শিক্ষাখাতে টেকসই সংস্কারে যেমন ‘উপাচার্য ’ প্রয়োজন
Share on:
রাষ্ট্র বা দেশ সংস্কার করবে তো রাজনীতিক ও রাষ্ট্রনায়করা। এখানে উপাচার্যের কাজ কী? প্রশ্নটি খুবই সরল ও স্বাভাবিক। তাই এর একটি সরল উত্তরও আগে দেয়া দরকার। বর্তমান সরকারসহ গত ৩৪ বছরে বাংলাদেশ ছয়টি অরাজনৈতিক বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেখেছে। দেশের অধিকাংশ জনগণ ওই সরকার ও শাসন ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট ছিলেন।
কিন্তু সেই শাসন ব্যবস্থা যেমন টেকসই হয়নি, তেমনি টেকসই হয়নি সেই জনসন্তুষ্টি। এর কারণ সরকার ও শাসন ব্যবস্থায় পরবর্তী সময়ে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের অধিকাংশের টেকসই রাষ্ট্র সংস্কার করার যোগ্যতা বা সদিচ্ছা ছিল না।
টেকসই রাষ্ট্র সংস্কারের সুফল পেতে হলে শুধু রাজনীতিক নয়, সব সরকারি-বেসরকারি খাতের বিভিন্ন পর্যায়ে যারা নেতৃত্ব দেন, তাদেরও যোগ্যতা ও সদিচ্ছার স্বাক্ষর রাখতে হবে। এখানে বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকজন যোগ্য, দায়িত্বশীল ও সদিচ্ছুক নাগরিক দিয়ে টেকসই রাষ্ট্র সংস্কার নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এজন্য দরকার বিপুলসংখ্যক যোগ্য, দায়িত্বশীল ও সদিচ্ছুক নাগরিক, যা ব্যাপক পরিকল্পনা ছাড়া নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। কিন্তু তাদের আমরা কোথায়, কীভাবে পাব?
বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি খাতের দায়িত্বশীল নেতৃত্ব বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তাদের অধিকাংশই দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট। অদূর ভবিষ্যতেও হয়তো তারাই এসব খাতের নেতৃত্ব দেবেন। অতএব বিভিন্ন খাতের এসব ভবিষ্যৎ নেতৃত্বকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপরিকল্পিত শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে গড়ে তুলতে হবে। তা না হলে আমাদের কোনো সংস্কারই টেকসই বা স্থায়ী হবে না। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে এ সুপরিকল্পিত শিক্ষা ব্যবস্থার নেতৃত্ব দেন উপাচার্যরা। এ কারণে টেকসই রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য সুপরিকল্পিত শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি করা আর এ শিক্ষা ব্যবস্থার কাণ্ডারী হিসেবে উপযুক্ত উপাচার্য নিয়োগ করা একই সূত্রে গাঁথা।
এখন রাষ্ট্রের টেকসই সংস্কার ও উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশের একজন যোগ্য উপাচার্যের যেসব যোগ্যতা ও গুণ থাকা উচিত, সেটা উন্নত বিশ্বের একজন উপাচার্যের সঙ্গে তুলনা করলে বিভ্রাট ঘটতে পারে। কারণ বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তবতা আর উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তবতা অনেকটাই ভিন্ন। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্যকে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কাজে যে পরিমাণ সময়, শ্রম ও মেধা ব্যয় করতে হয় তার থেকে অনেক বেশি সময়, শ্রম ও মেধা ব্যয় করতে হয় নন-একাডেমিক অপকাজ সামাল দিতে।
বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্যের প্রথম যে গুণটি থাকা উচিত তা হলো চেয়ারের মায়া ত্যাগ করতে পারার হিম্মত। চেয়ারের মায়া ত্যাগ করতে পারার এ হিম্মত অর্জন করার জন্য দরকার স্ফটিককঠিন সততা, উন্নত রুচি আর দৃঢ় ব্যক্তিত্ববোধ। বাংলাদেশে অনেক গুণী শিক্ষাবিদ এ চেয়ার আঁকড়ে থাকার মায়ায় পড়ে যান; চরিত্রের স্খলন ঘটান। চেয়ারের মায়ায় পড়া উপাচার্যরা অযোগ্য শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থার বারোটা বাজিয়ে দেন। জনবল যদি অযোগ্য হয় তাহলে সেখানে আর কিছুতেই কিছু হয় না। কারণ যোগ্য জনবল হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মূল ভিত্তি।
