লুটপাট, হামলা ও ভাঙচুর: আগে নিরাপত্তা পরে অন্য হিসাব
Share on:
বিজয়ের আনন্দে যখন সবাই মাতোয়ারা, ঠিক তখন থেকেই এ দেশে শুরু হয়ে গেছে লুটপাট, হামলা ও ভাঙচুর। ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা থেকে লুটপাট, অমুসলিমদের ওপর হামলা, ডাকাতি, ছিনতাই– সবই হচ্ছে। কারণ আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে।
অবস্থা এমন যে, রাজধানীসহ দেশের বেশির ভাগ থানায় এখন পুলিশের কোনো সদস্য অবস্থান করছেন না। জীবন বাঁচানোর তাগিদে অনেকেই অপেক্ষাকৃত নিরাপদ স্থানে চলে গেছেন।
আন্দোলন চলাকালে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় হামলা চালিয়ে ১৩ পুলিশ সদস্যকে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগের পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে মরদেহ ফুট ওভারব্রিজে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এমনকি সরকার পতনের পরও হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কাছ থেকে এক পুলিশ কর্মকর্তাকে ছিনিয়ে নিয়ে পিটিয়ে মেরে থানার সামনেই গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সূত্র অনুযায়ী সারাদেশে চারশর বেশি থানায় হামলা. ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট হয়েছে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা বহু থানায় আটকে পড়া পুলিশ সদস্যদের উদ্ধার করেছেন। শুধু তাই নয়; থানা থেকে লুট হওয়া জিনিসপত্র, অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশ সদস্যরা আতঙ্কিত; জীবন হারানোর ভয়ে ভীত। এমনকি দুই দিন ধরে অনেক জায়গায় সাধারণ মানুষ ট্রাফিক এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলার কাজ করছে। তবে গতরাতে পুলিশ স্টেশনের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এবং রাজধানী ঢাকার ট্রাফিকের দায়িত্ব আনসার ব্যাটালিয়নকে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দায়িত্বও তাদের দেওয়া হয়েছে। তবে ‘বাংলাদেশ পুলিশ অধস্তন কর্মচারী সংগঠন’ ইতোমধ্যে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, পুলিশ সদস্যদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তারা কর্মবিরতি পালন করবে।
এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়, বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর এমন দৃশ্য আর কখনও দেখা যায়নি। এর কারণ কী? দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এমন হলো কেন? বলাই বাহুল্য, জনগণের সঙ্গে পুলিশের এ ধরনের সম্পর্ক এক দিনে হয়নি। দীর্ঘদিন থেকেই পুলিশের ওপর খুব বেশি আস্থা নেই এ দেশের জনগণের। সেটার নানা ধরনের রাজনৈতিক-অর্থনীতি রয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে বিরোধী দল এবং শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক আন্দোলন যা-ই ঘটুক না কেন; সবকিছুকে দমানোর জন্য ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলগুলো তাদের সব সময় ব্যবহার করেছে। যার কারণে জনগণ-পুলিশ সাংঘর্ষিক অবস্থায় বেশির ভাগ সময়ই দাঁড়িয়ে। পাশাপাশি পুলিশের নানা হয়রানি, বলপ্রয়োগ এবং দুর্নীতিও বেশির ভাগ সময় আলোচিত ছিল। তবে এ আন্দোলনে পুলিশবিরোধী অবস্থান অনেকটাই তীব্র হয়েছে রংপুরে পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদের প্রাণ হারানোর পর থেকেই আমরা দেখেছি বিভিন্ন থানার ওপর আক্রোশ তৈরি হয় এবং অনেক থানা সেই আন্দোলনের সময় পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
এখানে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর সেনাপ্রধান যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেখানে বলেছিলেন– তিনি দায়িত্ব নিয়েছেন। কিন্তু আমরা দেখলাম অন্য চিত্র। নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। এ কারণে প্রথমে গণভবন, ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর বাড়ি, ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় ম্যুরাল ভাঙা হয়। সেদিন থেকেই দেশের প্রায় সব জেলাতে সংখ্যালঘুরাও আক্রান্ত হচ্ছেন, মন্দির ভাঙা হচ্ছে, দোকানপাট, ঘরবাড়ি লুটপাট হচ্ছে। অনেক জায়গায় অমুসলিমদের অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। তারা নানা ধরনের হুমকির মধ্যে আছে। ইতোমধ্যে অনেক সংখ্যালঘুর জমিও দখল হয়ে গেছে।
অনেকের মতো আমাদের কাছেও প্রচুর অমুসলিম শিক্ষার্থীর ফোন এসেছে। তাদের বাড়িতে হামলা হয়েছে ও হচ্ছে। কিন্তু কে নিরাপত্তা দেবে? কার দায়িত্ব এ দেশের মানুষের নিরাপত্তা দেওয়ার? কেউই তা জানে না। ওদিকে ৫ আগস্ট সেনা সদরে আলোচনার জন্য আমন্ত্রিত ১৮ জনের মধ্যে আটজনই ছিলেন জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলামসহ অন্যান্য ইসলামিক দলের সদস্য। এমন দৃশ্যই কি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলায় উৎসাহ দিয়েছে?
প্রশ্ন হচ্ছে, এখন কী করণীয়? কীভাবে সাধারণ মানুষের কাছে পুলিশ প্রশাসন আস্থাভাজন হয়ে উঠতে পারে, সে বিষয়েই প্রথম কাজ করতে হবে এবং অতি দ্রুত। পুলিশের নিরাপত্তা দ্রুত নিশ্চিত করে তাদের থানাগুলোতে পাঠাতে হবে। পুলিশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি নিশ্চয়তা দেওয়া না হলে এই বৈরিতার ক্ষত দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে। আর ২৪ ঘণ্টারও বেশি এই অবস্থা নতুন করে ভয় ও শঙ্কা যেমন তৈরি করছে, অন্যদিকে দেশকে নতুন করে গড়ে তোলার প্রত্যয়ের বিপরীতে হুমকি তৈরি করছে।
এ মুহূর্তে সেনাবাহিনীর প্রথম কাজ হলো, দেশের জনগণের নিরাপত্তার বিষয়টি আমলে নেওয়া। পুলিশের নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি তারা যেন জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে, সে বিষয়ে আস্থা তৈরি করা। যারা অভ্যুত্থান করে একটি ব্যবস্থার পতন ঘটাল, তাদের মধ্যে অনেক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষক ছিলেন; তারাও আক্রান্ত হয়েছেন। তাহলে তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে যখন একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখছি আমরা, তখন কেন দেশের জনগণ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে?
এ রকম অবস্থা বেশি দিন চললে বাংলাদেশ দেশ হিসেবে আর কখনও উঠে দাঁড়াতে পারবে না। থানাগুলোতে সত্যিকারের সেবকদের বসান। তাদের জনগণের বন্ধু হয়ে পাশে থাকবে কীভাবে, সেই প্রশিক্ষণ দিন। দুর্নীতির জায়গাগুলোকে একেবারেই মুছে ফেলতে বলুন। পাশাপাশি মানুষকেও জানান দিন– পুলিশ কোনো রাজনৈতিক দলের ভাড়া খাটবে না; তাদের মাস্তান হিসেবে কাজ করবে না। আপাতভাবে হয়তো কাজটা কঠিন মনে হচ্ছে, কিন্তু মনে রাখতে হবে– এ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই এবং এটি অচিরেই করতে হবে। এ মুহূর্তে দেশের জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতের বাইরে আর কোনো কিছু নিয়ে ভাবার অবকাশ কম।