মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: মঙ্গলবার ১৭, সেপ্টেম্বর ২০২৪

শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্য খাতে মোটা অংকের বিনিয়োগ চাই

Share on:

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের মানুষের বীরত্বপূর্ণ ইতিহাসের এক নতুন সংযোজন। শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে শুরু হওয়া সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে যে আন্দোলন সেটিই পূর্ণতা পায় এদিন।


স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে গণতন্ত্রহীনতার দীর্ঘ প্রায় ১১ বছরের সংস্কৃতির সমাপ্তি হয় ছাত্র-জনতার এক অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। নিজের দলের কর্মী ও সমর্থকদের কোনো রকম দিকনির্দেশনা দেয়া ছাড়াই রাজনৈতিকভাবে এতিম করে বাংলাদেশ ত্যাগ করেন স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে মূলত শেখ হাসিনার একচ্ছত্র আধিপত্য, একনায়কতন্ত্র ও স্বৈরশাসনের সূচনা হয়।

এ সময়ে বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ক্রমেই সীমিত হয়েছে, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ও সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট প্রণয়নের মাধ্যমে বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, সুশীল সমাজ এমনকি সাধারণ নাগরিকদের টুঁটি চেপে ধরেছিল সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার। শিক্ষা খাত, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর একচ্ছত্র নিয়ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে নিপীড়নকারী সরকার। ফলে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এসব ক্ষেত্রে কী ক্ষতি হচ্ছে সেটা লেখার সুযোগ হয়ে পড়েছিল অত্যন্ত সীমিত। তৎকালীন সরকারের অবকাঠামোগত উন্নয়নের বুলির স্রোতে মানবিক উন্নয়ন কিংবা কল্যাণ ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রের দাবির স্বপক্ষে আমাদের আলাপ ঢাকা পড়ে যেত। ফলে সবার অজান্তেই বাংলাদেশের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিবেশে অকল্পনীয় ক্ষতি সম্পন্ন হয়ে যায়। যার কিছুটা এখন হয়তো উপলব্ধি করতে পারলেও কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি যে প্রভাব তা থেকে মুক্তি মেলা কঠিন।

গণ-অভ্যুত্থানে উৎখাত হওয়া শেখ হাসিনা-পরবর্তী সময়ে অগণতান্ত্রিক হলেও একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখন বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায়। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে অসাংবিধানিক এ জাতীয় সরকার একটি স্বাভাবিক বাস্তবতা। বাংলাদেশে নবগঠিত সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ, ক্ষুদ্র ঋণ ও সামাজিক ব্যবসা তত্ত্বের প্রবক্তা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিদের মতো বাংলাদেশের সব বোধসম্পন্ন নাগরিক মনে করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের একটি সংস্কার প্রয়োজন। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যে স্বপ্নের বাংলাদেশের রূপকল্প থেকে অর্জিত দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা সেটি বাস্তবায়ন করতে পারিনি। তাই আজও বাংলাদেশে শোষণ, নিপীড়ন, সামাজিক পরিবেশে অস্থিতিশীলতা, আর্থিক বৈষম্য, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কারণে সৃষ্ট উগ্রপন্থা ও হানাহানি, দুর্নীতি ইত্যাদির বিপুল বিস্তার লক্ষণীয়। বাংলাদেশে মানুষকে স্বাধীনতা ও সম্মানজনক নাগরিক জীবন ফিরিয়ে দিতে হলে আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও সমাজ থেকে নেতিবাচক উপাদানগুলোকে দূরীভূত করতে হবে। সংস্কার করতে হবে পুরোনো ধারার রুগ্‌ণ বাংলাদেশকে। আমাদের নতুন প্রজন্মের হাত ধরে নির্মিত হবে এক নতুন বাংলাদেশ। আপাতত যার দিকনির্দেশনার দায়িত্ব নিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার নেতৃত্ব ও দূরদৃষ্টির ওপর ভর করে সেই সংস্কার কতটা সম্ভব হবে তা আপাতত সময়ের ওপরেই ন্যস্ত থাক।

