রাষ্ট্র সংস্কারের পাশাপাশি ‘মানবাধিকার রক্ষার’ সংস্কৃতিও সৃষ্টি হোক
Share on:
জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশ ‘মুক্ত হয়েছে’ বলা হলেও মানুষ এখনও ভয়মুক্ত নয়। মানবাধিকার লঙ্ঘন এখনও ঘটছে। সুদীর্ঘ ফ্যাসিস্ট রেজিমে সমাজের সর্বস্তরে মানবাধিকার সুরক্ষা ও সচেতনতার চরম ঘাটতি ছিল।
পরিবর্তনের স্বপ্নসমৃদ্ধ ছাত্র-জনতার অভিপ্রায় অনুসারে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের দিক থেকেও এ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরির পদক্ষেপ লক্ষণীয় নয়। অথচ বেশ কয়েকজন নেতৃস্থানীয় মানবাধিকার কর্মী অন্তর্বর্তী সরকারের শীর্ষস্তরে দায়িত্বপ্রাপ্ত। পরিবর্তনকামী নাগরিক প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটিয়ে তারা যদিও শুরু থেকেই মানুষের সব রকম স্বাধীনতার কথা বলছেন; সমাজে ক্ষমতাহীন শ্রেণির ওপর ক্ষমতাধর শ্রেণির আধিপত্যবাদী আচরণ এখনও অব্যাহত।
মানবাধিকার বিষয়কে অনেক সময়ই জটিলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। সহজভাবে বোঝার জন্য প্রধান পাঁচটি দিক উপলব্ধি করলেই চলে– মানবিক মর্যাদা, জীবনের অধিকার, স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও বৈষম্যহীনতা। মানবিক মর্যাদা বলতে ধর্ম-বর্ণ, আর্থিক অবস্থা, সামাজিক অবস্থান, রাজনৈতিক পরিচয়, জাতিগত পরিচয়, বিশ্বাসের ভিন্নতা নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিকের আত্মমর্যাদা। জীবনের অধিকার অর্থ খাদ্য-পুষ্টি-বস্ত্র-আবাস-শিক্ষা ইত্যাদি অধিকারসহ স্বাভাবিক মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বেঁচে থাকার অধিকার। স্বাধীনতা মানে মতপ্রকাশ, কথা বলা, নির্ভয়ে চলাফেরা, বিশ্বাস অনুসারে ধর্ম পালন বা পালন না-করা, পেশা বেছে নেওয়া, সমাবেশ করা, প্রতিবাদ করা, পছন্দমতো পোশাক পরা ইত্যাদি। স্বাধীন মানুষ অপরের অধিকার ক্ষুণ্ন না করে পছন্দমতো জীবন ও যাপনের প্রকাশ এবং বিকাশ করবে; ইচ্ছা হলে নীরব থাকবে। নিরাপত্তা মানে মানুষের মর্যাদা, স্বাধীনতা, জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা। লিঙ্গ, নৃতাত্ত্বিকতা, ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা, পেশা নির্বিশেষে বৈষম্যহীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার। ঘুষ, দুর্নীতি, অর্থ পাচার, কালো টাকা আয়ের সুযোগে স্বল্পসংখ্যক মানুষের হাতে রাষ্ট্রের সম্পদ পুঞ্জীভূত হবে না। শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থায় সবার সমান প্রবেশাধিকার থাকবে।
সাধারণভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা রাষ্ট্রপক্ষই সংঘটিত করে থাকে। রাষ্ট্রপক্ষ মানে সরকার, আইন, বিচার, পুলিশ, র্যাব, গোয়েন্দা পুলিশ, বিজিবি, সেনাবাহিনী, আমলাসহ সরকারের সব এজেন্সির প্রতিনিধি। বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ও তার অঙ্গ সংগঠনের কর্মীরাও সরকারের এজেন্সি হিসেবে কাজ করে। তাদের মাধ্যমে বা প্রভাবে ঘটিত মানুষের মর্যাদাহানি, জীবনহানি, গুম, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তাহানি এবং বৈষম্যের ঘটনাও মানবাধিকার লঙ্ঘন।
