শিক্ষক রাজনীতির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান ‘নড়বড়ে’
Share on:
আমি ২০১৫ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। নির্বাচিত হওয়ার কিছুদিন পর সরকার কর্তৃক অযাচিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের গ্রেড অবনমন করা হয়।
এর বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের নেতৃত্বে অনেক আন্দোলন হয় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিও ছিল অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকায়। আন্দোলন এক সময় দানা বেঁধে ওঠে এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবমাননামূলক মন্তব্যের জেরে সরাসরি প্রতিবাদ না জানালেও প্রতীকী প্রতিবাদ জানান।
তখন ফেডারেশনের কর্তাব্যক্তিরা ফেডারেশনের সভায় আলোচনা না করেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতাদের ফেডারেশন থেকে বহিষ্কার করেন। তৎকালীন ফেডারেশনের শীর্ষ নেতৃত্বে অত্যন্ত সজ্জন শিক্ষকরা ছিলেন। হয়তোবা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর রক্তচক্ষুকে ভয় পেয়ে তারা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আমার কেন জানি মনে হয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিকে তখন বহিষ্কার না করলে হয়তোবা শিক্ষকদের আন্দোলন আরো আগেই সফলতা পেত।
ফেডারেশন নেতারা তখন আমার ওপর অত্যন্ত নাখোশ হয়েছিলেন। তবে পরে তারা বিভিন্ন সাক্ষাতে আমার সঙ্গে অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ করেছেন। অনেক আন্দোলন ও আলোচনার পর সরকার এক সময় শিক্ষকদের একটি দাবি মেনে নেয়। আসলে এটি নতুন কোনো দাবিই ছিল না। এটি ছিল মূলত বিদ্যমান গ্রেড কেড়ে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মাসের পর মাস রাস্তায় নামিয়ে ও বিভিন্ন ধরনের অপমান করে আবার গ্রেড ফিরিয়ে দেয়া। ২০২৪ সালে শেখ হাসিনার সরকার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অহেতুক সর্বজনীন পেনশন স্কিমে (যার প্রতি দেশের মানুষের কোনো আকর্ষণ বা আস্থা ছিল না) অন্তর্ভুক্ত করে আরো একবার ঝামেলায় ফেলে দেয়।
এবার এক মাস কর্মবিরতির পরও কোনো ফলপ্রসূ আলোচনা তো দূরে থাক, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বললেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা বুঝতে অক্ষম ছিল। চীনফেরত সাবেক প্রধানমন্ত্রী ১৪ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের রীতিমতো তুলোধুনো করলেন ও আন্দোলন করে ক্লান্ত হয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীদের ত্যাগ ও বীরত্বের কাহিনী সবারই জানা। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার পদত্যাগের আগে তিনি এ প্রত্যয় স্কিম থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকসহ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানকে বাদ দেন। শিক্ষকদের আন্দোলনের কারণে করেনি এটি, বরং ছাত্র আন্দোলনের তীব্রতার কারণেই সরকার এটি বাতিল করেছিল।
২০১৫ সালের মতো ২০২৪ সালেও সাবেক প্রধানমন্ত্রী তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন কিন্তু শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন এর প্রতিবাদ তো দূরের কথা, সামান্যতম মনোবেদনাও প্রকাশ করেনি। তবে বিভিন্ন ফোরাম এবারের অবমাননার জোরালো প্রতিবাদ জানিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ২০১৫ সাল গ্রেড অবনমন ও ২০২৪ সালে শিক্ষকদের প্রত্যয় স্কিমে অন্তর্ভুক্ত করা—এ দুটো বিষয়েই সরকারপ্রধানকে আমলারা ভুল বুঝিয়েছেন বলে দাবি করেন শিক্ষক নেতারা, যা অত্যন্ত হাস্যকর।
‘উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপিয়ে’ শিক্ষকরা আমলাদের সঙ্গে শিক্ষকদের একটি অপ্রয়োজনীয় দ্বন্দ্ব সামনে এনে কেবল মানসিক সান্ত্বনা পেতেন। এর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রতি শেখ হাসিনার শ্যেন দৃষ্টিকে আড়াল করতে চাইতেন। এসব বিষয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী যদি ঠিকমতো বুঝতেই না পারতেন তাহলে সেটি ছিল তার অক্ষমতা এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় নিদারুণ ব্যর্থতা, যা অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে। সরকার পতনের পর আরো অনেক কিছু্ই নতুনভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। ২০১৪ সালে বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠনের পর থেকেই তিনি স্বৈরাচারী হয়ে ওঠেন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা ছিলেন তার স্বৈরাচারী কর্মকাণ্ডের অন্যতম শিকার।
তার ও তার দলের নেতাকর্মীদের প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষকের অতিমাত্রায় তোষামোদের ফলে শিক্ষকের মর্যাদা অনেক নিচে নামিয়ে আনা হয়েছে। যার কারণে তিনি ধারণা করেছিলেন, তোষামোদকারী সেসব শিক্ষকের মতো অন্য শিক্ষকদের কোনো আত্মসম্মানবোধ নেই এবং যা খুশি তা বলা কিছু বিষয় না। বিগত সরকারের আমলে তোষামোদিতে যেসব শিক্ষক জড়িত তাদের সংখ্যা মোট শিক্ষকের ১-২ শতাংশের বেশি নয়।
গত জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা হিসেবে শেখ হাসিনার বিচার হয়তো হবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বার বার অপমানের জন্য শেখ হাসিনা বা তার বংশধররা বা আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব কখনই কোনো দুঃখপ্রকাশ করবে না। এখনো যেসব শিক্ষক আওয়ামী লীগের রাজনীতি টিকিয়ে রাখার জন্য চেষ্টা করছেন সে বিষয়টির একটি বিহিত হওয়া প্রয়োজন।
এবারের আন্দোলনের ফসল কী—এটা নিয়ে কোনো মন্তব্য করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। গতানুগতিকভাবে নির্বাচিত ও অনেকটা গুরু-শিষ্য ধাঁচে গঠিত এ ফেডারেশনের কার্যকারিতা অত্যন্ত দুর্বল বলে বার বার প্রমাণিত হয়েছে।
উল্লেখ করা দরকার, ২০১৬ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের শীর্ষ নেতারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুগত শিক্ষকদের পদ-পদবি ভাগাতে বেশ সাফল্য পেয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। আরো অভিযোগ আছে, এ ফেডারেশনের নেতারা অবলীলায় শিক্ষকদের স্বার্থকে বিসর্জন দিতে পারেন, যা অন্য কোনো গোষ্ঠী কখনো করেন না। ফেডারেশনের বর্তমান নেতাদের নিজে থেকেই সরে যাওয়া উচিত বলে দাবি করেছেন কিছু শিক্ষক। তবে ফেডারেশনের শীর্ষ নেতাদের এ ব্যাপারে ব্যাপক আত্মজিজ্ঞাসার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। আমার এ মতের সঙ্গে অনেক শিক্ষক একমত হবেন বলে আশা করি। তবে এ ব্যাপারে আরো আলাপ-আলোচনা হতে পারে ও ভিন্নমতও আসতে পারে।
সে যা-ই হোক, বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষক সপ্রতিভ ও উচ্চকণ্ঠ তারা একটি অর্থবহ জোট গড়ে তুলতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক একটি কার্যকর মোর্চা হিসেবে দেশের ক্রান্তিকালে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এ নেটওয়ার্কের শিক্ষকরা বৃহত্তর সম্মিলন ঘটাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের মনের ভাষা পড়তে ইচ্ছুক, সক্ষম ও শিক্ষার্থীবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলতে একটি কার্যকর ও সমন্বিত কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেতৃত্ব এখন সময়ের দাবি।
বর্তমানে শিক্ষার্থীবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা কিন্তু সহজ নয়। দীর্ঘদিন ধরে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে বিগত সরকারের এক ধরনের দখলদারত্ব কায়েম ছিল। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসনের প্রথম কাজ হবে হলগুলোয় মেধার ভিত্তিতে আসন বণ্টন করা এবং কোনো ধরনের ভয়ভীতি ছাড়া শিক্ষার্থীদের সহাবস্থান নিশ্চিত করা। অনতিবিলম্বে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করে স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি মুক্ত ও ভয়ভীতিহীন পরিবেশ নিশ্চিত করা। এসব কঠিন ও অতীব প্রয়োজনীয় কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করতে গ্রহণযোগ্য ও সাহসী শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করে কাজগুলোকে সুচারুভাবে করতে হবে।
বিভিন্ন ক্যাম্পাসে এখনো এক ধরনের ভয়ের আবহ বিরাজ করছে। নতুন প্রশাসনকে এ ভয়ের বাতাবরণ ভেঙে ছাত্র আন্দোলনের প্রকৃত ফসল উপহার দিতে হবে। নতুন প্রশাসনগুলোকে উপরোক্ত কাজ করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকতে হবে। একটি বৃহত্তর, অর্থবহ, কার্যকর ও সমন্বিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মোর্চা এক্ষেত্রে সহায়কের ভূমিকা পালন করতে পারে।