আমরা বাংলাদেশের নতুন সরকারকে দুটি বিশেষ ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্বারোপের তাগাদা দিতে চাই। যেকোনো উন্নত ও কল্যাণ রাষ্ট্র গঠনের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে মানবিক ও আধুনিক করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের সামগ্রিক সংস্কারের জন্য এবং সুশিক্ষিত, সুস্থ জাতি গঠনের লক্ষ্যে আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার অবৈজ্ঞানিক, প্রাচীন ও ত্রুটিপূর্ণ কারিকুলাম সংস্কার করার বিকল্প নেই। একই সঙ্গে বাংলাদেশে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকদের যোগ্য ও দক্ষ করে তুলতে শিক্ষা ও গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতি শুরু হয়। শিক্ষক নিয়োগে রাজনৈতিকীকরণের শুরুও তখন থেকে। ফলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার কেন্দ্রে অবস্থানকারী যে শিক্ষক সমাজ তারা হয়ে পড়েন দলদাস, অযোগ্য এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা স্বার্থপর ও মেরুদণ্ডহীন। পাশাপাশি যুক্ত হতো শিক্ষা খাতে বিনিয়োগের প্রশ্নে সরকারগুলোর অনাগ্রহ।

ইউনিসেফের মতে, একটি উন্নত ও আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য কোনো দেশের জিডিপির ন্যূনতম ৬ শতাংশ অর্থ বিনিয়োগ করা উচিত শিক্ষা খাতে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনো এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সক্ষম হয়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাংলাদেশে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাত মিলিয়ে বিনিয়োগ জিডিপির ২ শতাংশের আশপাশে থাকে, যা নিতান্তই অপ্রতুল। বাংলাদেশে শিক্ষকদের জীবন অত্যন্ত দুর্বিষহ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের সম্মানী গ্রহণযোগ্য মাত্রার নয়। ফলে কোচিং করানো, প্রাইভেট পড়ানো কিংবা দ্বিতীয় কোনো কাজ করে পরিপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় জীবিকা নির্ধারণে তারা বাধ্য হন। অথচ শিক্ষকদের একমাত্র মনোযোগ হওয়া উচিত শিক্ষা ও গবেষণায় মনোনিবেশ করা। কিন্তু সরকারের শিক্ষানীতির দুর্বলতা এবং কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষকদের নৈতিক স্খলন তাদের পূর্ণকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করার সুযোগ দেয় না। শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দও থাকে অতি নগণ্য। গবেষণা খাতে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাজেটে যা বরাদ্দ হয় তা প্রয়োজনের চেয়ে নিতান্তই অপ্রতুল।

বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে আরেকটি সমস্যা হলো শিক্ষানীতি ও কারিকুলাম প্রণয়নের দায়িত্ব পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্ডিতদের ওপর। অথচ প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষার সঙ্গে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের সংযোগ থাকে না। তারা নতুন প্রজন্মের শিশুদের মনস্তত্ত্ব বোঝেন না। জিনগতভাবে মানুষের এক প্রজন্ম থেকে আরেকটি প্রজন্মের মাঝে যে জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধির উপাদান প্রাকৃতিক উপায়ে সঞ্চারিত হয় সেটাও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের বিবেচনায় থাকে না।

এর সঙ্গে যুক্ত হয় বিদেশী শিক্ষা ব্যবস্থাকে অন্ধভাবে অনুকরণ করার আত্মঘাতী প্রবণতা। মনে রাখা উচিত, শিক্ষার সঙ্গে পৃথিবীর আঞ্চলিক, সাংস্কৃতিক, আবহাওয়াগত একটা সংযোগ রয়েছে। আমাদের শিক্ষানীতি ও কারিকুলাম প্রণয়নের ক্ষেত্রে এ সাংস্কৃতিক দিকটি কোনোভাবেই উহ্য থাকতে পারে না। কেননা তাতে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায় না। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার খোলনলচে বদলানোর সময় অর্থ বিনিয়োগ যেমন বাড়াতে হবে তেমনি সামাজিক বিজ্ঞান ও দর্শনগত বিষয়গুলোকেও সচেতন বিবেচনায় রাখতে হবে।

