‘লাল রং’ যেভাবে প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠল
Share on:
দুনিয়ায় লাল কেবল একটা বিষয়ে সংখ্যালঘু। মাত্র ১ থেকে ২ শতাংশ মানুষের চুলের রং লাল। বাকি বিবরণ লালের পক্ষে।
শুনেছি, লাল সেই রং, যা অন্য কোনো রং মিশিয়ে বানানো যায় না। সে জন্যই চিত্রকরেরা একে প্রাথমিক রং বা প্রাইমারি কালার বলেন। রঙের জগতে এ রকম আছে আর কেবল নীল ও হলুদ। এই তিনের মাঝে আবার লাল রাজনৈতিক-সামাজিক-ঐতিহাসিক কারণে মর্যাদায় এক ধাপ এগিয়ে। তার রয়েছে দারুণ বর্ণিল আর আবেগময় ইতিহাস।
লাল কাপড়ে শোকমিছিল
আজকের দিনে অনেকে মনে করেন, লাল মানেই যুদ্ধ-বিপ্লব-পরিবর্তনের প্রতীক। বাংলাদেশেও চলতি গণ–আন্দোলনে লাল হয়ে উঠছে সংগ্রামীদের পরিচয়–চিহ্ন। অতীতে শোকমিছিল হতো মুখে বা মাথায় কালো কাপড় বেঁধে। মিছিলের সামনে কেউ একজন লাঠিতে কালো কাপড়ের টুকরা বেঁধে রাখতেন।
এখন হচ্ছে কালোর বদলে লাল কাপড়ে। অর্থাৎ এই শোক শক্তিতে পরিণত হয়ে নতুন কিছু বলতে চায়, অর্জন করতে চায়, গড়তে চায়। সে ক্ষুব্ধ হলেও ক্ষোভের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যেতে চায় না। রোমান পুরাণে লালকে এভাবেই সাহসের স্মারক হিসেবে দেখা হয়েছে। লাল মঙ্গল গ্রহের কথাও স্মরণে আনে সেটা।
বাংলাদেশে গণ–আন্দোলনে মানুষ যত মরছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় নেটিজেনরা হাজারে হাজারে তাদের ওয়াল লালে রাঙিয়ে চলেছে। বলা যায়, দেশের তরুণ-তরুণীদের মাঝে এ সপ্তাহে লাল তরঙ্গ বইছে। তবে লাল উৎসব-আনন্দের রংও বটে। আবার ক্ষয়ক্ষতির রংও। রং হিসেবে লালের শক্তির জায়গাটা এখানেই। সে সংঘাত ও আনন্দের প্রতীক। যুদ্ধেরও রং। আবার যুদ্ধ শেষে নতুন সমাজের পতাকাও হয়ে ওঠে এই রং।
তবে এ রকম লালপ্রীতির দু–চারটা সমালোচনাও দেখা যাচ্ছে। সে রকম ভিন্নমত বলছে, লাল তো রক্তের রং। তাহলে কি নতুন এই লাল তরঙ্গ আরও সহিংসতা চাইছে? আসলে এ হলো বোঝার ভুল। লাল রক্তের রং হলেও রক্ত নিজে কিন্তু মৃত্যু নয়—আদিতে জীবনের প্রতীক ছিল।
শেয়ারবাজারে লোকসানি কোম্পানির ওপর লাল রং মেখেই ঘটনা বুঝিয়ে দেওয়া হয়। আবার সম্পদের দেবী লক্ষ্মীর পোশাক লাল রাখা হয়—যেখানে ‘সম্পদ’ মানে সুখ-সমৃদ্ধি-স্বস্তি। চীনেও লালকে উর্বরতা ও সুখের প্রতীক মনে করা হয়। বিশ্বব্যাপী খেলার মাঠে যেমন লাল কার্ড নিয়ে সর্বোচ্চ দুর্ভাবনা থাকে, তেমনি ইউরোপ-আমেরিকায় বিনোদনজগতের দুনিয়া–কাঁপানো শোগুলোয় রাজত্ব থাকে এ রঙেরই। অনেক দেশে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় অতিথি এলে লাল কার্পেট ভিজিয়ে ভালোবাসার ব্যাপকতা বোঝানো হয়।
এত সব কারণে রং-মনোবিজ্ঞানে যেকোনো শক্তিশালী আবেগের বেলায় প্রশ্নহীনভাবে লালকে বাছাই করা হয়, যা দেখে মানুষের হৃদ্যন্ত্রের গতি বাড়বে। লালকে বিবেচনা করা হয় সবচেয়ে শক্তিশালী উদ্দীপক হিসেবে।
হঠাৎ সৃষ্ট লাল তরঙ্গ যেন এক যৌথ ইশতেহারের মতো
বাংলাদেশের গণ–আন্দোলনে লালের আধিপত্য নিশ্চিতভাবে তাৎপর্যবহ। ইতিমধ্যে এই আন্দোলনে নিহতের সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়েছে। ছাত্রদের সঙ্গে সংহতি জানাতে গিয়ে মরেছেন অনেক শ্রমজীবী মানুষও। নিহতের তালিকায় শেষে যুক্ত হওয়া এই মানুষগুলো নিশ্চয়ই কোটাব্যবস্থা সংস্কারের চেয়েও বড় কোনো আর্থসামাজিক সংস্কার চাইছিলেন। প্রথম আলো ৩১ জুলাই এক প্রতিবেদনে দেখিয়েছে, আন্দোলনে গ্রেপ্তার হওয়া ৮৭ শতাংশ মানুষের কোনো দলীয় রাজনৈতিক পরিচয় নেই—তাদের বড় অংশ খেটে খাওয়া শ্রমজীবী। তারই ধারাবাহিকতায় এখানে মিছিল-সমাবেশে লালের উত্থান। তরুণদের হঠাৎ সৃষ্ট লাল তরঙ্গ নিশ্চয়ই নতুন কিছু বোঝাতে চাইছে। নতুন কিছু বলতে চাইছে। প্রশ্ন উঠেছে, সেটা কী?
কাণ্ডজ্ঞান বলে, লাল দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আইডি সাজানোর হিড়িকের সামাজিক বার্তা হলো শত শত তরুণ-যুবাকে হারিয়েও মানুষ শোকে ভেঙে পড়তে চাইছে না। অথচ অতীতের হিসাবে এই মানুষদের প্রোফাইলে এখন কালো রঙের রাজত্ব থাকার কথা। কিন্তু বন্ধু-সহযোদ্ধাকে হারিয়েও কালো আর শোকের নুয়ে পড়া ভঙ্গিতে বোধ হয় তারা আটকাতে চায় না আর। এ রকম মানুষের লক্ষ্য হয়তো উৎসব, নির্মাণ। তারা কালোর প্রতি অবাধ্যতা ঘোষণা করছে লাল হয়ে। এই মনোভাব হয়তো বন্ধ্যা সময় থেকে উজ্জ্বল ভোরে পৌঁছাতে ইচ্ছুক। লাল তাই তাদের কাছে স্বঘোষিত এক চ্যালেঞ্জ। সে জন্যই দেখা যাচ্ছে যে শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের হারাতে দেখছেন, তাঁরা ক্যাম্পাস থেকে রাজপথে নামছেন মুখে লাল কাপড় বেঁধে।
যে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের সহযোদ্ধা হারিয়ে বিষাদে ভারী হয়ে আছে, তারাও রাস্তায় হাঁটছে মাথায় লাল কাপড় বেঁধে। এ রকম অনেকেরই ফেসবুকে আইডির রং লাল। এই লাল অনেকটা ইশতেহারের মতো। যা একই সঙ্গে ব্যক্তিগত ও যৌথ। যাকে আবার সোশ্যাল মিডিয়ার গতানুগতিক সেন্সরশিপ আটকাতে পারছে না।
অতি নজরদারির কালে রং যখন প্রতিবাদের ভাষা
রং বরাবরই অতি শক্তিশালী এক প্রতীক। বিশেষ করে ইদানীং অতিরাষ্ট্রীয় নজরদারির শিকার সমাজগুলোয় রং হয়ে উঠেছে প্রতিবাদের শেষ অবলম্বন। ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলের দখলদারির মাঝে অনেক সময় কেবল তরমুজের লাল ভেতরটা দেখিয়ে মাতৃভূমিকে ফিরে পাওয়ার চির-আকাঙ্ক্ষার কথা বলে।
‘লাল’ এভাবে বিবিধ প্রতিরোধের প্রতীক হওয়া বহুকাল আগের ঘটনা নয়। ১৭৯৩-এর ফ্রান্স বিপ্লবে এবং ১৮৭১-এর প্যারি কমিউন থেকে মোটাদাগে এই চল শুরু। ফরাসি দেশে মূলত নিচু তলার পরিবর্তনবাদীরা লাল টুপিকে তাদের ‘চিহ্ন’ করে তুলেছিল। ফ্রান্সের ওই রং-সংস্কৃতি দ্রুত সংক্রমিত হয়েছিল ব্রিটেনের শ্রমিক আন্দোলনে।
বলশেভিক বিপ্লব এবং চীন বিপ্লবের পর রাশিয়া ও চীন লাল দিয়ে জাতীয় পতাকা তৈরি করে নেয়। ১৯৭৫–এ সেই ঢেউ ভিয়েতনাম পর্যন্ত পৌঁছায়। তত দিনে লাল মর্যাদায় অনেক উচ্চতায় চলে গেছে। আমেরিকার রাজনীতিতে আবার একচেটিয়া রিপাবলিকান পার্টির সমর্থক রাজ্যগুলোকে সেখানকার মিডিয়া ‘রেড স্টেট’ বলে। বোঝা যায়, হয়তো রাশিয়া-চীনের লালপ্রেম দেখে তারা এ রকম উল্টো পথ ধরেছে।
ডেমোক্র্যাট প্রভাবিত রাজ্যগুলোকে সেখানে বলা হয় ‘ব্লু স্টেট’। বলা বাহুল্য, লাল নিয়ে বিশ্ববাসী আমেরিকার সংস্কৃতি নেয়নি। বরং লাল বেঁচে আছে ফরাসি বিপ্লব, বলশেভিক বিপ্লব আর চীন বিপ্লবের সিলসিলা নিয়ে। অন্তত বাংলাদেশের চলতি হাওয়া সেটাই জানাল আবার। তবে একজন নারী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এটাও লিখেছেন, ‘আমি প্রোপাইল লাল করলাম ছেলেমেয়েদের প্রতি ভালোবাসা বোঝাতে।’
তবে এ রকম লালপ্রীতির দু–চারটা সমালোচনাও দেখা যাচ্ছে। সে রকম ভিন্নমত বলছে, লাল তো রক্তের রং। তাহলে কি নতুন এই লাল তরঙ্গ আরও সহিংসতা চাইছে? আসলে এ হলো বোঝার ভুল। লাল রক্তের রং হলেও রক্ত নিজে কিন্তু মৃত্যু নয়—আদিতে জীবনের প্রতীক ছিল।