চেয়ারের মায়া ত্যাগ করতে পারার হিম্মত কেন গুরুত্বপূর্ণ তা একটু ব্যাখ্যা করা যাক। এতদিন বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ হয়েছে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক তদবিরের ভিত্তিতে। ফলে তদবিরের ঋণ শোধ করতে গিয়ে উপাচার্যদের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ এবং উন্নয়ন প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নির্বাচনে তদবির ও চাপ সামলাতে হয়েছে। অনেক উপাচার্য চেয়ারের মায়ায় পড়ে এ তদবির ও চাপের কাছে নৈতিক পরাজয় মেনে নিয়েছেন। চেয়ারের মায়ায় পড়া এসব উপাচার্যের হাত দিয়ে দূরদর্শী ও মানসম্পন্ন শিক্ষায়তনিক কোনো পদক্ষেপ আসে না, গড়ে ওঠে না স্বপ্নের আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয়।
দু-একজন উপাচার্য হয়তো এ চেয়ারের মায়া কাটিয়ে তদবির ও অনৈতিক চাপের কাছে পরাজয় স্বীকার করেননি। কিন্তু এ ধরনের ঘটনা খুবই বিরল, বিচ্ছিন্ন ও ব্যতিক্রমী। দেশকে পরিবর্তন করতে হলে সবার আগে শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তন করতে হবে আর শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তন করতে হলে নগণ্যসংখ্যক চেয়ারের মায়া অতিক্রমকারী উপাচার্য দিয়ে ব্যাপক পরিবর্তন করা যাবে না।
একজন উপাচার্যকে অবশ্যই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হতে হবে। তিনি যদি দেশের বর্তমান চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যতের চাহিদা অনুযায়ী কারিকুলাম প্রস্তুত ও তা বাস্তবায়নের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে না পারেন তাহলে তিনি হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে অচল পাঠ্যক্রম পড়ানোর মাধ্যমে জনজঞ্জালে পরিণত করবেন। আধুনিক বিশ্বের পাঠ্যক্রমের সঙ্গে আমাদের বাস্তব চাহিদার নিরিখে তিনি বাস্তবসম্মত ও যুগোপযোগী পাঠ্যক্রম প্রণয়নের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।
স্বপ্নের বাংলাদেশের উপাচার্যকে অবশ্যই শিক্ষার্থীবান্ধব হতে হবে। একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কী চায়, কেন চায়, কীভাবে চায়—এ বিষয়গুলো বাংলাদেশে কখনই গুরুত্ব পায় না। যাদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়, তাদের চাহিদা ও মতামত হিসাবের বাইরে থেকে যায়। তাদের মতামত ও চাহিদা গুরুত্ব পায় না বলে তারা পড়াশোনায় অনিচ্ছুক ও অমনোযোগী হয়ে পড়ে। ফলে অনিচ্ছুক ও অমনোযোগী শিক্ষার্থী দিয়ে আমরা দেশের জন্য কাঙ্ক্ষিত মানের গ্র্যাজুয়েট তৈরি করতে পারি না। শিক্ষার্থীদের সময়ের মূল্য বুঝতে হবে এবং যথাসময়ে সেমিস্টার সম্পন্ন করার ব্যাপারে উপাচার্যকে কঠোর ও আন্তরিক হতে হবে। শিক্ষার্থীরা হলগুলোয় কী খায় আর কীভাবে থাকে, সে ব্যাপারে তাকে জানতে হবে ও থাকা-খাওয়া-পড়াশোনার আদর্শ পরিবেশ তৈরিতে আন্তরিক হতে হবে। আমাদের গ্র্যাজুয়েট যেন বিশ্বের যেকোনো দেশের গ্র্যাজুয়েটদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে সে পদক্ষেপ নিতে হবে।
আগামীর উপাচার্যকে অবশ্যই শিক্ষকবান্ধব হতে হবে। অনেক সময় দেখা যায়, উপাচার্যরা শিক্ষকমণ্ডলীকে কোণঠাসা করতে পছন্দ করেন বা প্রতিপক্ষ ভাবেন। নানা কারণে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতা এখন একটি প্রান্তিক ও বঞ্চিত পেশায় পরিণত হয়েছে। শিক্ষকদের আন্তরিক ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিবেদিতপ্রাণ করতে হলে এ বঞ্চনা দূরীকরণের উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষকদের বঞ্চনা ও অপ্রাপ্তির জায়গাটা বোঝার মতো সংবেদনশীলতা একজন উপাচার্যের থাকতে হবে। একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের বঞ্চনার তালিকাটা এত বড় যে তার জন্য একটি আলাদা নিবন্ধ লেখা যায়। একটা উদাহরণ দিলেই বিষয়টা সহজে অনুমান করা যাবে। যেমন পঞ্চম গ্রেডের একজন আমলা শুধু গাড়ি আর বাড়ি বাবদ প্রতি মাসে যে বাড়তি সুবিধা পেয়ে থাকেন তা একজন সদ্য যোগদানকৃত তৃতীয় গ্রেডের অধ্যাপকের সমুদয় মাসিক বেতন-ভাতার থেকেও বেশি।
