রেলের ‘ভাড়া কমিয়ে’ মুনাফা বাড়ানোর আলাপ!
Share on:
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আগে গত ৪ মে রেলপথের রেয়াত বাতিল করে শেখ হাসিনার সরকার। এর প্রতিবাদে রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির নেতৃত্বে সারা দেশে স্টেশনগুলোতে প্রতিবাদ সভা করেছি।
উত্তরবঙ্গের ঘটনা সম্পর্কিত আগের কলামগুলোতে এ নিয়ে লিখেছি।
বগুড়ার যাত্রীদের সড়কপথে ঢাকা গেলে ২০৪ কিলোমিটার আর রেলপথে বগুড়া থেকে সান্তাহার ৫০ কিলোমিটার, সান্তাহার থেকে নাটোর ৭০ কিলোমিটার আর নাটোর থেকে বাড়ির কাছে আরশিনগর সিরাজগঞ্জ একই দূরত্ব অতিক্রম করে যমুনা সেতুতে ওঠেন।
মানে রেলপথে ৪০০ কিলোমিটার লাগে। তাঁরা কেন রেলপথে ঢাকা যাবেন? যদি যানও, তাহলে বাড়তি ভাড়া কেন দেবেন? অথচ বগুড়া-সিরাজগঞ্জ ৩৫ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের দাবি ছোটকাল থেকে শুনে আসছি।
কুমিল্লা স্টেশন। আমরা শহরে লিফলেট বিতরণ করছি। লোকজনের আগ্রহ নেই। কারণ, সড়কপথে কুমিল্লা থেকে ঢাকাগামী এসি বাস নেয় ৩৫০ টাকা আর নন-এসি নেয় ২০০ টাকা।
অন্যদিকে রেলপথে দ্বিগুণ ভাড়া। কারণ, রেলপথে মুল্লুক ঘুরে আসতে হয়। নারায়ণগঞ্জ টু কুমিল্লা রেললাইন করলেও ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের দূরত্ব শ দুয়েক কিলোমিটার কমে।
ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয়, সড়কপথে শর্টকাট ও দ্রুতগতির যান থাকার পরেও যাত্রীরা ট্রেনকে বেছে নেওয়ার কারণ তুলনামূলক ভাড়া কম।
ভারতে ভাড়া কমিয়ে রেলের আয় বাড়ানোর উদাহরণ আছে। ভারতীয় রেলের বিশেষ দায়িত্ব পালনকারী পরিকল্পনাবিদ সুধীর কুমার এবং বিশ্বব্যাংকের সাবেক কর্তা ও কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ ফেলো শাগুন মেহরোত্রা ‘যেভাবে ঘুরে দাঁড়াল ভারতীয় রেল’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ট্রেন প্রতি আয় শুধু যাত্রীর কাছ থেকে পাওয়া ভাড়ার ওপর নির্ভর করে না, ভাড়া ছাড়াও যেসব বিষয়ের ওপর ট্রেন প্রতি আয় নির্ভর করে, তার মধ্যে রয়েছে যাত্রীবাহী কোচের সংখ্যা, কোচগুলোর কম্বিনেশন, যাত্রী ধারণক্ষমতা ও কোচের সিটের কত শতাংশ ব্যবহৃত হচ্ছে, তার ওপর।
অর্থাৎ একটি ট্রেনে কোন ধরনের কোচ কতটি থাকবে, সেটি বড় বিবেচনার বিষয়। যেমন: শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কোচের আসনবিন্যাস করে ৬৪ জনের জায়গায় ৮০টি করা।
এরপর আছে বগির সংখ্যা। আমদানি করা ইঞ্জিনগুলো ২৫টি বগি নিয়ে চলতে সক্ষম হলেও বাংলাদেশে চলে ১৫-২০টি। অথচ রেললাইন, গার্ড, চালক, প্ল্যাটফর্ম—সব একই থাকে। এভাবে বেসরকারীকরণ, ছাঁটাই ও ভাড়া বৃদ্ধির মতো পদক্ষেপ ছাড়াই ভারতীয় রেল লাভজনক হয়েছে।
রেয়াত পুনর্বহালের আন্দোলনে আমাকে আর্থিক সহযোগিতাও করেছিলেন আজকের আইন ও সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা জনাব আসিফ নজরুল।
সহযোগিতা করেছিলেন কবি ফরহাদ মজহারও। গণ-অভ্যুত্থানের পর প্রধান উপদেষ্টার পরামর্শে আমরা দাবি নিয়ে রাস্তায় নামিনি। উপদেষ্টা আসিফ নজরুল আমাকে ফোনে ধরিয়ে দিয়েছেন রেল উপদেষ্টার সঙ্গে। রেল উপদেষ্টা মহোদয় মন্ত্রণালয়ের সচিবকে সরাসরি নির্দেশও দিয়েছেন। কিন্তু এত দিনে না হলো রেয়াত পুনর্বহাল, না গেল চিলমারী কমিউটার পার্বতীপুর পর্যন্ত। সচিবরা কি কথা শুনছেন না?