মনে রাখতে হবে, সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা, তা সে রাষ্ট্রপক্ষ বা অন্য কোনো দল, গোষ্ঠী বা ব্যক্তিই ঘটিয়ে থাকুক, এটি অবশ্যই মানবাধিকার লঙ্ঘন। কেননা, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ সংখ্যালঘু সুরক্ষায় আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতিতে স্বাক্ষর করেছে। শুধু ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোই সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী নয়। হিজড়া, ট্রান্সজেন্ডার, প্রতিবন্ধী, যৌনকর্মী, মাজারপন্থি, সুফি, কাদিয়ানি এবং বাংলাদেশে বসবাসকারী অন্যান্য জাতি, যেমন– সাঁওতাল, ওঁরাও, কড়া, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মান্দি, মণিপুরি– সবাই সংখ্যালঘু। বাংলাদেশে প্রায় সব সরকারের আমলেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের নজির রয়েছে।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর মানুষের উদ্বেলিত আনন্দ অবিস্মরণীয়। বেশির ভাগ নাগরিক উপলব্ধি করতে সক্ষম যে শুধু ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটেছে; কিন্তু ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থাকে আশ্রয় করেই অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। মুক্তিকামী ছাত্র-জনতা তাদের ওপর মূলত রাষ্ট্র ব্যবস্থা সংস্কারের সুকঠিন দায়িত্ব অর্পণ করেছে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুনরুদ্ধারে বিলম্বের সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণির দুর্বৃত্ত সমাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মচ্ছবে মেতে উঠেছে। তারা কেউ হিন্দুদের মন্দির, ঘরবাড়ি, দোকানপাট জ্বালাচ্ছে, সংখ্যালঘুর জমি দখল করছে। কেউ জ্বালিয়ে দিচ্ছে হিজড়াপল্লি; কেউ মাজার ভেঙে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে; কেউ যৌনকর্মীদের পেটাচ্ছে। কেউ শিক্ষকের অমর্যাদা করছে; কেউ নারীর পোশাক নিয়ে ফতোয়া দিয়ে চলেছে।
বেশির ভাগ অপরাধ হচ্ছে সংখ্যাগুরুর গায়ের জোর দেখিয়ে। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে এসব ঘটনা মোকাবিলা করা যে সহজ নয়, তা অনুমান করা যায়। কিন্তু এ ধরনের ঘটনার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান প্রকাশ করতেও বিলম্ব হচ্ছে। বিষয়গুলো নিয়ে নাগরিকদের হতাশা প্রকাশ করতে দেখা যাচ্ছে।
রাষ্ট্র সংস্কারের প্রয়োজনে মানুষ অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রয়োজনীয় সময় দিতে ও সহযোগিতা করতে রাজি। কিন্তু বিলম্বিত পদক্ষেপ, আইনশৃঙ্খলার অভাবে মানুষের নিরাপত্তাহীন, মর্যাদাহানিকর পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে তারা অধৈর্য হয়ে পড়বে নিঃসন্দেহে। তখন গণঅভ্যুত্থানও ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। হতে পারে, গণঅভ্যুত্থান ব্যর্থ করার হীন চক্রান্তের অংশ হিসেবেই একটি মহল এসব অপকর্ম করছে। যে ঐক্যের শক্তিতে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হলো, সেখানে ফাটল সৃষ্টি করতে চাইছে তারা।
অন্যদিকে সংস্কার প্রশ্নে বাংলাদেশের সংস্কৃতিগত সংস্কারের কথাও বেশ জোরেশোরে শোনা যাচ্ছে শুধু সরকারের পক্ষ থেকেই নয়, বিভিন্ন নাগরিক সংঘ থেকেও। মানবাধিকার সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাতে না পারলে কোনো সংস্কারই কাজে আসবে না। সুতরাং সংস্কার প্রক্রিয়ার প্রতিটি স্তরে মানবাধিকারের সংস্কৃতিকে ‘ক্রস কাটিং’ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া আবশ্যক।