স্বাস্থ্য খাত বাংলাদেশের অন্যতম অবহেলিত আরকটি খাত। অথচ এটি দেশের প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকারসংশ্লিষ্ট। দুর্ভাগ্যক্রমে হলেও সত্য যে ২০২৪ সালে এসেও বাংলাদেশের নাগরিকের জন্য কোনো ইউনিক ও ইউনিফায়েড স্বাস্থ্য বাতায়ন নেই। আমাদের দেশে সামাজিক সুরক্ষা নম্বরের মতো স্বাস্থ্য কার্ড নম্বর আজও প্রণয়ন হয়নি। ফলে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থায় কোনো কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডারের অস্তিত্ব নেই। নাগরিকরা নিজের পছন্দমতো চিকিৎসকের কাছে যায়।

তাদের স্বাস্থ্যের তথ্যের দীর্ঘমেয়াদি কোনো ইতিহাস চিকিৎসক বা রাষ্ট্রের হাতে নেই। এতে একদিকে যেমন প্রচুর ভুল চিকিৎসা হয়, তেমনি রোগীদেরও বারবার অপ্রয়োজনীয়ভাবে স্বাস্থ্য পরীক্ষার নামে বিপুল ব্যয় করতে হয়। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য বীমা কিংবা ব্যাপকার্থে সরকারিভাবে বিনামূল্যে চিকিৎসার সুযোগ তৈরি হয়নি। ফলে মানুষ উপার্জনক্ষম সময়ে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে সক্ষম হলেও জীবনের শেষের দিনগুলোয় যখন স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে এবং স্বাস্থ্য হয়ে ওঠে মানুষের মূল দুশ্চিন্তার কারণ তখন সবচেয়ে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়। ভুল কিংবা বিনা চিকিৎসায় মানুষের অকালপ্রয়াণ পর্যন্ত ঘটে।

আমাদের আগামী বাংলাদেশের অর্থনীতি হওয়া উচিত সেবা খাতনির্ভর। শিল্প খাতে বিনিয়োগ জরুরি। তবে এক্ষেত্রে বিপুল নির্ভরতা পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাত কিংবা চামড়া শিল্প আমাদের অর্থনীতির অন্যতম লাইফলাইন হলেও নিজেদের পরিবেশের যে বিপুল ক্ষতি করে সে ব্যাপারে আমাদের মাঝে সেভাবে সচেতনতা নেই। ইউরোপে বা এশিয়ার উন্নত অর্থনীতির দেশগুলো সেবা খাতকে প্রাধান্য দেয়ায় তাদের জাতীয় আয়, মাথাপিছু আয় যেমন আমাদের চেয়ে অনেক বেশি, তেমনি পরিবেশকেও তারা বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেয় না। বাংলাদেশকে একটি সেবা খাতনির্ভর অর্থনীতি লাভ করতে হবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ বিনিয়োগ করতে হবে। কেমনা এগুলো জনশক্তি উন্নয়নের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য আমরা যখন জাতিগতভাবে এক হয়েছি সেই মুহূর্তে আমাদের অবশ্যই জনশক্তিকে যোগ্য ও দক্ষ করে তোলার প্রশ্নে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। সেজন্য বাংলাদেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আধুনিকায়ন জরুরি। আশা করি, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জাতি গঠনের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে উপযুক্ত বিনিয়োগে তাদের আগ্রহ ও মনোযোগ প্রদানে দ্বিধাহীন থাকবে। একটি সুস্থ সামাজিক পরিবেশ ও কল্যাণমূলক বাংলাদেশ গঠনের সূচনা হোক আমাদের তরুণদের বৈশ্বিক মানের শিক্ষার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়ার মাধ্যমে। আর তাদের শারীরিক-মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বিভাগের ভূমিকা হোক অগ্রগামী। আমরা যদি এ দুটি খাতকে শক্ত করে তুলতে পারি, আমাদের অর্থনীতি, রাজনীতিসহ আরো অনেক সমস্যা দূরীকরণ সহজ হয়ে যাবে। আমরা আশা করি, নতুন সরকার জাতিকে আলোর পথ দেখাতে ভূমিকা রাখবে।

দৈনিক বণিকবার্তা