মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: শনিবার ১০, অগাস্ট ২০২৪

‘রেল ট্রানজিট ইস্যু’ ভারতের ভূরাজনীতির ভয়ঙ্কর মায়াজাল!

Share on:

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিভীষিকা ও সফলতার নিচে চাপা পড়ে গেছে রেল ট্রানজিট ইস্যু। সত্যিকারার্থে স্বাধীনতার পর থেকেই ভারতের আধিপত্যবাদী চেহারা উন্মোচিত হয়।


গত জুন মাসে সর্বশেষ রেল ট্রানজিট চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতি তাদের আগ্রাসী বাণিজ্যিক, প্রাকৃতিক, নিরাপত্তা ও ভূরাজনৈতিক আধিপত্যবাদ বিস্তারের সর্বশেষ সংস্করণ ঘটল।

স্বাধীনতার পর থেকে ভারত আমাদের ওপর বিভিন্নভাবে আধিপত্যবাদ চাপিয়ে দিয়েছে। আমাদের দেশ স্বাধীনের বিষয়ে ভারতের অবশ্যই সবচেয়ে বড় ভূরাজনৈতিক স্বার্থ জড়িত ছিল। আমাদের স্বাধীনতার সাথে তাদের স্বার্থ মিলে গিয়েছিল বলেই তারা আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করতে এগিয়ে এসেছিল।

স্বাধীনতার কয়েক বছর পর ১৯৭৫ সালে ভারত ৪১ দিনের পরীক্ষার নামে চুক্তির মাধ্যমে পদ্মার উজানে গঙ্গা নদীতে ফারাক্কা বাঁধ চালু করে। কিন্তু চুক্তি ভঙ্গ করে তারা ১৯৯৬ সালে ফারাক্কা চুক্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত বাঁধ চালু রাখে। এই বাঁধের প্রভাবে আমাদের উত্তরাঞ্চলে মরুকরণ প্রক্রিয়া চলছে। এমনকি ১৯৯৬ সালে চুক্তির পরও আমরা আজ পর্যন্ত চুক্তি মোতাবেক পানি পাচ্ছি না।

২০১৮ সালে শেখ হাসিনা ভারতের সাথে ফেনী নদীর পানি যৌথভাবে ব্যবহারের চুক্তি করেছেন। কিন্তু এর অনেক আগে থেকেই তারা একতরফাভাবে উজান থেকে ফেনী নদীর পানি প্রত্যাহার করছে। এতে মিরসরাইয়ে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুহরী সেচ প্রকল্প হুমকির মুখে পড়েছে। তিস্তা নদীর উজানে গজলডোবা পয়েন্টে ভারত একতরফাভাবে ৮৫ শতাংশ পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। খাল কেটে তারা তিস্তার গতি পরিবর্তন করে বাংলাদেশের মানুষকে পানি বঞ্চিত করেছে। আবার বর্ষায় অতিরিক্ত পানি বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দিয়ে তিস্তা অববাহিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বন্যার সৃষ্টি করছে।

বাংলাদেশে ভারতের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ আদায়ের উদাহরণ বৈশি^ক প্রেক্ষাপটে বিরল। বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্কের উপাদান দু’টি। প্রথমটি হলো- চীনের আঞ্চলিক আধিপত্য মোকাবেলা এবং দ্বিতীয়টি হলো- বাংলাদেশে ইসলামীকরণের ভীতি। দুটোই মূলত ভারতের নিরাপত্তা শঙ্কা থেকে উৎসারিত। উত্তর-পূর্ব ভারতের নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশের মাটি প্রয়োজন ভারতের। আর বাংলাদেশে ইসলামীকরণ যত শক্তিশালী হবে ততই ভারতের কাশ্মির পরিস্থিতি এবং অভ্যন্তরীণ ডেমোগ্র্যাফি তাদের কল্পিত উদ্বেগের কারণ হয়ে পড়বে। অন্য দিকে উত্তর-পূর্বে বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া রাজ্যগুলোর বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগ্রামও তাদের উৎকণ্ঠার কারণ রয়েছে। যদিও ভারতেরই ইন্ধন ও সহযোগিতায় সুদীর্ঘ প্রায় ২০ বছর শান্তিবাহিনী চট্টগ্রামের পাহাড়ে বাংলাদেশীদের রক্ত ঝরিয়েছে।

চির প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের মোকাবেলা ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ইসলামী উপাদানগুলো ঠেকানোর নীতিমালা থেকেই ভারতের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা হলো বাংলাদেশকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা এবং তার ওপর দিয়ে অবাধ যাতায়াতের বন্দোবস্ত করা। কিন্তু দেশের জাতীয়তাবাদী ও ইসলামপন্থী শক্তির কাছ থেকে তা আদায় করা সম্ভব হয়নি। সীমান্তে কাঁটাতার দিয়ে বাংলাদেশকে ঘেরাও করে রাখলেও যাতায়াতের জন্য ভূমি ব্যবহার করার অনুমতি পায়নি। তাই গত ১৫ বছর ধরে ভারত বাংলাদেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখার বন্দোবস্ত করেছে। আর এই সময়ের মধ্যেই তারা বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহারের যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে নেয়ার চেষ্টা করেছে। ফেনী নদীর ওপর সেতু করে দ্রুততার সাথে বাংলাদেশে প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি করে রেখেছে। কিন্তু এই ফেনী সেতু বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। কোনো কারণে ভারতের সাথে আমাদের বৈরিতা সৃষ্টি হলে এই কৌশলগত সেতু ভারতকেই সুবিধা দেবে।

