মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: বুধবার ১৮, সেপ্টেম্বর ২০২৪

রাষ্ট্র সংস্কার ও মতপ্রকাশের সমান অধিকার চাই

Share on:

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি যুক্তিসংগত কারণেই জোরালো হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে ভাষণে নির্বাচন কমিশন, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন, জনপ্রশাসন ও সংবিধান সংস্কারের জন্য ছয়টি কমিশন গঠন এবং ছয় বিশিষ্ট ব্যক্তিকে সেগুলোর প্রধান ঘোষণা করেছেন।


সংস্কার প্রস্তাব প্রণয়নে ১ অক্টোবর থেকে তিন মাসের সময়ও বেঁধে দিয়েছেন। কমিশন প্রধানেরা অন্যান্য সদস্য নির্বাচন, অংশীজনের সঙ্গে আলোচনার পর পরিকল্পনা পেশ করবেন।

গত এক যুগে জনমত উপেক্ষা করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ন্যক্কারজনক একতরফা ও একদলীয় ভোটের মাধ্যমে কার্যত নির্বাচনের আগেই নিজেদের বিজয় নিশ্চিত করেছে। ২০১৪ সালে ১৫৪ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ২০১৮ সালে রাতের ভোট ও ২০২৪ সালে ডামি প্রার্থীর মাধ্যমে নির্বাচন ব্যবস্থাটিই হাস্যকর ও অর্থহীন করে তোলে। গণঅভ্যুত্থান-উত্তর জাতীয় নির্বাচনে সব মানুষের মতামত দেওয়ার সমান সুযোগ তৈরি তাই ন্যূনতম আকাঙ্ক্ষা। অবশ্য সেখানে সব রাজনৈতিক দল ও মতের অবাধ অংশগ্রহণের প্রত্যাশা যে নিষ্কণ্টক হবে, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে না।

সদ্য নিযুক্ত নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, ‘শেখ হাসিনার পর আওয়ামী লীগের অনেকেই পালিয়ে গেছেন। এখন নেতৃত্ব দেওয়ার মতো কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগ ছাড়া জাতীয় নির্বাচন হলে তা অগ্রহণযোগ্য হবে না।’ (সমকাল, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪)।

তিন মাস সময়সীমা নির্ধারণ করলেন প্রধান উপদেষ্টা, অংশীজনের সঙ্গে কথা বলার প্রতিশ্রুতিও দিলেন; আর কমিশনের দায়িত্বে এসেই বদিউল আলম মজুমদার জানিয়ে দিলেন, আওয়ামী লীগ ছাড়া নির্বাচন অগ্রহণযোগ্য হবে না! কমিশনপ্রধান যদি নিজের অবস্থান পূর্বাহ্ণেই স্পষ্ট করে দেন, তবে আর কমিশন তৈরির উপযোগিতা থাকে কি? অবশ্যই গণহত্যার দায়ে শেখ হাসিনা ও তাঁর সহযোগীদের অনেকেই অভিযুক্ত, উপযুক্ত প্রমাণসাপেক্ষে তাদের বিচার নিশ্চিত করা হবে– এ নিয়ে কারও আপত্তি থাকবার কথা নয়। অভিযুক্ত আসামি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না, এটাও আইনসম্মত; কিন্তু রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ? দেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী ঐতিহ্যবাহী, তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত রাজনৈতিক দলটিকে ছাড়াই নির্বাচন আয়োজনের ইশারা কেন? যুক্তি মিলতে পারে, রাজনৈতিক দল হিসেবেও আওয়ামী লীগ গণহত্যায় অভিযুক্ত। আসলেই? এটি কি আদালতে এরই মধ্যে প্রমাণিত? প্রমাণের আগেই নিকেশ করে দিতে হচ্ছে কেন?

আরও কথা আছে। রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ গণহত্যায় অভিযুক্ত হয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে না পারলে জামায়াতে ইসলামী কী করে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবার যোগ্যতা রাখে? আইন কী বলে? একাত্তরের গণহত্যা থেকে জামায়াতকে রেয়াত দেওয়া হয়ে গেছে? নাকি মুক্তিযুদ্ধকে যে এখন অনেক দূরের গল্প বলে কেউ কেউ বলবার চেষ্টা করছেন, তাকেই ধর্তব্য জ্ঞান করতে হবে!

অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান ড. ইউনূস জাতির উদ্দেশে তাঁর সর্বশেষ বক্তৃতায় মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মৃতি প্রসঙ্গে কোনো শব্দ উচ্চারণ করেননি। এটা ইচ্ছাকৃত নয় বলেই আমরা এখনও ভাবতে চাই; তবে অতি উৎসাহী কারও কারও কথা ও কাজে মুক্তিযুদ্ধকে উপেক্ষার ইঙ্গিত ঠিকই চোখে পড়ছে। জাতীয় প্রেস ক্লাবে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর জন্মবার্ষিকী ঘটা করে পালিত হলো; সামনে কি ইয়াহিয়া খান, আইয়ুব খানের জন্মবার্ষিকী পালিত হতে দেখব? সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো বক্তব্য অবশ্য আমরা এখনও শুনিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষালয়ে কাওয়ালি গানের আসর বসছে। কাওয়ালি আসর হতেই পারে। কিন্তু বাউল গানসহ দেশের ব্যান্ডগুলোর অংশগ্রহণে নানা প্রান্তে যে কনসার্ট; তা কেন বন্ধ হয়ে আছে? ঐতিহ্যবাহী যাত্রাপালা ইত্যাদির কোনো আয়োজন? না সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, না বিজয়ী ছাত্র নেতৃবৃন্দ– কারও উদ্যোগে এখনও দেশজ ঐতিহ্যের সংগীত বা আধুনিক ব্যান্ডের কনসার্ট অথবা যাত্রাপালার আয়োজনের কথা শোনা যায়নি। কেন?

