মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: শনিবার ২৮, সেপ্টেম্বর ২০২৪

রাষ্ট্র বদলায়, ক্ষমতা বদলায় কিন্তু সমাজ বদলায় না!

Share on:

প্রভুর ইচ্ছা নানাভাবে কাজ করে– কখনও সরাসরি, অনেক সময় গোপনে। আধিপত্যের একটা সংস্কৃতিই গড়ে ওঠে। প্রভুভক্তদের পক্ষে তো অবশ্যই; এমনকি যারা বিদ্রোহ করে, তাদের অনেকের পক্ষেও বৃত্তটা ভেঙে বের হয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না, যদি না খুব বড় কিছু ঘটে কিংবা ঘটানো সম্ভব হয়।


আর পরিবর্তনের পরেও প্রায়ই টের পাওয়া যায়, প্রভু বদল হয়েছে বটে, প্রভুত্বের বদল হয়নি। গোলামিরই হোক, হোক আনুগত্যের কিংবা মেনে নেওয়ার– আধিপত্যের চিত্রটাকে আশাব্যঞ্জক বলা সহজ নয়। তবু সমষ্টিগতভাবে মানুষ কখনোই পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করে না, বদলাতে চায়, আশা রাখে এবং বদলাতে যে পারে না, এমনও নয়।

কিন্তু প্রভুটা কে? প্রভু কোনো ব্যক্তি নয়, প্রতিষ্ঠান নয়; প্রভু হচ্ছে একটি ব্যবস্থা, যা সুবিস্তৃত ও সুগভীর এবং একই সঙ্গে স্থানীয় ও বিশ্বজুড়ে ব্যাপ্ত। ব্যবস্থাটার নাম পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদ যেমন একটি অর্থনৈতিক বিধিব্যবস্থা, তেমনি আবার একটি আদর্শও বৈ কি। এই অর্থনৈতিক ও আদর্শিক আয়োজন দাসত্বের সৃষ্টি করে; কেবল দরিদ্রদের জন্য নয়, তাদের জন্যও যারা ধনী। ধনী-দরিদ্র সবাই বন্দি হয়ে থাকে মুনাফার লোভ ও ভোগবাদী লালসা, আত্মকেন্দ্রিকতা ও বিচ্ছিন্নতার হাতে।

বিশ্ব এখন পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের অধীন। এই বিশ্বব্যবস্থার আসল নিয়ন্ত্রক বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। এর অধীনে এমনকি বড় রাষ্ট্রও যে স্বাধীন নয় এবং আমাদের মতো দুর্বল রাষ্ট্রের পক্ষে যে স্বাধীন অবস্থান নেওয়া একেবারেই অসম্ভব, এই সত্য উপলব্ধি না-করবার কোনো কারণ নেই। আমাদের দেশে রাষ্ট্রের শাসক যারা তারা দলাদলি, কলহ, সংঘর্ষ সবই করে থাকে। কিন্তু তারা ঐক্যবদ্ধ এক ব্যাপারে, সেটা হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের তাঁবেদারিতে। ওই কাজে তারা মোটেই বিমুখ নয়, যদিও নিজেদের স্বার্থগত বিভেদের কারণে পারস্পরিক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত বটে। তাদের ক্ষমতায় থাকা-না থাকার ব্যাপারের অনেকটাই নির্ভর করে সাম্রাজ্যবাদের তুষ্টিসাধনের ওপর।

প্রভুত্বের অধীনস্থতা আমাদের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে যেমন তৎপর, তেমনি প্রভাবশালী আমাদের মনোজগতেও। এমনকি যারা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী তারাও দুর্বল হয়ে পড়েন; স্বীকৃতি ও পৃষ্ঠপোষকতার মোহ তো রয়েছেই, বিভ্রান্ত হন বিকৃত তথ্য ও তত্ত্বের পীড়নে এবং নিজেদের সামন্তবাদী পিছুটানে। কঠিন হয়ে পড়ে শিরদাঁড়া শক্ত রাখা এবং নিজের পায়ে দাঁড়ানো। মুক্তির সংগ্রাম চলে কিন্তু মুক্তি আসে না। রাষ্ট্র বদলায়, ক্ষমতা বদলায় কিন্তু সমাজ বদলায় না।

১৯৪৭-এ উদ্ভব ঘটেছিল দুটি রাষ্ট্রের– ভারত ও পাকিস্তানের; ১৯৭১-এ জন্ম আরেকটি নতুন রাষ্ট্রের– বাংলাদেশের। এই তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনজন রাষ্ট্রনায়ক খুব বড় ভূমিকা পালন করেন; তারা হলেন গান্ধী, জিন্নাহ ও শেখ মুজিব। তাদের পটভূমি, অবস্থান ও সময়ের ভেতর পার্থক্য ছিল, কিন্তু তিনজনের ভেতর ঐক্য ছিল এক জায়গায়– তারা সবাই পুঁজিবাদে আস্থাবান ছিলেন। তাদের ওই আস্থা রাষ্ট্র তিনটির চরিত্রের ভেতরেও প্রতিফলিত হয়েছে বৈ কি।

সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতার ক্ষেত্রে অনড় দু’জন ব্যক্তিত্ব– মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও লীলা নাগ। এই দু’জনের কেউই কিন্তু পুঁজিবাদী ছিলেন না। তাদের পক্ষপাত ছিল সমাজতন্ত্রের দিকে। কিন্তু পুরোপুরি সমাজতন্ত্রী হওয়া তাদের পক্ষেও সম্ভব হয়নি। দুর্লঙ্ঘ্য একটি পরিখা ছিল সামনে দাঁড়িয়ে, যেটি শ্রেণি ও সংস্কৃতির।

রাষ্ট্রের উত্থান ঘটেছে, পতনও ঘটেছে; মুক্তির জন্য মানুষ সংগ্রাম করেছে, কিন্তু মুক্তি আসেনি। মুক্তি কেন এলো না? না-আসার প্রধান কারণ সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদ-বিরোধিতাকে ধারাবাহিক ও ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। কাজটি করবার কথা ছিল বামপন্থিদেরই। তারা যে চেষ্টা করেননি, তা নয়। কিন্তু সফলতা আসেনি। ব্যর্থতার একটি কারণ হলো এই যে, নিজের পায়ে এবং মেরুদণ্ড শক্ত করে তারা দাঁড়াতে পারেননি; অন্য কারণ তাদের পক্ষে সাধারণ মানুষের কাছে সেভাবে যাওয়া সম্ভব হয়নি যেভাবে জাতীয়তাবাদীরা গেছেন। মূল প্রশ্নটি কিন্তু প্রভু নয়; প্রভুর প্রতি আনুগত্যও নয়। সেটি হলো আনুগত্য ছিন্ন করবার চেষ্টা। আধিপত্যবাদী ও কর্তৃত্বকামী প্রভুর নানা ইচ্ছা ওই চেষ্টাকে জরুরি করে তুলেছে। কেননা, এর সঙ্গে আমাদের সমষ্টিগত ভবিষ্যৎ অত্যন্ত নিবিড়ভাবে জড়িত বটে।

সাম্প্রতিক ভয়ের সংস্কৃতি ছিন্নে দুঃসাহসিক ঘটনা ঘটেছে। আসলে ঘটেছে কী? সেটার বিবেচনা খুবই জরুরি। কেউ বলছেন, আমরা দ্বিতীয়বার স্বাধীন হলাম। কারও কারও ধারণা আরও অগ্রসর। তারা বলছেন, দেশে একটা বিপ্লবই ঘটে গেছে। বাস্তবে কিন্তু দুটির কোনোটাই ঘটেনি। যেটা ঘটেছে তা হলো, নৃশংস একটি সরকারের পতন। এ দেশে মানুষ অনেক রকমের সরকার দেখেছে। ব্রিটিশ সরকার আলাদা, সেটা ছিল বিদেশি। পাকিস্তানি শাসকেরাও বিদেশিই ছিল। কিন্তু পতিত সরকারটির মতো স্বদেশি সরকার আগে কেউ কখনও দেখেনি। আমাদের দুর্ভাগ্য, কোনো সরকারই জনগণের পক্ষে ছিল না, সব সরকারই ছিল জনবিরোধী। শাসকেরা নানাভাবে শোষণ করেছে, যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। কিন্তু যে সরকারকে জনগণ এবার বিতাড়িত করল, সেই সরকারের মতো নিষ্ঠুর ও বধির আর দেখা যায়নি। এই সরকার কোনো আইনকানুন মানেনি, নিষ্পেষণের জন্য নতুন নতুন আইন ও বিধি জারি করেছে, গুম করেছে, হামলা ও মামলা দিয়ে হয়রানির একশেষ ঘটিয়েছে এবং কতটা যে নির্মম হতে পারে তার প্রমাণ দিয়েছে পতনের আগের কয়েকটি দিনে। ধারণা করা হচ্ছে, নিহতের সংখ্যা হাজারের কাছাকাছি। আর আহত মানুষের সংখ্যা তো বেশুমার। তালিকা পাওয়া গেছে নিহত ৬৫ জন শিশু-কিশোরের; তালিকার বাইরে কতজন শিশু শেষ হয়ে গেছে, কে জানে! নিহত ও আহতদেরও অধিকাংশই তরুণ।

সরকার পরিবর্তনটা শান্তিপূর্ণভাবেই ঘটতে পারত, যদি স্বাভাবিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হতো। কিন্তু সরকার তাতে সম্মত ছিল না। নির্বাচনের নামে একের পর এক প্রহসন ঘটিয়ে টিকে থাকার আয়োজন করেছে। ফলে পতন শেষ পর্যন্ত ঘটলই, তবে সহিংস উপায়ে। তাতে বহু মানুষ হতাহত হলেন; সম্পদ ও স্থাপনা নষ্ট হলো। পুলিশ আগেই জনবিচ্ছিন্ন ছিল। এবার তাদের যে ভূমিকায় নামানো হলো, তাতে তাদের ভাবমূর্তি দাঁড়াল জনশত্রুর। থানা আক্রান্ত হয়েছে, পুলিশ সদস্যরাও হতাহত হয়েছেন। পুলিশ বাহিনীর পক্ষে জনসমক্ষে হাজির হওয়া রীতিমতো বিপজ্জনক হয়ে পড়েছিল। স্বীকার করতে হবে, সমস্তটাই ঘটেছে ওই প্রভুর ইচ্ছায়। সেটা ক্রমশ দৃশ্যমান হচ্ছে বৈ কি।

দৈনিক সমকাল