‘লিস্ট’ নিয়ে যত কথা!
Share on:
শৈশবে লিস্ট বলতে কেবল বাজারের লিস্টের কথাই মনে আসত। সে সময় মানুষ পণ্য-তালিকা নিয়ে বাজারে যেতেন। এখন সবার হাতে হাতে মোবাইল ফোন; কষ্ট করে কেউ লিস্ট নিয়ে বাজারে যান না। মোবাইলেই টুকে রাখেন সবকিছু।
বাজারের লিস্টের পর পড়াশোনার খাতিরেই ‘চেক লিস্ট’ টার্মের সঙ্গে পরিচিত হই। পাশাপাশি বইপত্রের লিস্ট। এরপর শুনি শর্টলিস্ট, হটলিস্ট, হিটলিস্টের কথা।
জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরুর পর থেকেই নানা লিস্ট দেখছি। প্রথমে সরকারের পক্ষ থেকে ছিল আন্দোলনকারীদের লিস্ট। বিভিন্ন স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষার্থী আন্দোলন করেছেন, যারা এই আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছেন– সবাইকে নিয়ে লিস্ট। বিভিন্ন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপেও নানা ধরনের লিস্ট পাওয়া যেত।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনের পর থেকে পাল্টা নানা লিস্ট হতে থাকে। প্রথম লিস্ট, কারা হবেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরতে থাকে বিভিন্ন তালিকা। কোন তালিকা বিশ্বাসযোগ্য, এ নিয়ে ফেসবুকে ঝগড়া-বিবাদও শুরু হয়।
৮ আগস্ট নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ শপথ গ্রহণের দিন থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নতুন ধরনের লিস্ট প্রকাশ শুরু হয়: নিয়োগ বাতিলের লিস্ট, পদোন্নতির লিস্ট, বঞ্চিতের লিস্ট, নতুন নিয়োগ লিস্ট, পদত্যাগের লিস্ট, বাধ্যতামূলক অবসরের লিস্ট।
পাশাপাশি সামাজিক মাধ্যমে চলতে থাকে ‘চাই চাই’ লিস্ট। যেমন, অমুককে তমুক জায়গায় সমুক পদে দেখতে চাই। বিগত সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে যারা ছিলেন, কর্মকাণ্ডের সাফাই গেয়েছেন বা সমর্থন করেছেন, তাদেরও লিস্ট হতে থাকে। এমনকি বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতাদের লিস্টও প্রকাশ হতে থাকে। সঙ্গে ছিল কারও কারও দেখে নেওয়ার লিস্ট, বয়কটের লিস্ট, মব জাস্টিসের লিস্ট, পর্দা না করাদের লিস্ট, হিজাববিরোধী শিক্ষকদের লিস্ট।
আবার এমনও খবর হতে থাকে, কে কাকে ‘গোপন’ লিস্ট দিয়েছেন। কেউ প্রশ্ন করেনি, সেটা ‘গোপন’ হলে ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপে আসে কীভাবে? যেমন সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের ‘খালু’ উপদেষ্টা পরিষদে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে নিয়োগ দেওয়ার জন্য চারজন শিক্ষকের একটি লিস্ট তিনি সেই উপদেষ্টাকে পাঠিয়েছেন। আমি নিশ্চিত, এই ধরনের ‘লিস্ট’ পাঠানোর খবর স্বয়ং উপদেষ্টাকে বিব্রত করেছে।
এসব যারা করছেন, তারা একবারও ভাবছেন না, যাদের নাম এ ধরনের লিস্টে দেওয়া হচ্ছে, তাদের জন্য বিষয়টি কতটা বিব্রতকর। সামাজিকভাবে হেনস্তামূলক তো বটেই, এমনকি অনেকের জন্য নিরাপত্তারও বিষয়।
বস্তুত দেশের মানুষ যেন একেকজন জীবন্ত উইকিপিডিয়া হয়ে ফেসবুকে আবির্ভূত হন। সেখানে প্রস্তাবিত যে কোনো লিস্টেরই বিভিন্ন ব্যক্তির বিভিন্ন ব্যক্তিগত তথ্য, পারিবারিক তথ্য, আত্মীয়স্বজনের তথ্য, কোন জমানায় কী করেছেন সেগুলো নিয়ে হাজির হচ্ছেন। যার কারণে দেখা যায়, সেই লিস্টের বাস্তবায়ন না হলেও নানাভাবে তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হেনস্তার শিকার হচ্ছেন।
লিস্ট যখন গোপনীয়তার প্রতিশ্রুতির দেয়াল টপকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যাচ্ছে, তাতে লিস্টদাতা ও গ্রহীতা উভয়েই বিপাকে পড়ছেন। আবার লিস্ট নিয়ে কখনও তৈরি হচ্ছে নানা ধরনের আতঙ্ক, উত্তেজনা ও অনিরাপত্তাবোধ। ‘অমুক লিস্টে অমুকের নাম আছে’ শুনেই অনেকে বাসাবাড়িতে থাকার সাহস পাচ্ছেন না।
আবার গুরুত্বপূর্ণ পদের নিয়োগেও বিভিন্ন মহল থেকে আসা লিস্ট নিয়ে আলোচনা চলছে। বলা হচ্ছে, এই নিয়োগ সেই দলের লিস্ট: কোনো কোনো ক্ষেত্রে নাম ধরে বলা হচ্ছে, বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের লিস্ট, বিএনপির লিস্ট, জামায়াতের লিস্ট ইত্যাদি। প্রশ্ন হচ্ছে, এ ধরনের লিস্ট কি আসলেই কোনো পক্ষ পাঠায়? পাঠালে সেটা সামাজিক মাধ্যমে আসে কীভাবে? এসব লিস্টের ব্যাপারে সরকার থেকে কিংবা সরকারের অংশীজন বিভিন্ন দল থেকে ব্যাখ্যা দেওয়া হয় না কেন?
মজার ব্যাপার হলো, কোনো যাচাই ছাড়াই লিস্টগুলো কোনো কোনো সংবাদমাধ্যমে বিশেষত অনলাইন মাধ্যমেও প্রকাশ হয়ে যাচ্ছে। হয়তো প্রকাশও হয়নি। সামাজিক মাধ্যমে দেখেই কেউ কেউ অভিনন্দন জানানো শুরু করে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এগুলো ভুয়া লিস্ট। কিন্তু এমন ঘটনাও বিচিত্র নয় যে, আসল লিস্টও সামাজিক মাধ্যমে আসার পর নানা রাজনীতি, গোষ্ঠীবাদ ও দেনদবারের কারণে কেউ একজন সেই লিস্ট থেকে বাদ পড়ে গেলেন। তখন তাঁর অবস্থা কী হয়? যেমন শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক কমিশনে (বিএসইসি) একজন অর্থনীতিবিদকে সত্যিই নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে তুমুল বিতর্কের তোড়ে তিনি জানিয়ে দেন, ওই পদে আগ্রহী নন।
কেন এই সময়ে এসে লিস্ট সংস্কৃতি এবং লিস্ট তৈরি করার রাজনীতি এবং সেটিকে গুরুত্বপূর্ণ ‘অ্যাক্টর’ হিসেবে আমলে নেওয়ার প্রবণতা তৈরি হলো?
এতদিন রাজনীতিতে আমরা সাধারণত দুই ধরনের লিস্টের চর্চাই দেখেছি। মূলত ‘আস্কারার লিস্ট’ এবং ‘দমন লিস্ট’। সেগুলো সরকারিভাবেই হতো। বিপরীতে চিত্রটি খুবই আশা প্রদানকারী যে, এখন যে কেউ এই লিস্ট করার মতো শক্তি ও সামর্থ্য নিয়ে হাজির হতে পারছেন। সবার কাছেই ‘অনুকরণীয়’ এবং ‘বিশিষ্ট’ ব্যক্তি রয়েছেন, তারা তাদের বিভিন্ন পদে দেখতে চান। এই পরিসর তৈরি একটা বড় অর্জন।
লিস্ট করা কিংবা লিস্ট নিয়ে কথা বলা কোনোভাবেই ‘নিরীহ’ কিংবা ‘অরাজনৈতিক’ হিসেবে পাঠ করা যাবে না। এই লিস্ট তৈরি আসলে উৎপাদন ও চর্চা করছে বিশাল ক্ষমতা। যদিও বা লিস্ট করতে পারেন কিন্তু কার লিস্ট কিংবা কাদের লিস্ট গুরুত্ব পাবে, সেটা নিয়ে চলছে প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
লিস্টের উৎপাদন প্রক্রিয়া বিভিন্ন ক্ষমতাকে যেমন সামনে আনছে, তেমনি খারিজ করছে বৃহৎ পরিসরে আলোচনার জায়গাগুলোও। কারণ এই লিস্ট সবার সম্মতি আদায়ে সক্ষম কিনা, সেটি কি আমরা তলিয়ে দেখছি?