রণকৌশলে সফল হলেও দূরদর্শীতায় ইসরায়েল ব্যর্থ!
Share on:
পর্যবেক্ষকরা প্রায়ই ইসরায়েলি অভিযানগুলোর প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও সাফল্যে বিস্মিত হয়ে পড়েন, যদিও এই দীর্ঘ খেলাটি আসলে কী এবং তাতে কী অর্জিত হয়েছে, তা নিয়ে এখনও তারা হতবাক।
লেবাননে হাজার হাজার পেজার ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক ডিভাইস বিস্ফোরণের জন্য গত সপ্তাহের অভিযানটি ছিল উল্লেখযোগ্য। বিশেষত যেহেতু তা ছিল ভয়ংকর ও রক্তাক্ত।
সন্দেহ নেই, মোসাদ কর্তারা এতে খুশি হবেন। কারণ এতে স্বল্প মেয়াদে হিজবুল্লাহকে সংযত করা যাবে; তাদের যোগাযোগ মাধ্যমগুলো উন্মোচিত হবে এবং এতে অনুপ্রবেশের সুযোগ মিলবে। তাদের সক্ষমতা এখন কমে যাবে। সশস্ত্র দলটি বর্তমানে অরক্ষিত এবং তাদের আত্মবিশ্বাসে ধাক্কা লেগেছে।
ইসরায়েলিরা প্রায়ই নিজেদের সরকারের প্রোপাগান্ডা খুব সহজে বিশ্বাস করে। ইসরায়েলি মুখপাত্ররা দাবি করতে পারেন, আগেই সবক’টি হামলার লক্ষ্যবস্তু ঠিক করে পেজার আক্রমণ চালানো হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সর্বস্তরের লেবাননবাসী একে গণহত্যার উদ্দেশ্যে চালানো হামলা হিসেবেই দেখে। আক্রমণটি সার্জিক্যাল তথা আকস্মিক কিছু ছিল না, যা পুরো জনগোষ্ঠীকে আতঙ্কিত করেছিল। লোকজন এখন তাদের নিজস্ব ডিভাইস নিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত এবং তারপর কী হবে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। ইসরায়েলিরা হয়তো সরকারি বয়ানে বিশ্বাস করতে পারে– গাজা ধ্বংসযজ্ঞ সম্পূর্ণরূপে ন্যায্য। কিন্তু যারা এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তারা সত্যটি জানে। অসংখ্য গাজাবাসী এমন ঘৃণায় আচ্ছন্ন হবে, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ছড়িয়ে পড়বে। হামাস ও হিজবুল্লাহর সামনে লোকবল সংগ্রহ করা কঠিন কিছু হবে না।
মনে করিয়ে দেওয়া দরকার, ৪২ বছর আগে ১৯৮২ সালে লেবাননে ইসরায়েলি নারকীয় আক্রমণের ফলে হিজবুল্লাহর সৃষ্টি হয়েছিল। ২০০০ সালে দক্ষিণ লেবানন থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের আগ পর্যন্ত অনেক লেবানিজের কাছে দখলদারদের প্রতিহত করতে হিজবুল্লাহর ভূমিকা ছিল বৈধ। একইভাবে হামাস প্রথম ইন্তিফাদার প্রথম দিনগুলোতে তৈরি হয়েছিল, যা ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বরে গাজায় শুরু হয়। এটিও বৈধ প্রতিরোধ বলে দাবি করতে পারে।
উভয় ক্ষেত্রে ইসরায়েল শুধু একই প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হচ্ছে না, বরং প্রতিপক্ষ আগের তুলনায় যথেষ্ট শক্তিশালী, সমৃদ্ধ ও সুসংগঠিত। ইসরায়েলিদের বুদ্ধিমান ও দূরদর্শী অংশ যদি নিজ দেশের এ একমুখী, জবরদস্তিমূলক চূড়ান্ত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তাহলে বিস্ময়ের কিছু থাকবে না।
