রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কাঠামোর পুনর্গঠন নাকি সংস্কার, কোনটি জরুরি?
Share on:
ইদানীং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব, বন্ধুবান্ধব বা পারিবারিক আড্ডায় অথবা কারো সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতা—সবখানেই দু-তিনটা বিষয় নিয়ে খুব আলোচনা শুনছি। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ানোর দায়িত্বে আছি, অনেকে আবার আড্ডার মাঝে এ বিষয়গুলো নিয়ে আমার দিকে ইঙ্গিত করে প্রশ্ন করছেন।
রাজনীতি বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক কাঠামো ব্যবহার করে সাধারণের ভাষায় এ বিষয়গুলোর প্রায়োগিক বিশ্লেষণসহ উত্তর দেয়া কঠিনই। তবে অনেকের আলোচনা শুনলে প্রায়ই মনে হয়, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মতো এত জটিল একটি বিষয় যা মানুষের রাজনৈতিক আচরণ নিয়ে কাজ করে, এর বিভিন্ন ইস্যুর কী সাবলীল ব্যাখ্যাই না দিচ্ছেন সবাই, যারা অন্য ডিসিপ্লিনের ছাত্র হয়েও রাজনীতি বিজ্ঞানের বিভিন্ন ইস্যুর ব্যাখ্যার দায়িত্ব নিয়েছেন। এক্ষেত্রে নোয়াম চমস্কিসহ কোনো কোনো পণ্ডিত ব্যতিক্রম, যারা তাদের গবেষণা দ্বারা একাডেমিক বৈধতা এমনভাবে অর্জন করেছেন যে তারাও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পণ্ডিত। তবে অভিজ্ঞজনের মতামত অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। সমাজের সবাই রাজনৈতিক বিষয়ে মতামত দিতেই পারেন, তবে বিশ্লেষণ করা কঠিন।
বিভিন্ন আলোচনার টেবিলে নিয়মিতই যে প্রশ্নগুলো আসছে তার মধ্যে আছে-সরকার গঠন কেমন হলো, সরকার কতদিন থাকবে, এ সরকার কি সফল হবে, প্রতিবিপ্লব কি সম্ভব, জনসমাবেশ ডেকে বিএনপি কি ভুল করল ইত্যাদি। এ প্রশ্নগুলোর বৈজ্ঞানিক উত্তর দিতে হলে আন্দোলনের ফলাফল থেকে আলোচনা শুরু করতে হবে। স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা এ আন্দোলনকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ বলেছেন। তাহলে এটা কি বিপ্লব না গণ-অভ্যুত্থান? যদি বিপ্লব হয় এবং এ বিপ্লব রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে হতো, ধারাবাহিকতার জন্য তারা কার কাছে শপথ নিতেন? প্রথম মুক্তিযুদ্ধে সফলতার পর ধারাবাহিকতার জন্য পাকিস্তানের কারো কাছে শপথ নিতে হয়নি। প্রথম মুক্তিযুদ্ধে জনগণ বৈধতা দিয়েছে। দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধেও এ জনগণই বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে সরকার গঠনে বৈধতা দিয়েছে। এটা একটি আদর্শিক গণ-অভ্যুত্থান। কারণ এটা স্বৈরাচারী আদর্শ ও শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ও বিপ্লব। তাই এ অভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকার গঠনের বিষয় ও তার শপথ গ্রহণ স্বাভাবিক অবস্থায় ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৬/৭-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের মতোও নয়। তাছাড়া ১৯৯০ সালের এরশাদের পতন ২০২৪-এ শেখ হাসিনার পতনের চেয়ে আলাদা। ওটা বিক্ষুব্ধ জনতার গণ-অভ্যুত্থান ছিল, বিপ্লবী জনতার নয়। তাই দেখবেন ওই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের চরিত্রে ভিন্নতা ছিল সীমিত। প্রধানত রাজনৈতিক দল এবং তাদের সহযোগী ছাত্র সংগঠনসহ বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন ও তাদের সাধারণ সমর্থকগোষ্ঠী। কিন্তু ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের ব্যাপ্তি অনেক বেশি ছিল। এ আন্দোলন অরাজনৈতিক ছাত্র-জনতার হাত ধরে শুরু হয় এবং তাদের হাতেই সফল সমাপ্তি হয়। যদিও রাজনৈতিক দলগুলো এবং অন্যান্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীগুলোর সমর্থন ও অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপক। এজন্য এ গণ-অভ্যুত্থান অন্যান্য গণ-অভ্যুত্থান বিশেষ করে বাংলাদেশ আমলে ১৯৯০ সালের এবং পাকিস্তান আমলের ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের চেয়ে আলাদা। ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান ও বিপ্লবে জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণের সঙ্গে আগের গণ-অভ্যুত্থানগুলোর তুলনাই চলে না। তাই এ অভ্যুত্থান-পরবর্তী বৈধতার প্রশ্ন সাধারণ জনগণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। জনগণ প্রদত্ত বৈধতার ভিত্তিতে আপনি যেমনিভাবে সরকার গঠন করতে সমর্থ হয়েছেন, সেই একই বৈধতার ভিত্তিতে স্বৈরাচারের অংশ কারো কাছে শপথ না নিয়ে বিকল্প ব্যবস্থা করলেও ডকট্রিন অব নেসেসিটির ভিত্তিতে বৈধ হতো। এ ধরনের বিপ্লব-পরবর্তী বৈধতায় ধারাবাহিকতার প্রশ্নের সমাধান করা যেত পরবর্তী সংসদেও। এ গণ-অভ্যুত্থানের ভিন্নতার কারণেই গণভবনে প্রবেশ ঠেকানো হয়নি এবং প্রবেশকারীদের বিচারের প্রশ্ন কোনো কর্তৃপক্ষ থেকেও ওঠেনি। মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রে বৈধতার উৎস রাজনৈতিক ও আইনি উভয়ই। আইনি বৈধতার যে প্রক্রিয়ায় সরকার গঠন হয়েছে তাও সমর্থনযোগ্য। আর বিতর্কের প্রয়োজন নেই।
সরকার গঠনের বিষয়ে যদি আলোচনা করতে চাই তাহলে মোটা দাগে বললে একটি শক্তিশালী সরকার গঠন হয়েছে। প্রথমত, অধ্যাপক ইউনূসের যে অভিজ্ঞতা, নেতৃত্ব দানের ক্ষমতা, বৈশ্বিক যোগাযোগ এবং গ্রহণযোগ্যতা তা এক কথায় বাংলাদেশে খুব কম মানুষেরই আছে। উপদেষ্টাদের সংখ্যাও চমৎকার। একুশ। না বড়, না ছোট। তাদের মধ্যে আছেন অনেক অভিজ্ঞ লোক, যারা প্রধান প্রধান সংকট সমাধানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পোর্টফলিও পেয়েছেন। যেমন শিক্ষা, আইন, অর্থ, স্বরাষ্ট্র, শিল্প ইত্যাদি। তবে সরকারের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে দ্রুত আইন-শৃঙ্খলা ও আর্থিক ব্যবস্থাপনার উন্নতি, সরকারের ওপর রাজনীতিবিদের আস্থা ও তাদের সহযোগিতা এবং সরকারের দ্রুত নির্বাচনের ইচ্ছার ওপর। তাছাড়া অধ্যাপক ইউনূসের প্রতি বৈশ্বিক কমিউনিটি বিশেষ করে পশ্চিমাদের আর্থিক, নিরাপত্তাগত এবং রাজনৈতিক সহযোগিতাও এ সরকারের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির ক্ষেত্রে আমেরিকা ও ভারতের পারস্পরিক কৌশল এবং চীনের সঙ্গে এ সরকারের সম্পর্কও গুরুত্বপূর্ণ।
তবে বিপ্লবকে টেকসই করতে হলে রাষ্ট্র সংস্কারের আগে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কাঠামোর পুনর্গঠনের ওপর গুরুত্ব দেয়া জরুরি। পুনর্গঠন বলতে যে স্বৈরাচারী ক্ষমতা কাঠামো এখনো বিভিন্ন সরকারি, রাষ্ট্রীয় ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে বিদ্যমান আছে তার দ্রুত বিলোপ এবং পুনর্গঠিত রাষ্ট্রের ক্ষমতা কাঠামোতে যেন ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সম্পর্কের কারণে কেউ না চলে আসে সে ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। সচিবালয়, ব্যাংক, শেয়ার মার্কেট ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় ও নিরাপত্তা সংস্থায় ক্ষমতা কাঠামোর উৎসে দু-তিন স্তরে পরিবর্তন আনতে হবে। গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যে সব পরিবর্তন হয়ে যায়। এ পরিবর্তন রাতারাতি হয়। ১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর এবং ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের (যদিও এগুলো গণ-অভ্যুত্থান ছিল না) তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোর ক্ষেত্রে দেখা গেছে, রাতারাতি ক্ষমতা কাঠামো দু-তিন স্তরে পরিবর্তিত হয়েছে। এমনকি জেলা পর্যায়েও ক্ষমতা কাঠামো পরিবর্তিত হয়েছে। এ অভ্যুত্থান ও ছাত্র-জনতার বিপ্লবে খুব সীমিত পরিবর্তন লক্ষ করছি। এর জন্য খুব সতর্ক হওয়া প্রয়োজন এবং দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। অন্যথায় প্রতিবিপ্লবের সম্ভাবনা থাকে। এজন্যই এখন রাষ্ট্র সংস্কারের