২.

মুক্তিযুদ্ধকে দলীয় সম্পত্তি মনে করে আওয়ামী লীগ বারবার একক কৃতিত্ব দাবি করেছে। দলটির দুঃশাসন ও একনায়কতান্ত্রিক আচরণের বিরোধিতা করলেই তাদের বিএনপি-জামায়াত, এমনকি সরাসরি ‘রাজাকার’ আখ্যাও দেওয়া হয়েছে। ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বা সরকারসংশ্লিষ্ট ছাত্রনেতৃত্বকে সমালোচনা করলে তাঁকে স্বৈরাচারের দোসর হিসেবে চিহ্নিত করা শুরু হয়েছে কি? কোনো চিহ্নিতকরণ বা ট্যাগিং-ই অপশাসন বা দুঃশাসনের রক্ষাকবচ হতে পারে না। ভয়ের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে মুক্ত বাক্‌স্বাধীনতার চর্চা করবার জন্যই আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান। বিচ্ছিন্ন কয়েকটি ঘটনা অবশ্য ভয়ের সংস্কৃতিকে আবারও সামনে নিয়ে আসছে।

৫ আগস্টের পর দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক হামলা, এরপর নির্বিচারে মাজার ভাঙা। গণঅভ্যুত্থানের পর ভেঙে পড়া পুলিশ বাহিনীর অনুপস্থিতির সুযোগে এসব ঘটেছে–মানলাম; কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে অন্তত মাজার ভাঙার ব্যাপারে এখনও কোনো শক্ত প্রতিরোধ দেখা যায়নি। সারাদেশে বেশ কিছু মাজার এরই মধ্যে ভাঙা হয়েছে। শত শত বছরের এসব ঐতিহ্য ও পরম্পরা ভেঙে ফেলবার জন্য কেন আগ্রাসী আয়োজন? মাজারে গান-বাজনা নিষিদ্ধ ঘোষণার মতো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছেন কারা? সবই কি আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্র? তবে সরকার কী করছে? কেন তারা মাজার ভাঙার ব্যাপারে নিঃশব্দ; কেন মাজার ধ্বংসকারী দুর্বৃত্তদের দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে আটক ও শাস্তির ব্যবস্থা করছে না; আমরা জানি না।

আমরা এ-ও জানি না, গত সপ্তাহে কক্সবাজারে নারীর পোশাক নিয়ে আপত্তি ও হামলাকারীকে আটকের জন্য কেন সামাজিক মাধ্যমে সরকারের উপদেষ্টাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হলো? এক বা একাধিক উপদেষ্টার সরাসরি হস্তক্ষেপেই কেবল নারী অবমাননাকারীকে পুলিশে সোপর্দ করা হলো। হাসিনা সরকারের ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা থেকে আদৌ আমরা মুক্তি পাব না? নারী তাঁর পোশাকের জন্য নিগৃহীত হবেন সমুদ্রসৈকতে? রাস্তায়-বাসে-দোকানে কোথায় নারী নিরাপদ ও অশালীন মন্তব্য থেকে মুক্ত? নারীর পোশাকও বিশেষ রাজনৈতিক দল ও মতের লোকেরা ঠিক করে দেবে? কখন ও কোথায় নারী বসবেন বা কার সঙ্গে হেঁটে বেড়াবেন, এটাও পর্যবেক্ষণ করবে রাজনৈতিক দল? সাধারণ মানুষকে তার বিচার চাইতে হবে সামাজিক মাধ্যমে, উপদেষ্টা বরাবর!

রাষ্ট্রকে মানবিক ও সর্বসাধারণের জন্য সমান অধিকারের হয়ে উঠতে হবে। এই দেশ ১৫ বছর বা ২০ বছরে গড়ে ওঠেনি; এর রয়েছে সমৃদ্ধ পরম্পরা, সমৃদ্ধতর ঐতিহ্য। এর রয়েছে হাজার বছরের স্রোতস্বিনী ইতিহাস। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ–এগুলো কোনো দলের একক সম্পত্তি নয়; পটভূমি ও ইতিহাস বারবার ইচ্ছেমতো বদলও করা যায় না। ২০২৪-এর জুলাই গণহত্যা ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত গণঅভ্যুত্থানে মানবিক দেশ গঠনের যে আকাঙ্ক্ষা মানুষের সামনে উদ্ভাসিত, সেই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে ভয়ের সংস্কৃতি সর্বপ্রথম দূর করতে হবে। নির্বিবাদে নিজের কথা বলবার ও নিজের জীবন পরিচালনা করবার অধিকার প্রত্যেকের থাকবে– নারী, পুরুষ নির্বিশেষে; সকল মত ও পথের প্রত্যেক মানুষের। এ লক্ষ্যে উপযুক্ত বিধান ও ব্যবস্থা সরকারকে নিতে হবে। রাষ্ট্র কারও জন্য নিষেধের লাঠি হাতে দাঁড়াতে পারে না। পারবে না।

দৈনিক সমকাল