ইরানের ক্ষেত্রেও একই রকম দেখা যায়। ইরানের প্রেসিডেন্টের অভিষেক উপলক্ষে তেহরানে জুলাই মাসে ইসমাইল হানিয়ার হত্যাকাণ্ড একদিকে যেমন ছিল দুঃসাহসী, অন্যদিকে বেশ দারুণভাবে সেটি সম্পাদন করা হয়েছিল। লেবাননে পরিচালিত অভিযানের মতোই একজন ইসরায়েলি এজেন্টের কোনো রকম আঙুলের ছাপ বা ছবি পাওয়া যায়নি। কিন্তু সত্যিকার অর্থে ইসরায়েল তাতে কী অর্জন করেছে? তারা বিশ্বকে কেবল এটাই মনে করিয়ে দিয়েছে, তাদের উল্লেখযোগ্য সক্ষমতা রয়েছে, সম্ভবত ইরান ও হিজবুল্লাহ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অবমূল্যায়ন করেছে। গাজা যুদ্ধবিরতি আলোচনায় মূল আলোচকের হত্যাকাণ্ড যুদ্ধ বাড়িয়ে তোলার কারণ হিসেবে দেখতে হবে।
ইসরায়েলের কৌশল কি ইরানের পারমাণবিক পথে যাওয়া ঠেকিয়ে দিতে পেরেছে? প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এখানেও কেবল উস্কানির ভূমিকা পালন করেছেন– যুদ্ধ বাড়িয়ে তোলা। ২০১০ সালে ইসরায়েল ইরানের নাটানজ পারমাণবিক স্থাপনার উপাদানগুলোতে নাশকতার জন্য স্টুক্সনেট ক্ষতিকর কোড বসিয়ে দিয়েছিল। এটি অবশ্যই ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে পিছিয়ে দিয়েছিল, যেভাবে তারা অনেক পরমাণু বিজ্ঞানীকে হত্যা করেছিল।
তবুও আজ ইরান একটি পারমাণবিক রাষ্ট্রের দ্বারপ্রান্তে। পারমাণবিক হওয়ার পথ রুদ্ধ করতে ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি আগ্রাসন চরম কট্টরপন্থিদের আরও শক্তিশালী করেছে। এটা কি সত্যিই ইসরায়েল কিংবা এ অঞ্চলের স্বার্থে ছিল?
আত্মরক্ষার নামে কেবল শক্তির ওপর নির্ভর করার বিষয়টি হামাস ও হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধেও খাটে। তাদের কোনো সামরিক পদক্ষেপ সত্যিকারভাবে ফিলিস্তিনিদের জন্য স্বাধীনতা ও অধিকার নিয়ে এসেছে? রকেট ফায়ারে কত ইঞ্চি ফিলিস্তিন স্বাধীন হয়েছে?
ইসরায়েলের কাছে সব ক্ষমতা, কূটনৈতিক জোট ও অর্থনৈতিক পেশিসহ অনেক বেশি বিকল্প রয়েছে। তাদের একাডেমিক প্রতিষ্ঠান, থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ও গবেষণা দল রয়েছে। এগুলো বিবেচনায় নিলে তাদের দীর্ঘমেয়াদি পূর্ণ বিকশিত বিকল্প বুদ্ধিজীবিতার হাতিয়ার আছে। কিন্তু ইসরায়েলি নেতারা এসব দিয়ে কোন ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে চায়– বোঝা কঠিন। এ অঞ্চলে আগুন লাগার ফলে নিজেও পুড়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। ইসরায়েলি নেতাদের শান্তিপূর্ণ, অ-সম্প্রসারণবাদী নীতি প্রণয়নের মধ্য দিয়ে তাদের প্রতিবেশীদের সম্পৃক্ত করতে দীর্ঘ ও শক্তিশালী চিন্তাভাবনা করার সময় এসেছে। ইসরায়েলের কাছ থেকে এটি হবে প্রত্যাশিত পরিবর্তন, যেটি কৌশলের দিক থেকে সফল হলেও নীতিগতভাবে ব্যর্থতার দিকে ঝুঁকছে।