আগে রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা কাঠামো ও তার উৎসে ব্যাপক পরিবর্তন প্রয়োজন। মাত্র দুই সপ্তাহ আগে এ অভ্যুত্থান হয়েছে, ছাত্র-জনতা এখনো মাঠে আছে। আমি বিশ্বাস করি, অভ্যুত্থানকারীরা মিসরের মুরসির শাসনামলের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে বিশ্বস্ত লোকদের ক্ষমতা কাঠামোয় বসাবে এবং বিজয়ী হবে। ফ্যাসিবাদের দোসরদের চিহ্নিত করতে না পারলে এবং এ দোসরদের কথার মারপ্যাঁচে পড়ে আন্দোলনের সময় তাদের নীরবতা বা বিরোধিতা এবং আন্দোলনের আগে ফ্যাসিবাদের কাঠামো টিকিয়ে রাখার জন্য তাদের প্রত্যক্ষভাবে সুশীল সমাজের অংশ বা বুদ্ধিজীবী হিসেবে ভূমিকা রাখার কথা ভুলে গেলেও এ অভ্যুত্থান নস্যাৎ হতে পারে। তবে এক্ষেত্রে পরাজিতদের ওপর কোনো ধরনের নতুন সামাজিক ও রাজনৈতিক অন্যায়ের দায় যেন এ জাতিকে আর না নিতে হয় সে বিষয়েও সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে।
রাষ্ট্রের ক্ষমতা কাঠামো ও তার উৎস এবং রাষ্ট্র সংস্কার বা মেরামতের প্রধান লক্ষ্য গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের কাছে এমনভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর যাতে আর কোনো স্বৈরাচারী সরকার মানুষের স্বাধীনতা ও অধিকার খর্ব করতে না পারে। এর জন্য প্রাথমিকভাবে প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোকে স্বাভাবিকভাবে রাজনীতি করার অধিকার প্রদান। এক্ষেত্রে বিএনপিসহ যেসব রাজনৈতিক দল এরই মধ্যে রাজনৈতিক সভা করার সুযোগ পেয়েছে তা বর্তমান সরকারের স্বাধীনতার অঙ্গীকারের অংশ হিসেবেই। তাছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোও সরকারকে তাদের প্রয়োজনীয় সমর্থনের বিষয় এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণের পরিকল্পনা সরকারকে জানিয়ে দিচ্ছে। তারা বোঝানোর চেষ্টা করছেন রাষ্ট্র মেরামতের ধারাবাহিকতা রক্ষার দায় তাদের। এটাই বর্তমান সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক গোষ্ঠীর ভারসাম্য ও বোঝাপড়া। সেই বোঝাপড়ায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো অভ্যত্থানের মূল নিয়ামক ছাত্র-জনতাকে ভুলে যায়নি। রাজনৈতিক দলের সমাবেশগুলোয় তারা ছাত্রদের নেতৃত্বের সাফল্য ও শহীদদের কথার আওয়াজ তুলছেন। গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দানকারী ছাত্রসমাজ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, রাজনৈতিক দলগুলোর বোঝাপড়া ছাড়া আসলে যে মহান রাজনৈতিক পরিবর্তনের অঙ্গীকার করা হয়েছে তার বাস্তবায়ন কঠিন। তাছাড়া ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে যে নতুন রাষ্ট্র নির্মাণের চেষ্টা চলছে তার ধারাবাহিক বাস্তবায়নের প্রধান এজেন্ট মাঠে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো। সমাবেশের মাধ্যমে তারা এর জানান দিচ্ছে। দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের সফলতা ও সংস্কারের মাধ্যমে যে নতুন রাষ্ট্র নির্মাণের কথা বলা হচ্ছে, তা গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর ও ক্ষমতায় আসা এবং বিরোধী দলে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর মিথস্ক্রিয়ায় নির্মিত নতুন রাজনৈতিক সমাজের ওপর নির্ভর করছে। তাই সব রাজনৈতিক দলেরই কর্মসূচির মধ্যে থাকা উচিত। বর্তমান সরকারেরও উচিত তাদের সেই পরিবেশ তৈরি করে দেয়া। স্বাধীনতা রক্ষা করতে হলে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে কার্যকর রাজনৈতিক দলই শেষ আশ্রয়, অন্যথায় স্বাধীনতা আরো সংকটে পড়ে। সরকারের সংস্কারের লক্ষ্য থাকবে কার্যকর রাজনৈতিক দল নির্মাণ, অবিতর্কিত নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা এবং সর্বোপরি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও জনগণের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা।