মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: শুক্রবার ৯, অগাস্ট ২০২৪

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় ‘বিপ্লব’ অর্থ ‘মানবিকতার মুক্তি’

Share on:

‘বিপ্লব’ শব্দটির সরল অর্থ হলো সম্পূর্ণ ঘুরে যাওয়া; একটি চাকা ঘোরে যেমন। ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে ঘটে যাওয়া ব্যাপক পরিবর্তনকে বিপ্লব আখ্যা দেয়া হয়। বলা হয়, ব্রিটেনের ইতিহাসে এটি ছিল এক গৌরবময় মহিমান্বিত বিপ্লব। সময়ান্তরে বিপ্লব শব্দটির বিবর্তন ঘটেছে।


সেকালে রাজার পরিবর্তন ‘বিপ্লব’ হয়ে যেত। এখন বলা হয় ‘যুগপৎ’ সামাজিক ও রাজনৈতিক পর্যায়ে, পূর্বতন সমাজ ব্যবস্থার দৃঢ়মূল আশা ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত নানা অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠানের আমূল রূপান্তর। সময় বিশেষে এ পরিবর্তনে ধ্বংসাত্মক ও হিংসাত্মক কার্যকলাপকে বৈধ মনে করা হয়। কোনো কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে বিপ্লবের অর্থ হলো ‘মানবিকতার মুক্তি’। সংবিধানের নাগরিক অনুকূল প্রণয়ন, পরিবর্তন ও পরিমার্জন এ বিপ্লবের অনিবার্য পরিণতি। ইতিহাসে অনেক বিপ্লব সামগ্রিক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। যেমন ১৭৭৬ সালের মার্কিন বিপ্লব, ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব, ১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লব। ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামী সমাজ পরিবর্তন ও বিপ্লব ‘অভিধা’ অর্জন করে।

মনীষী কার্ল মার্ক্স বিপ্লব শব্দটিও বিপ্লব প্রক্রিয়াটির প্রবল প্রবক্তা। তিনি অবশ্য বিপ্লবকে শ্রেণী সংগ্রামের পরিণতি বলে মনে করেন। বিপ্লবের ফলে শাসকের স্থান কিনে নেয় শাসিতরা। মার্ক্সবাদের প্রায়োগিক প্রবক্তা লেনিন বস্তুগত পরিবর্তনের চেয়ে মনোগত পরিবর্তনের ওপর জোর দিয়েছেন। লেনিনের দৃষ্টিতে সংহত ও পুঞ্জীভূত ক্ষমতার মাধ্যমে বিপ্লব সাধন সম্ভব। মানবেন্দ্রনাথ রায় বলেন, ‘মানুষের সহজাত সম্ভাবনার বিকাশে বাধাস্বরূপ যেকোনো প্রতিবন্ধকতা নির্মূল করাই বিপ্লবের আদর্শ। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা সময় বিশেষে মানুষের দৈহিক অস্তিত্ব ও মানসিক বিকাশ ও সৃষ্টিশীল সত্তার প্রতিকূলতা হয়ে দাঁড়ায়। প্রগতি ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষা মানুষকে বিপ্লবের সাহায্যে ওইসব অন্তরায়গুলোকে অপসারণের প্রেরণা জোগায়।’

যেকোনো বিচারে বাংলাদেশের পটপরিবর্তন ছিল নিঃসন্দেহে একটি বিপ্লব। সাধারণত একটি দীর্ঘমেয়াদি অন্যায়, অত্যাচার ও অপশাসন অবশেষে জনগণের তীব্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়। ২০০৮ সালের ১/১১-এর অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাবলির অবশেষে যে নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়, দৃশ্যত তা ছিল অবাধ ও নিরপেক্ষ। পর্দার অন্তরালে আসলেই এটি ছিল পরিকল্পিত ও সেনা সরকারের উদ্দেশ্য পূরণের বাহন। লন্ডনের দি ইকোনমিস্ট পত্রিকার ভাষ্য অনুযায়ী, এটি ছিল বস্তা বস্তা ভারতীয় টাকা এবং তাদের রণকৌশলের ফলাফল। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ইয়াহিয়া আখতারের গবেষণায় এটি ছিল ‘ব্যতিক্রমী’ নির্বাচন। এর ফলে একটি অভিনব সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। আর একজন গবেষক মাহমুদুর রহমান তত্ত্ব ও তথ্য দিয়ে প্রমাণ করেন এর অন্তর্নিহিত রহস্য। প্রতিষ্ঠিত সরকার দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশকে জনগণের সম্মতি ব্যতীতই শাসন করেন। জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা এ সরকার বাতিল করে।