ট্রানজিটের কথাটি আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করার পর থেকেই আলোচনায় আসতে থাকে। তখন এটিকে এশিয়ান হাইওয়ে বা ট্রান্সএশিয়ান কানেকটিভিটি হিসেবে বলতে শোনা যায়। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর এ বিষয়ে তোড়জোড় শুরু হয়। আমাদের তিতাস নদীর ওপর বাঁধ দিয়ে ভারতীয় ভারী যন্ত্রাংশ নদীপথে এনে আশুগঞ্জ থেকে সড়কপথে ত্রিপুরায় পৌঁছানো হয়। এর পর থেকে নৌ, রেল ও সড়কপথে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে যাত্রী ও মালামাল পারাপারের ব্যবস্থা চালু হয়। ভারতের প্রতি সহানুভূতিশীল আমাদের বড় বড় অর্থনীতিবিদ আগে এই ট্রানজিটের আয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুর বানিয়ে ফেলার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে শেখ হাসিনার একজন উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ বললেন, ভারতের কাছে ট্রানজিটের মাশুল চাওয়া সভ্যতাবিবর্জিত কাজ!

এই ট্রানজিটের সর্বশেষ রূপান্তর হলো রেল করিডোর। পত্রপত্রিকার তথ্য মতে দেখা যায়, ভারতের রেলগাড়ি তাদের নিয়ন্ত্রণে থেকেই বাংলাদেশের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে প্রবেশ করে আবার ভারতের অপর অংশে চলে যাবে। এ দিকে ইতোমধ্যে মংলা বন্দরকে রেল যোগাযোগে সংযুক্ত করা হচ্ছে। আর মংলা বন্দর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ভারত পেতে যাচ্ছে।

গত জুন মাসে হাসিনা-মোদি শীর্ষ বৈঠকে ভারত তিস্তা প্রকল্প করে দেয়ার প্রস্তাব দেয় হাসিনা তাতে রাজি হয়ে আসেন। কিন্তু ভারতকে এই তিস্তা প্রকল্প দিলে তা আদৌ কোনো দিন সফলতার মুখ দেখবে কি না যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কারণ ভারতের সক্ষমতা, আন্তরিকতা এবং কথা দিয়ে কথা না রাখার স্বভাবজাত প্রেক্ষাপটই তার সাক্ষ্য দেয়। পর্যবেক্ষকদের মতে, ভারত তিস্তা প্রকল্প থেকে চীনকে দূরে রাখার জন্যই এই উদ্যোগ নিয়েছে।

বাংলাদেশের তিন দিকে ভারতীয় সীমান্ত থাকলেও দক্ষিণ দিকে বঙ্গোপসাগর থাকায় সেই দিকটায় ভারতের ফিজিক্যাল অনুপস্থিতি ছিল। সম্প্রতি সেই এলাকায়ও ভারতের অশরীরী উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়েছে। বিভিন্ন বিশ্লেষকের পর্যবেক্ষণ থেকে জানা যায়, আমাদের উপকূলীয় এলাকায় ভারত রাডার বসিয়ে তার মাধ্যমে পুরো বঙ্গোপসাগরে নজরদারি কায়েম করে রেখেছে।

ভারত ভূরাজনীতির মায়াজালে আমাদেরকে আবদ্ধ করে যেভাবে শতভাগ সুবিধা নিশ্চিত করে ফেলেছে :

ক. চীন ও ভারত পরস্পরের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী। মাঝে মধ্যেই সীমান্তে তাদের মধ্যে সংঘর্ষ হতে দেখা যায়। ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্য অরুনাচলের দাবি নিয়ে দুই দেশে প্রায়ই উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। ভারতের সবচেয়ে ভয় ছিল চীনের সাথে যুদ্ধ বাধলে চীন সহজেই শিলিগুড়ি চিকেন নেক আটকে দেবে এবং ভারতের সেভেন সিস্টার রাজ্যগুলো মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে রেল করিডোর এবং অন্যান্য ট্রানজিট ব্যবস্থাপনা যেকোনো পরিস্থিতিতে ভারতকে দুই ভাগে বিচ্ছন্ন হয়ে পড়ার আশঙ্কা দূর করবে। ফলে যেকোনো দুর্যোগে ভারত পূর্ব ও পশ্চিমের দুই অংশের অখণ্ডতা সহজেই রক্ষা করতে সক্ষম হবে।

খ. এই করিডোর ভারতের পশ্চিম থেকে পূর্বে এবং দক্ষিণ থেকে উত্তরে মালামাল এবং পণ্য পরিবহনে এক অভূতপূর্ব সুযোগ করে দেবে। দীর্ঘ প্রায় এক হাজার ৬০০ কিলোমিটার পথ এড়িয়ে তারা বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে মাত্র ৮০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়েই সব ধরনের পণ্য কলকাতা থেকে আগরতলা পরিবহন করতে সক্ষম হচ্ছে। আর রেল পথে এই দূরত্ব মাত্র ১০০ কিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে।