২.
কুড়িগ্রাম/লালমনিরহাট/বুড়িমারী/পঞ্চগড়/নীলফামারী থেকে ছেড়ে আসা ট্রেনগুলোতে দু-তিনটি বগিতে বিশেষ ব্যবস্থায় কাঠের পাটাতন দিয়ে হলেও সাশ্রয়ী মূল্যে শ্রমজীবীদের জন্য (বিশেষত পোশাকশিল্পের শ্রমিক নারী বা পুরুষের জন্য আলাদা বগি) সুলভ বগির দাবি দীর্ঘদিনের। হাসিনা আমলে কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস চালু হলে রেল মন্ত্রণালয়ের এক কর্তার কাছে দাবি জানাই। তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ এখন মধ্য আয়ের দেশ, কেউ সস্তা বগিতে চড়বে না।’
আমরা তব্দা খেয়েছিলাম! মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত দেশের কথা থাক, একটা ন্যূনতম সভ্য রাষ্ট্রও যেকোনো প্রকল্পে প্রথমে বিবেচনা করে সবচেয়ে নিম্ন আয়ের মানুষের কথা। আর আমরা বিবেচনাতেই রাখি না।
৩.
কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস। চিলমারী বন্দর থেকে শুরু হওয়ার কথা ছিল। কথা ছিল রৌমারী-রাজীবপুর-গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ, উলিপুরের যাত্রীদের নিয়ে চিলমারীর রমনা স্টেশন থেকে যাত্রা করার।
কিন্তু দুর্ভাগ্য, কুড়িগ্রাম জেলাতে যাত্রাবিরতি শুধুই কুড়িগ্রাম স্টেশনে। আসন বরাদ্দ মাত্র ১২৫টি। আর রংপুরে দাঁড়ায় ৪টি স্টেশনে, তারপর পার্বতীপুর, সান্তাহার, নাটোর, চাটমোহর।
বাকি আসনগুলোও এসব স্টেশনের জন্য বরাদ্দ। ওদিকে ঢাকায় বিমানবন্দর স্টেশনে ও কমলাপুরে। কুড়িগ্রামের প্রায় সবাই শ্রমজীবী।
রংপুরের চারটির বদলে দুটি, নাটোর, চাটমোহর, সান্তাহার বাদ দিয়ে কুড়িগ্রামের রাজারহাট স্টেশনে এবং টঙ্গী ও জয়দেবপুরে যাত্রাবিরতি ও কুড়িগ্রামের জন্য আসন বৃদ্ধি করা জরুরি।
কুড়িগ্রামসহ উত্তরবঙ্গের শ্রমজীবীরা মূলত টঙ্গী ও জয়দেবপুরে কাজ করেন। কোন এলাকার লোক কোন কোন স্টেশন ব্যবহার করেন, এটা জানাটা জরুরি।
৪.
রাজধানীর কথা বলতে গিয়ে লোকাল ট্রেনের কথা ভুলেই গেছি। গরিবের কথা সবাই ভুলে যায়। কুড়িগ্রামবাসীর পণ্য আনা-নেওয়ার খরচ বাড়ে। কৃষকের পণ্যের দাম মেলে না। ব্রহ্মপুত্র-ধরলা-তিস্তার নদীভাঙা মানুষেরা পঞ্চগড়, দিনাজপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাটে গিয়ে বসত গড়েছে। এর পেছনে ছিল লোকাল ট্রেনগুলো।
কুড়িগ্রাম জেলায় কোনো লোকাল ট্রেন নেই। সবচেয়ে গরিব জেলাগুলোতে লোকাল ট্রেন নেই। কুড়িগ্রামেও নেই।
অথচ আগে মানে ৩০ বছর আগে চারটি লোকাল ট্রেন আটবার চলত। ভোর ৪টায়, সকাল ১০টায়, বেলা ১টায় ও রাত ১০টায় ট্রেনগুলো চিলমারীর রমনা স্টেশন থেকে ছেড়ে যেত। ফিরতও ওভাবেই।
এখন সকাল আটটায় একটিমাত্র ট্রেন ‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই’ ভর্তি হয়ে ছেড়ে যায় রংপুরের উদ্দেশে আর ফাঁকা গাড়ি ফেরে রাত একটায়।
সবাই নাকি উন্নয়নের গাড়িতে চড়ে আর কুড়িগ্রামবাসী গরিব থেকে গরিবতর হয়। আপনারা যাঁরা জানতে চান, কুড়িগ্রাম কেন দিন দিন গরিব হয়, তার কারণ এই বৈষম্যের রাজনীতি। যেটা ঢাকা শহরের সচিবালয়ে বসে আপনারা যা চান আর কি।