শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়ানো ও সংস্কার জরুরি
Share on:
শিক্ষা ও গবেষণার প্রভাব ও ব্যাপকতা অত্যন্ত বিস্তৃত। বাংলাদেশ এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যা ইঙ্গিত করে বাংলাদেশের তরুণ ও কর্মক্ষম মানুষের আধিক্য।
জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপি) তথ্য অনুসারে, দেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৭ দশমিক ৯৬ শতাংশই তরুণ। এ তরুণ জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য এসডিজি বাস্তবায়নে শিক্ষা ও গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। বারবার পাঠ্যক্রম পরিবর্তন এবং এ খাতে বিনিয়োগ অপ্রতুল থাকায় আমরা আন্তর্জাতিক মান থেকে পিছিয়ে পড়ছি। তাই এ খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো ও যুগোপযোগী সংস্কার প্রয়োজন।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেয়া হয় ৯৪ হাজার ৭১০ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ এবং জিডিপির ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছিল জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। অথচ ইউনেস্কোর পরামর্শ হচ্ছে, শিক্ষা খাতে একটি দেশের মোট জিডিপির ৬ শতাংশ এবং বাজেটের অন্তত ২০ শতাংশ ব্যয় হওয়া উচিত। কিন্তু বাংলাদেশে কয়েক বছর ধরে শিক্ষায় বরাদ্দ বাজেটের ১২ শতাংশের ওপর উঠছে না। এমনকি জিডিপির বিপরীতে এ খাতে বরাদ্দ ক্রমেই কমছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ১৮৯টি সদস্য দেশের মধ্যে যে ১০টি দেশ অর্থনীতির আকারের তুলনায় শিক্ষা খাতে সবচেয়ে কম বরাদ্দ দেয়, বাংলাদেশ তার একটি। দক্ষিণ এশিয়ায় জিডিপির বিপরীতে শিক্ষা খাতে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করে ভুটান। দেশটিতে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ মোট জিডিপির ৮ দশমিক ১ শতাংশ। এছাড়া এ বরাদ্দের হার ভারত ও মালদ্বীপে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ এবং আফগানিস্তানে ৪ দশমিক ৩ শতাংশ।
পুরো বিশ্ব চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য শিক্ষা খাতে বরাদ্দ সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাচ্ছে। সেখানে বাংলাদেশের শেষ পাঁচ বছরের বাজেট বরাদ্দ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তার সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শিক্ষা ও গবেষণাকে গুরুত্ব দিয়ে এ খাতের উন্নয়নে চলতি অর্থবছরের বাজেট পুনর্বিবেচনা করে বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন। এ খাতে নেয়া প্রকল্পগুলোর যথার্থতা যাচাই করা উচিত। তথ্য ও প্রযুক্তির বৈপ্লবিক উন্নয়নে যেখানে পুরো বিশ্ব তার তরুণদের উন্নয়নে সর্বোচ্চ ব্যয় করছে, সেখানে বাংলাদেশের কোনোভাবেই শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দে সংকীর্ণতার সুযোগ নেই। দেশের সামগ্রিক মানবসম্পদের উন্নয়নে শিক্ষার কোনো ব্যতিক্রম নেই।
শিক্ষাবিদরা মনে করছেন, এ খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো না হলে সমাজে বেকারত্ব ও অপরাধপ্রবণতা বাড়বে। এটি দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, নীতি-নৈতিকতা, আইন, সামাজিক মূল্যবোধ বিকাশকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করবে, যা জাতিকে চরম মাত্রায় ভোগাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে। তাই শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়নে এ খাতের বিনিয়োগে আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ অতীব জরুরি। এছাড়া গুণগত ও প্রয়োজনীয় শিক্ষাদানের পাশাপাশি জাতীয় শিক্ষানীতির পুনর্মূল্যায়ন এবং সঠিক পরিকল্পনার সঙ্গে বাস্তবায়নের ভূমিকায় রাষ্ট্রকে তৎপর হতে হবে।
শিক্ষার পরিবেশ বিচারে সাক্ষরতার হার আর মান সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২৪ অনুসারে, বর্তমানে দেশে সাক্ষরতার হার প্রায় ৭৭ শতাংশ ৯ শতাংশ। ১৯৭১ সালে ছিল ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। অর্থাৎ দেশে সাক্ষরতার হার বেড়েছে। এ তথ্য জানান দেয় যে শিক্ষায় মানুষের অন্তর্ভুক্তি উল্লেখযোগ্যভাবে হয়েছে। কিন্তু মানের প্রশ্নে তেমন কোনো নজির নেই বললেই চলে। কারণ শিক্ষায় বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কম দেয়া হয়েছে, শুধু তা-ই নয়। যেটুকু বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল, সেটাও যথাযথভাবে ব্যয় করা হয়নি। পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রে অপব্যয় করার অভিযোগ আছে।
দেশের শিক্ষা ও প্রযুক্তির বরাদ্দ একসঙ্গে দেয়া হয়। শিক্ষার জন্য বরাদ্দ আলাদাভাবে দেয়া উচিত। শিক্ষায় যে বরাদ্দ দেয়া হয় তার একটি বড় অংশ ব্যয় হয় অবকাঠামো নির্মাণে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ বা শিক্ষার মান উন্নয়নে উদ্যোগ কম দেখা যায়। শিক্ষা খাতের উন্নয়ন করতে হলে এসব বিষয়ে পরিবর্তন আবশ্যক।
বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ থেকে যারা উন্নত দেশে পরিণত হয়েছে, খেয়াল করলে দেখা যাবে যে তাদের মধ্যে নানা পার্থক্য বিদ্যমান। রাজনৈতিক আদর্শ থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। উদাহরণস্বরূপ আমেরিকার পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও চীন সরকার নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির কথা বলা যায়, কিন্তু একটি জায়গায় তারা এবং যেকোনো উন্নত দেশ একই মতাদর্শে বিশ্বাসী—মানসম্মত শিক্ষা। মানসম্মত শিক্ষার সঙ্গে উন্নয়নের একটা সুসম্পর্ক রয়েছে তা তাদের শিক্ষায় বিনিয়োগ ও শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে পরিলক্ষিত হয়। দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশের পরিকল্পিত শিক্ষা তাদের সার্বিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা রেখেছে। এসব দেশে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ অনেক বেশি।
একটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয় তখনই বিশ্বসেরার তালিকায় নাম লেখাতে পারে, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ও প্রকাশনা শক্তিশালী হয়। বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণায় পিছিয়ে।
সোলোর গ্রোথ মডেল অনুযায়ী অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল উপাদান তিনটি—মুদ্রা, প্রযুক্তি ও জনবল। দেখা যায়, আজকের উন্নত দেশগুলো একসময় মুদ্রা ঋণ নিয়েছে। প্রযুক্তি অনুকরণ করে বা আমদানি করে নিজের দেশের উৎপাদন বাড়িয়েছে, অবকাঠামোগত উন্নয়ন করেছে। এমনকি শুরুর দিকে তারা বিশেষজ্ঞ আনিয়েছে নিজ নিজ দেশে। ধীরে ধীরে তারা নিজের জনগণকে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করেছে। এটি সম্ভব করেছে তারা মানসম্মত শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে। অর্থাৎ কালক্রমে দক্ষ জনবলের মাধ্যমে তারা নিজেদের প্রযুক্তি খাত উন্নত করেছে এবং মুদ্রা, প্রযুক্তি ও জনবলে সমৃদ্ধ হয়েছে। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, শিক্ষায় পরিকল্পিত বিনিয়োগ ও ব্যবস্থাপনা অতীব জরুরি।
বাংলাদেশের মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতের কোনো বিকল্প নেই। অনতিবিলম্বে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ বিষয়ে বিশেষ মনোযোগী হতে হবে। বাড়াতে হবে বরাদ্দ। শিক্ষকদের জীবনমানের উন্নয়ন, প্রশিক্ষিত শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের জন্য ইতিবাচক প্রণোদনা, সুপাঠ্য পাঠ্যপুস্তক ও উন্নত কারিকুলাম, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও গবেষণায় বিপুল অর্থের প্রয়োজন রয়েছে।
বর্তমান বিশ্ব প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠেছে। বৈশ্বিক মানচিত্রে জায়গা করে নিতে প্রয়োজন প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও গবেষণাকর্মের অগ্রগতি। বিজ্ঞান ও গণিতে দক্ষতা বাড়ানো এক্ষেত্রে অতিপ্রয়োজনীয়। নয়তো চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে হিমশিম খেতে হবে দেশকে। প্রযুক্তিনির্ভর না হলে দেশের উৎপাদন ব্যবস্থায় শ্লথগতি দেখা দেবে। অন্যদিকে মানুষ কর্মচ্যুত হবে। প্রথাগত কাজে মানুষের প্রয়োজন ফুরাবে। কর্মচ্যুত মানুষকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেয়া সম্ভব কর্মমুখী শিক্ষার মাধ্যমে। কেননা উৎপাদনের সব উপকরণই নতুন কাজের ক্ষেত্র তৈরি করে। সে অনুযায়ী জনগণকে দক্ষ করতে পারলে দেশে বেকারত্ব চড়াও হয় না, বরং মানসম্মত শিক্ষার মাধ্যমে সামাজিক গতিশীলতা ও মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়বে।
শিক্ষার ক্ষেত্রে যেসব প্রকল্প নেয়া হয়েছে, সেগুলোর ব্যয় সঠিকভাবে নিরূপণ করা হয়েছে কিনা এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় কোনো প্রকল্প নেয়া হয়েছে কিনা সেটি দেখা দরকার। যদি কোথাও ব্যয় কমানোর সুযোগ থাকে, তবে সেটি কমিয়ে গবেষণা বা শিক্ষার মান উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে শিক্ষাক্রমে যুগোপযোগী সংস্কার আনতে হবে। বরাদ্দকৃত অর্থ যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে তদারকিও আবশ্যক। অর্থাৎ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি সংস্কার অতীব জরুরি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এসব বিষয় বিবেচনায় নেয়া উচিত।