গ. চীনের সাথে সম্ভাব্য সংঘর্ষে ভারত খুব দ্রুত সেনা মোতায়েন থেকে শুরু করে লজিস্টিক সাপ্লাই করতে পারবে। সবচেয়ে সুবিধা হবে চীন-ভারত দ্বিপক্ষীয় যুদ্ধে ভারত সহজেই তৃতীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে জড়িয়ে ফেলতে পারবে তাদের বাফার স্পেস তৈরির উদ্দেশ্যে।

ঘ. বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতীয় যানগুলোর অবাধ যাতায়াতের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ভারত আমাদের দেশের যেকোনো অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতে হস্তক্ষেপের সুযোগ পাবে। আবার কখনো তারা আমাদের দেশে আনরেস্ট বা অশান্তি সৃষ্টি করতে চাইলে তাও করার সুযোগ থাকবে। তিন দিক থেকে ফিজিক্যালি ঘিরে রাখা, এক দিকে নজরদারি করা, দেশের বুক চিরে অবাধে যাতায়াত করার সুযোগ, উজানের নদীগুলোর পানি প্রত্যাহার ইত্যাদির বাস্তবতা আমাদেরকে প্রশ্ন করতে বাধ্য করে যে, আমাদের সার্বভৌমত্ব আমরা কতটুকু ধরে রাখতে পারব?

বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো সবসময় নিজেদের যুদ্ধ তৃতীয় কোনো দেশে করে থাকে। তদ্রুপ চীন-ভারত যুদ্ধ বাধলে সেই যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশ। ভারতের অস্ত্র-গোলাবারুদ যখন আমাদের দেশের ভেতর দিয়ে আনানেয়া হবে তখন চীনের বোমারু বিমানগুলো আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থাকেই লক্ষ্যবস্তু বানাতে পারে।

ভারতের যানবাহনের যাতায়াতের জন্য রেলপথ, রাস্তাঘাট, ব্রিজ ইত্যাদির রক্ষণাবেক্ষণের চাপ আমাদের ওপর পড়বে। তা ছাড়া আমাদের যোগাযোগব্যবস্থা দেশীয় যানবাহনের ট্রাফিকই সামলাতে পারছে না। বিদেশী যান চলাচল এই সমস্যা আরো প্রকট করে তুলবে।

আমাদের দেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় যানবাহনের নিরাপত্তার বিষয়টি অত্যন্ত নাজুক হবে। বাংলাদেশে জনগণের মধ্যে ভারতবিরোধী একটি অংশের উপস্থিতি রয়েছে। ফলে তাদের যানবাহনের নিরাপত্তা নিশ্চিতের অজুহাতে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী নিয়োজিত হতে পারে।

আমরা আঞ্চলিকভাবে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়তে পারি। এর নমুনা এরই মধ্যে আমরা আঁচ করতে পারছি। তিস্তা প্রকল্প নিয়ে শেখ হাসিনার ইউটার্ন চীন ভালোভাবে নিতে পারেনি। এতে হয়তো ভারত ও আমেরিকা মহাখুশি হবে! কিন্তু আমরা চীনের সাথে বৈরিতা সৃষ্টি করছি না তো? ভারতের সাথে সম্পর্কের ভারসাম্যের জন্য আমাদের চীনকে কাছে রাখতে হবে। আর আঞ্চলিকভাবে নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশই চীনের বলয়েই অবস্থান করছে বা ভারতের সাথে বৈরিতায় রয়েছে।

করিডোর দিয়ে ভারতীয় রেল চলাচলের সুবাদে চোরাকারবারিরা এ দেশকে মাদকদ্রব্য ও অবৈধ অস্ত্রের স্বর্গরাজ্য বানিয়ে ফেলার সুযোগ পাবে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হবে রেল করিডোর দিয়ে দিলে ভারতের সাথে আমাদের দরকষাকষির আর কিছু বাকি রইল কি?

আমাদের স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে ভারত। তার কোনো প্রতিদান বা কৃতজ্ঞতাবোধ কিছুই আমরা পাচ্ছি না। তাদের যে পরিমাণ সেনা জীবন দিয়েছিল স্বাধীনতা যুদ্ধে তার চেয়েও অনেকগুণ বেশি আমাদের নিরীহ সীমান্তবর্তী মানুষ বিএসএফ ইতোমধ্যেই হত্যা করে ফেলেছে। তারা জল-স্থল সবদিক থেকেই আমাদেরকে ঘিরে রেখেছে। সর্বশেষ ট্রানজিট বা করিডোর নিয়ে আমাদেরকে তারা ভূরাজনীতির মায়াজালে আবদ্ধ করে ফেলেছে। এর পরিণতি হয়তোবা আমাদের পরবর্তী জেনারেশনকে ভোগ করতে হতে পারে!

দৈনিক নয়াদিগন্ত