রুবতারা হয়ে জ্বলে উঠলেন। তিনি ছিলেন স্বৈরাচারী এরশাদবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নায়ক এবং ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তনের অন্যতম রূপকার। বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা হারানোর ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করলেন। সেই সরকার জাতিকে এক বিরল সুশাসন উপহার দিল।
২০০১ সালে ক্ষমতায় আসতে পারল না। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি ক্ষমতাসীন হয়। বিএনপিও ১৯৯১-৯৬ সালের শাসনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারল না। শুরু হলো লুটপাটের রাজনীতি, দলীয় ক্যাডারদের দৌরাত্ম্য, ক্ষমতা ধরে রাখার নানা অপকৌশল। এর বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সোচ্চার ছিল। সোচ্চার ছিল অন্যান্য দলও। সে যাই হোক, ১/১১ এর প্রেক্ষাপটে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ আবার বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় এলো। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বিএনপির শাসনের চেয়ে জোরেশোরে লুটপাট-দুর্নীতি শুরু হলো; নেতাকর্মীর দৌরাত্ম্য বাড়ল; আমলা-পুলিশও চাটুকারিতায় নিয়েজিত হলো। ক্ষমতাসীনদের ঘিরে সুবিধাভোগী গোষ্ঠী তৈরি হলো। সবচেয়ে কষ্টকর, সব অপকর্ম শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসও বিকৃত করা হলো।
এক দল চাটুকর শেখ হাসিনার গুণকীর্তনে মগ্ন হলেন। তাঁকে বলতে শুরু করলেন, আপনি বিশ্বনেত্রী। আপনার মতো নেত্রী আর কোথাও নেই। নোবেল পুরস্কার আপনারই প্রাপ্য।
এভাবেই একদা জননেত্রী শেখ হাসিনার জনবিচ্ছিন্নতা বাড়তে লাগল। যে গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য ২১ বছর লড়লেন; জান বাজি লড়াই করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান কায়েম করলেন; তা পরিহার করে ২০১৪ সালে বিরোধী দলকে মাঠের বাইরে রেখে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ক্ষমতায় গেলেন। ২০১৮ সালে দিনের ভোট রাতে দিয়ে জয়ী হলেন। ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্রের মধ্যে অনুষ্ঠিত ভোটখেলায় আরেক মেয়াদে ক্ষমতাসীন হলেন।
এটি সত্য যে, টানা ১৬ বছরের শাসনে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে; পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেলসহ নানা স্থাপনা নির্মিত হয়েছে। তা ছাপিয়ে উঠেছে মন্ত্রী-এমপিদের বিত্তবৈভবের প্রতিযোগিতা; বেনজীর-মতিউরদের লুটপাটের কেচ্ছাকাহিনি। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তাঁর একজন পিয়ন ৪০০ কোটি টাকার মালিক। কিন্তু আমজনতার আয় বাড়েনি, ব্যয় বেড়েছে। আয়-ব্যয়ের হিসাব মিলছে না। দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না সাধারণ মানুষ।
একদা এমপি-মন্ত্রীরা জনগণের কাছে আসতেন, তাদের কথা শুনতেন। জনগণ বলতে পারতেন, জিনিসপত্রের দাম না কমলে, ছেলেমেয়েদের চাকরি না হলে ভোটের বাক্সে জবাব দেব। শেখ হাসিনার শাসনামলে সে সুযোগ তিরোহিত হয়। নেতারা বলতেন– নৌকা মার্কা পেলেই চলবে, ভোট লাগবে না। ভোটে জিততে ভোটার লাগে না, দরকার ক্যাডার আর আমলা-পুলিশের।
তাই ভোট দিতে না পারার যন্ত্রণা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, লুটপাট, দুর্নীতি, কর্তৃত্ববাদী শাসনের ফলে জনমনে যে ক্ষোভ জমাট বেঁধেছিল, তা আছড়ে পড়েছিল শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে। তারা বিস্মৃত হয়েছিলেন, অবকাঠামোগত উন্নয়নই কেবল উন্নয়ন নয়; জনগণের জীবনমানের উন্নয়নই আসল কথা। এ প্রসঙ্গে পাকিস্তান আমলের আইয়ুবের শাসনের কথা উল্লেখ করা যায়। প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ১০ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। তাঁর শাসন আমলেই রাস্তাঘাটসহ ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছিল। শহর ও গ্রামে, রাজনীতিক ও আমলাদের মধ্যে একটি সুবিধাভোগী গোষ্ঠী জন্ম নিয়েছিল। তারাই ছিল আইয়ুবের তল্পিবাহক। ১৯৬৮ সালে ঘটা করে উন্নয়ন দশক পালন করেছিল। সাধারণ মানুষের গায়ে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। তাদের কষ্টবোধ ছিল, ভোটাধিকার কেড়ে নিয়েছিল, কেবল বিডি মেম্বাররাই ছিল ভোটের মালিক। জনগণ উপহাস করে বলত, আইয়ুবেব ৮০ হাজার ফেরেশতা; যার মধ্যে বাংলাদেশে ছিল ৪০ হাজার। ‘উন্নয়ন দশক’-এর এক বছরের মাথায় জনগণের সেই পুঞ্জীভূত ক্ষোভের আগুন জ্বলেছিল ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে, যা স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের বিদায়ঘণ্টা বাজিয়েছিল।
৫৫ বছর পর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল। স্বাধীন বাংলাদেশে গণআন্দোলনের মুখে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতন ঘটল আরও করুণভাবে। তিনি হেলিকপ্টারযোগে দেশ থেকে পালিয়ে ভারতের আগরতলায় আশ্রয় নিলেন। বলা বাহুল্য, শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারত, চীন ও রাশিয়ার সমর্থন ছিল। তাতে কোনো কাজ দিল না। একদা যাদের ভোটাধিকার কেড়েছিলেন; ন্যায়সংগত দাবি অগ্রাহ্য করেছিলেন, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের রাজাকারের নাতিপুতি বলে উপহাস করেছিলেন। ভুলে গিয়েছিলেন সেই অমোঘ বাণী, ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা, আজ জেগেছে সেই জনতা।’ সেই জাগ্রত জনতার ভয়ে শেখ হাসিনাকে পালিয়ে যেতে হলো। প্রমাণিত হলো দেশের মালিক জনগণ। জনগণের শক্তিই বড় শক্তি।
শেখ হাসিনার বিদায়, জনতার জয়। এখন যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আসছে, তাদের সামনে বিরাট চ্যালেঞ্জ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আজ ভূলুণ্ঠিত। একাত্তরের চেতনায় বৈষম্যহীন বাংলাদেশ আমরা গড়তে পারিনি। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের স্বপ্ন আমরা বাস্তবায়ন করতে পারিনি। গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থা কায়েম করা যায়নি। ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি সুশাসন। আমরা কি ২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর সেই বাংলা ফিরে পাব, যেখানে সবাই মেধা ও যোগ্যতায় চাকরি পাবে, অর্থনীতিতে সাম্য আসবে?
যে শ্রম ও কর্মজীবী মানুষ শিক্ষার্থীদের পাশে থেকে এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, তাদের জীবনে কি শান্তি ও স্বস্তি ফিরে আসবে?