তারা অনুধাবন করে, কখনই কোনো কালে জনগণের ভোটের মাধ্যমে তারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারবে না। ২০০৯-২৪ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত তিনটি নির্বাচনই ছিল কারসাজির। ২০১৪ সালে ভোটারবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৮ সালে নিশীথ রাতের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০২৪ সালের নির্বাচনটি ছিল তাদেরই ভাষায় ‘ডামি’। এর ফলে জনগণের ক্ষোভ ও ক্রোধের প্রকাশ ঘটে। নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়। বিরোধী দলগুলো নির্মূলের লক্ষ্যে হত্যা, গুম, হামলা ও মামলার পথ বেছে নেয়া হয়। মানুষের স্বাধীনতা শূন্যের কোটায় নিপতিত হয়। দুর্নীতি গোটা জাতিকে গ্রাস করে।

বাংলাদেশের যাবতীয় সম্পদকে পৈতৃক মনে করে ক্ষমতাসীন দল বেপরোয়া লুটপাটে লিপ্ত হয়। ব্যাংকগুলো ফতুর হয়ে যায়। লাখো কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যায়। দেশের বৈদেশিক রিজার্ভ আতঙ্কজনক অবস্থায় উপনীত হয়। আমদানি-রফতানি সংকটাপন্ন অবস্থায় পৌঁছে। দ্রব্যমূল্য এত বৃদ্ধি পায় যে, মানুষের সহ্যের সীমা অতিক্রম করে। দেশের আইন-শৃঙ্খলার মারাত্মক অবনতি ঘটে। পুলিশ বাহিনী নিপীড়নের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়। আমলাতন্ত্র দলতন্ত্রে পরিণত হয়। দেশের বুদ্ধিজীবীরা নগ্নভাবে বুদ্ধি বিক্রির প্রতিযোগিতায় নামে। শিক্ষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী—সর্বত্র সুবিধাবাদ ও নিকৃষ্ট ক্ষমতামোহ পরিলক্ষিত হয়। দেশের শিক্ষাঙ্গন সন্ত্রাসের চারণভূমিতে পরিণত হয়। শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে প্রতিবেশী আধিপত্যবাদের সুকৌশল নিয়ন্ত্রণ লক্ষ করা যায়।

দেশের সামগ্রিক শোচনীয় অবস্থায় নাগরিক সাধারণ বিশেষত ছাত্র-যুবসমাজ ক্ষোভ দুঃখ ও ক্রোধ লালন করছিল। এ ধরনের অবস্থা আগ্নেয়গিরির মতো। যেকোনো সময় বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। গত ১৬ বছরে একটু-আধটু বিস্ফোরণ যে ঘটেনি তা নয়। জনগণের আড়িয়ল বিল আন্দোলন, ধর্মীয় আবেগে আঘাত হানার প্রতিবাদ, স্থানীয়ভাবে জাতীয় ইস্যুর প্রতিবাদ, শিক্ষা বিষয়ে বিজাতীয় প্রভাব প্রতিরোধ এমন হাজারো আন্দোলন হয়েছে। এছাড়া রাজনৈতিক দলগুলো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় নিরন্তর আন্দোলন করেছে। সরকার রাজনৈতিকভাবে এসব ইস্যু ও আন্দোলন মোকাবেলা না করে নির্মম শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে তার মোকাবেলা করেছে। দেশের ছাত্রসমাজও তাদের শিক্ষা সমস্যার বাইরে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন ও কোটাবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছে।

২০১৮ সালে শিক্ষার্থীরা এক বড় ধরনের কোটাবিরোধী আন্দোলনে নামে। সরকার প্রথমে তাদের দাবি অগ্রাহ্য করলেও শেষ পর্যন্ত আন্দোলনের তীব্রতায় তা মেনে নেয়। এ কোটাবিরোধী আন্দোলনটা ছিল ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ অন্যান্য মোট ৫৬ শতাংশ কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। চাকরির ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থা সাধারণ ছাত্রদের মেধা উন্নয়নের বিপরীতে ছিল। ভালো ফল করেও মেধাবী ছাত্ররা যথাযথ চাকরি পাচ্ছিল না। ছাত্ররা কোটা ব্যবস্থার সংস্কার চাচ্ছিল, বিলোপ নয়। কিন্তু দেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী শেখ হাসিনা গোসসা করে সব কোটা বাতিল করে দেন। আসলে ক্ষমতাসীন সরকারের ক্ষমতার হাতিয়ার ছাত্রলীগ কোটা ব্যবস্থা বিলোপের বিপক্ষে যায়। কোটা ব্যবস্থা তথা মুক্তিযোদ্ধা কোটার নামে ক্ষমতাসীন দল পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) তথা চাকরিদাতা কর্তৃপক্ষের কাছে তালিকা পাঠাত। মুক্তিযোদ্ধার নামে সেসব চাকরি পেত আওয়ামী লীগের পোষা গুণ্ডা বাহিনী।

২০১৮ সালের কোটা ব্যবস্থা বিলোপের পর শাসক দলের ঘরোয়া সিদ্ধান্ত মোতাবেক কোটা ব্যবস্থার পুনর্বহাল চেয়ে মুক্তিযোদ্ধা সন্তানরা হাইকোর্টে মামলা করেন। সব জানা কথা, নিম্ন আদালত থেকে সর্বোচ্চ আদালত—সব ছিল তাদের দখলে। ভয়ে মুখ খুলত না কেউ। এভাবে সত্য মিথ্যা হয়ে যেত আর মিথ্যা সত্যে পরিণত হতো। তাই কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহালের রায় দেন হাইকোর্ট। সন্তুষ্ট হয় শাসকগোষ্ঠী আর অসন্তুষ্ট হয় শিক্ষার্থীগোষ্ঠী। সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়।

২০১৮ সালের আন্দোলনের অনুসরণে ছাত্ররা হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ জানায়। সংগত কারণে তারা সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। প্রথম দিকে স্বয়ং শেখ হাসিনা অনমনীয় মনোভাব প্রকাশ করেন। লক্ষণীয় যে আওয়ামী লীগ সরকার কখনো কোনো আবেদন-নিবেদনে সাড়া দেয়নি। আন্দোলন, বিক্ষোভ ও ভাংচুর না হওয়া পর্যন্ত তাদের কানে পানি যায় না। এবারের কোটা আন্দোলনের ঘটনাক্রম লক্ষ করলে বোঝা যাবে, তারা এক্ষেত্রে দ্বিচারিতার নীতি অবলম্বন করে। মিথ্যাচারের মাধ্যমে বিভ্রান্ত করার ও পাশবিকতা তথা রক্তক্ষরণের মাধ্যমে কোটা আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। সবাই এখন বলছেন, স্বাভাবিক আন্দোলনটিকে অস্বাভাবিকতার দিকে ঠেলে দিয়ে তারা তাদের পতন অনিবার্য করে তোলে।

ইতিহাসে আমরা রক্তপাতকারী নির্মম শাসকদের নাম শুনেছি। চেঙ্গিস খান, হালাকু খান, আল মানছুর, হাজ্জাজ বিন ইউসুফ, হিটলার, মুসোলিনি ও ১৯৭১ সালে ইয়াহিয়া খান। তাদের সবাই ছিলেন রক্তপাতকারী। শেখ হাসিনা গত এক মাসে যে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন তাতে ওইসব নির্মম দুরাচারদের সঙ্গে তার নামও কালো অধ্যায়ে বর্ণিত হবে ইতিহাসের পাতায়।

সেই রক্তনদী পেরিয়ে বাংলাদেশ এখন একটি নতুন ইতিহাস সৃষ্টির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ছাত্র-জনতার বিজয় অর্জিত হয়েছে। পতন হয়েছে শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের। এরই মধ্যে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে দেশের পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিপ্লবের সফল প্রতিফল হিসেবে ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসেবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হয়। আন্দোলনের দৃশ্যত মুখপাত্র আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে এ সরকার গঠন করতে যাচ্ছি। এ সময়ে এটাকে বিভিন্নভাবে সাংবিধানিক বৈধতা দেয়ার সুযোগ আছে। যে নিয়ম আছে, সেটা অনুসরণ করা হবে। সরকারের মেয়াদ এখনো ঠিক হয়নি। ‘একটি সফল বিপ্লবের পর একেবারে যথার্থভাবে সাংবিধানিক ধারা অনুসরণ করা সম্ভব নয়। একটু আগেই আমরা তা বলেছি। এ সরকার যেহেতু অস্থায়ী সেহেতু বড় ধরনের নীতিগত পরিবর্তন হয়তো সম্ভব নয়। তবে সারা দেশে রাষ্ট্র সংস্কারের যে আবেদন স্পষ্ট হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের হয়তো সূচনা পর্ব সম্পন্ন করতে হতে পারে। এ মুহূর্তে এখানে দুটো মতামত প্রকাশ হচ্ছে। শিক্ষার্থী ও বুদ্ধিজীবীরা চাচ্ছেন, এ সরকারের মেয়াদ দীর্ঘতর হোক, যাতে প্রফেসর ইউনূসের মতো গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব শাসন ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন করতে পারেন। অন্যদিকে রাজনীতিকরা মনে করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার আদলে এর মেয়াদ হবে তিন মাস। নির্বাচনটি নিরপেক্ষভাবে নিষ্পন্ন করাই হবে তাদের দায়িত্ব। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান অনুষ্ঠিত জনসভায় বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছেন। তবে সরকারের ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে রাজনৈতিক ঐকমত্যে পৌঁছানো জরুরি। সেক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি জাতীয় সমঝোতা অর্জনের লক্ষ্যে গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করতে পারে।

বিপ্লব একটি প্রসব যন্ত্রণার মতো। একে ধারণ করতে অনেক বাধাবিপত্তি ও দুর্যোগ-দুর্ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশের এ গণবিপ্লবও এর থেকে ভিন্ন কিছু নয়। বিপ্লব তথা গণজাগরণের ক্রোধ এরই মধ্যে আমাদের অনেক সম্পদ ও স্থাপনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। গণভবনে ও জাতীয় সংসদে যে অবাধ লুটপাট হয়েছে তা লজ্জার। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ হয়ে দেখা দিয়েছে সংঘাত ও সন্ত্রাস। বিপ্লব পরবর্তী সময়ের সুযোগ গ্রহণ করে দুষ্কৃতকারীরা। এরা নানা স্থানে নানাভাবে হামলা করেছে। বিপ্লব-পরবর্তী মৃত্যু কারো কাম্য ছিল না। অথচ সংঘাতের ঘটনায় এরই মধ্যে শতাধিক মৃত্যু ঘটেছে। বিরোধী রাজনৈতিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান আক্রান্ত হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের বাড়ি ও উপসনালয়ে হামলা হয়েছে। সর্বত্র লুটপাট ও ডাকাতির খবর পাওয়া যাচ্ছে, যা কোনো অংশেই কাম্য নয়। যেহেতু বিএনপি দেশের সবচেয়ে বৃহত্তম দল, তাই এর নাম ব্যবহার করে কোথাও কোথাও দখল, চাঁদাবাজি ও আক্রমণের অভিযোগ এসেছে। বিএনপির শীর্ষনেতারা বার বার সতর্ক করে বিবৃতি ও বক্তব্য দিচ্ছেন। তারা এ ধরনের দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস সহিংসতা ও সম্পদ বিনষ্ট করা থেকে সবাইকে বিরত থাকার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। এক বার্তায় দেশবাসীর উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ‘আমি সবাইকে বর্তমান পরিস্থিতিতে শান্ত থাকতে এবং সব ধরনের সহিংসতা ও স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বিনষ্ট করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি’। সুতরাং এদের বিরুদ্ধে জনগণকে যেমন সতর্ক হতে হবে, তেমনই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কঠোরতর হতে হবে। পুলিশের তরফ থেকে যে অসহযোগিতার উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে, তা কাম্য ছিল না। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ পুলিশ যে দায়ী নয় তাও জনগণকে বুঝতে হবে। সচিবালয়ে ও বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে ভয় ও আতঙ্ক বিরাজ করছে। গত ১৫ বছরে চরম দলীয়করণের ফলে সবক্ষেত্রে কিছু অত্যুৎসাহীর সৃষ্টি হয়েছে। সবাই দায়ী নয়। সেজন্য সর্বত্র স্বাভাবিক অবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

এ সরকারের সামনে রয়েছে হিমালয়সম দায়দায়িত্ব। গত সাড়ে ১৫ বছরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দেশের প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যবহারিক পর্যায়ের যে সর্বনাশ করেছে তা তিন মাসে কেন, তিন বছরেও মেরামত সম্ভব নয়। রাজনৈতিক মহলে পরবর্তী সরকারের যে দায়িত্ব ও কর্তব্যের বয়ান প্রকাশ হচ্ছে, তা বিশ্লেষণে মহাকাব্য রচিত হবে। আশার কথা এই যে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি রাষ্ট্র সংস্কারের এক বিস্তারিত কর্মসূচি পেশ করে রেখেছে। সম্ভবত একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে তারা ক্ষমতায় আসবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেহেতু তিন মাসের সেহেতু এটি চেপে বসলে তাদের ঘাড় মটকে যাবে। অর্থাৎ যে দল ক্ষমতায় আসুক না কেন, তাদের জন্য থাকবে রাষ্ট্র ব্যবস্থা সংস্কারের এক বিস্তীর্ণ ময়দান। তবে কিছু নীতিগত বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তারা ভবিষ্যৎ সংস্কারের একটি সারমর্ম তৈরি করতে পারে। যেহেতু এরই মধ্যে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সুতরাং আমরা আশা করতে পারি যে, অতি শিগগিরই দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়। তাদের পথটি খুব জটিল। আমাদের দেশে রাজনীতিতে নীতি-নৈতিকতা ও সত্য-মিথ্যার বালাই নেই। রাজনীতিকরা প্রায়ই ষড়যন্ত্রের কথা বলেন। মুখে মুখে তারা বলেন, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়। আসলে বাস্তবে তারা করেন উল্টোটি। প্রায়ই দেখা যায়, ব্যক্তির জন্য দলের স্বার্থ বিসর্জিত হয় এবং দলের স্বার্থে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ পরিত্যক্ত হয়। এ কঠিন ও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সবাই দল ও মতের ঊর্ধ্বে উঠে দেশপ্রেমের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবেন—এ আশা নাগরিক সাধারণের। জ্ঞান দারিদ্র্যের এ দেশে আবারো জ্ঞান ও দেশপ্রেমের সমন্বয়ে জাতি সম্মুখসমরে বিজয়ী হবে এ আশা সবার। আসুন কবি নজরুলের ভাষায় প্রার্থনা করি, ‘চক্ষে জ্বলুক জ্ঞানের মশাল, বক্ষে দেশপ্রেম’।

দৈনিক বণিক বার্তা