উপাচার্যকে অবশ্যই প্রকৃত অর্থে গবেষণাবান্ধব হতে হবে। দায় এড়ানোর জন্য ১০০ বছর আগে সত্যেন বোস আর জগদীশ চন্দ্র বসুর মতো বিনা পয়সায়, বিনা প্রণোদনায় গবেষণা করতে বললে হবে না। বর্তমান সময়ের চাহিদা আলাদা; গবেষণার ধরন ও উপকরণ আলাদা। আর সবাই সত্যেন বোস আর জগদীশ চন্দ্র বসু হতে পারবেন না। গবেষণা করতে সময়, মেধা ও শ্রমের পাশাপাশি এখন প্রচুর উপকরণ ও অর্থ লাগে। গবেষণাপত্র প্রকাশ করতেও লাগে অনেক টাকা।
একটা মানসম্মত জার্নালে এখন গবেষণাপত্র প্রকাশ করতে গেলে যে পরিমাণ অর্থ লাগে তা একজন শিক্ষকের দু-তিন মাসের সমুদয় বেতনের থেকেও বেশি। অনেক দেশে ভালো জার্নালে গবেষণাপত্র প্রকাশ করতে পারলে মোটা অংকের প্রণোদনা পাওয়া যায়। আর আমাদের সারা বছর ধরে চাল-ডাল কেনার টাকা বাঁচিয়ে এপিসি (আর্টিকেল প্রসেসিং চার্জ) পরিশোধ করতে হয়। অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজের অনেক জার্নালে ৩-৪ হাজার পাউন্ড লাগে একটা আর্টিকেল প্রকাশ করতে। একজন গবেষণাবান্ধব উপাচার্যকে এ ব্যাপারে বাস্তবানুগ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, উপযুক্ত গবেষণা ভাতা ও প্রণোদনার উদ্যোগ নিতে হবে।
আমরা এখনো অনেক পণ্য আমদানি করি যা দেশেই উৎপাদন করা সম্ভব। ফলে আমাদের নতুন গবেষণার পাশাপাশি দেশে এসব পণ্য উৎপাদনে সক্ষম জনবল তৈরিতেও মনোযোগী হতে হবে, বাস্তুবমুখী কারিকুলাম প্রস্তুত ও বাস্তবায়ন করতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান মৌলিক ও নতুন গবেষণার থেকে দেশ-বিদেশে চাহিদা আছে এমন পণ্য উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়াতে মনোযোগ দিয়েছিল। কাজটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই শুরুর উদ্যোগ নিতে হবে।
আর দশটা পেশার মতো শিক্ষকদের মধ্যেও ভালো ও খারাপ; যোগ্য ও অযোগ্য মানুষ থাকে। একজন উপাচার্যকে জানতে হবে কারা বিশ্ববিদ্যালয়কে সামনে এগিয়ে নিতে চায় আর কারা নিতে চায় পেছনে। সুবিধাবাদী তেলবাজ চেনার সচেতন চেষ্টা থাকতে হবে। এজন্য বিভিন্ন দায়িত্বে সঠিক লোক চয়ন করার জন্য উপাচার্যকে হতে হবে সৎ ও প্রজ্ঞাবান। সদিচ্ছা থাকলে অন্যান্য গুণ অর্জন করে ঘাটতি পূরণ করা যায়; কিন্তু সততা ও প্রজ্ঞার ঘাটতি পূরণ করা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার।
একজন উপাচার্য খারাপ নাকি ভালো হবেন সেটা নির্ভর করে সরকার কাকে, কোন প্রক্রিয়ায়, কিসের ভিত্তিতে চয়ন করে, তার ওপর। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান হিসেবে আচার্য কীভাবে একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর উপাচার্যদের কাছে বিভিন্ন অভিযোগের জবাবদিহি চান, সেটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জবাবদিহির অভাবে একজন ভালো মানুষও নানা পরিস্থিতি ও চাপে পড়ে খারাপ হয়ে যায়। একজন অযোগ্য ও খারাপ উপাচার্যের কারণে একটা সাজানো-গোছানো বিশ্ববিদ্যালয় রসাতলে যেতে সময় লাগে না।
সর্বোপরি একজন উপাচার্যকে সব ধরনের চাপমুক্ত, বিশেষ করে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। উপাচার্য হওয়ার জন্য অত্যুৎসাহী ব্যক্তিকে আগেই তালিকা থেকে বাদ দেয়া উচিত। উৎসাহী হয়ে যারা দায়িত্ব ও ক্ষমতা চেয়ে নেয়, তাদেরকে মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) দায়িত্ব ও ক্ষমতা দিতে নিরুৎসাহিত করেছেন। এ ব্যাপারে প্লেটো বলেন, ‘অনিচ্ছুক শাসক হচ্ছে শ্রেষ্ঠ শাসক, আর যে শাসক শাসনকার্য পেতে মরিয়া সে নিকৃষ্টতম শাসক’।