মতামত/কলাম প্রকাশনার সময়: বুধবার ১৮, সেপ্টেম্বর ২০২৪

রাজনীতির সংস্কার চাইলে ‘বৈষম্যের‘ উৎসের দিকেও নজর দেয়া উচিৎ

Share on:

‘সংস্কার’ এ সময়ে বাংলাদেশে সবচেয়ে উচ্চারিত ও আলোচিত শব্দ। সবাই রাষ্ট্রের সংস্কার চায়। কেউ কেউ ‘রাষ্ট্রের মেরামত’ চায়। শব্দে সামান্য হেরফের। চাওয়া একই। বোঝা যাচ্ছে, এ রাষ্ট্রে অনেকেরই আর পোষাচ্ছে না।


খানিক ঠিকঠাক করে ‘রাষ্ট্র’কে আবার ঝকঝকে তকতকে করতে ইচ্ছুক দেশের মানুষ। কেউ কেউ ঝামা-ইট দিয়ে ঘষে রাষ্ট্রের শরীর থেকে শেওলা-ময়লাও খানিক সরাতে চায়। এ রকম মানুষদের লক্ষ্য কিছুটা বেশি। কণ্ঠও কিছুটা উচ্চ।

কিন্তু রাষ্ট্র ও রাজনীতি যে ভিত্তি বা অবকাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, সেই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সংস্কারের কথা খুব একটা শোনা যাচ্ছে না কোনো দিক থেকে। উৎপাদন সম্পর্কের সংস্কারের কথা সম্ভবত আরও স্পর্শকাতর। শোনাই যায় না ওই আলাপ। সংস্কারের রূপকল্প তৈরি করতে সরকারিভাবে ছয়টি কমিশন গঠন করা হয়েছে সম্প্রতি। সেই তালিকায়ও ওই রকম কিছু নেই। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থান যদি হয় ‘বৈষম্যে’র ‘বিরোধিতা’ থেকে, তাহলে নিশ্চয়ই বৈষম্যের উৎসের দিকে তাকাতেই হবে।

সংস্কার ও অর্থনৈতিক প্রশ্ন

একটি দেশের রাজনীতির ধরন-ধারণ ঠিক করে সেখানকার অর্থনীতি ও উৎপাদন সম্পর্ক। এটাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গোড়ার কথা। উৎপাদনের উপকরণগুলোর মালিকানা যার, জমি ও কারখানাগুলো বেশির ভাগ যাদের হাতে, রাজনীতিতে তাদেরই প্রতাপ থাকবে—সেটাই স্বাভাবিক। ভারতে আদানি-আম্বানিরা, পাকিস্তানে শরিফ ও ভুট্টোরা কিংবা বাংলাদেশে সালমানরা এভাবেই তো অধিপতি শ্রেণি।

নির্বাচনী ব্যবস্থা সুষ্ঠু হলেও তাঁরাই ‘জনপ্রতিনিধি’ হন বা জনপ্রতিনিধিদের কাছের মানুষ হিসেবে ‘রাজনৈতিক-অর্থনীতি’র অভিভাবক হয়ে ওঠেন। ফলে রাজনৈতিক ব্যবস্থার ‘সংস্কারে’র আন্দোলনে এই ধনীরা ঘাবড়ান না। সহজে এবং স্বল্প সময়ে তাঁরা এ রকম বাস্তবতার সঙ্গে সমন্বয় করে নিতে পারবেন। দক্ষ ‘সমন্বয়কারী’ তাঁরা। হয়তো বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রত্যাশিত মেরামত শেষেও এ রকম সমন্বয়কারীদের জন্য বড় আকারে উদ্বেগের কিছু নেই।

কারণ, কেবল উপরিকাঠামোর সংস্কার অধিপতি শ্রেণির সামনে বড় আকারে কোনো চ্যালেঞ্জ তৈরি করে না—যদি না তাতে উৎপাদনব্যবস্থার সংস্কারও যুক্ত হয়। কিন্তু বাংলাদেশ এখন সেদিকেও যাবে কি না? রাষ্ট্র ও রাজনীতি সংস্কারের সুফল সবার কাছে নিতে সেদিকে না গিয়ে কোনো বিকল্প আছে কি না? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বসলে বাংলাদেশের ধনবৈষম্যের সাম্প্রতিক নির্মম চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

এ বছরের শুরুতে অনেক দৈনিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ রকম উপাত্ত ছেপেছিল, শুধু গত ৫ বছরে এ দেশে কোটিপতি হিসাব বেড়েছে ৩০ হাজার! ২০১৯-এ যা ছিল ৮৪ হাজারের কম—এ বছরের শুরুতে সেটা ১ লাখ ১৪ হাজার ছাড়িয়েছে। এর মাঝে করোনা গেছে। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাত গেছে। বিশ্বে মন্দার শোরগোল শোনা গেছে। এ রকম কোনো ধরনের দুর্যোগ বাংলাদেশে একটি গোষ্ঠীর সম্পদ সংগ্রহে বিঘ্ন হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। ১৭ কোটি মানুষের দেশে ব্যাংক আমানতের প্রায় অর্ধেক এই অল্প ‘হিসাব’গুলোর হাতে। নিশ্চিতভাবেই ‘সংস্কারে’র অ-অর্থনৈতিক অভিঘাতেও তারা দমে যাবে না।

উল্টো দিকে কী হচ্ছে? পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা জরিপকে (২০২২) উদ্ধৃত করে বাংলাদেশ প্রতিদিন এ বছরই রিপোর্ট করেছিল, সমাজের সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষের আয় দেশের মোট আয়ের ১ দশমিক ৩১ শতাংশ মাত্র। আর একদম ওপরতলার ১০ শতাংশের আয় দেশের মোট আয়ের ৪১ শতাংশ। একজন গরিবের তুলনায় একজন ধনীর আয় অন্তত ১১৯ গুণ বেশি। একজন গরিব ১ টাকা আয় করলে একজন ধনী আয় করেন ১১৯ টাকা।

এ রকম অবস্থায় একটি সুষ্ঠু নির্বাচন বা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের গণতন্ত্রায়ণ বা বাংলা একাডেমি ও বিটিভিতে কয়েকজন ভালো কর্মকর্তার নিয়োগ নিচুতলার ১০ ভাগের জীবনে কতটুকুই–বা আর পরিবর্তন ঘটাতে পারে? তারা নিশ্চয়ই নির্বাচন করতে পারবে না। তাদের ছেলেমেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার বহু আগেই জীবনযুদ্ধে নেমে পড়ে। টিভির কোনো সংবাদ বা ফিচারে তাদের দেখানো হবে হয়তো কেবল জাতীয় পুষ্টি দিবসের তথ্যচিত্রে। কিংবা আশুলিয়ার শ্রমিক বিক্ষোভে তাদের সন্তান অজ্ঞাত গুলিতে নিহত হলে। অথচ এরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। গণ-অভ্যুত্থান শেষে বারবার উচ্চারিত সংস্কারের কথা তো এ রকম মানুষজনকে দেখিয়েই। সুতরাং সংস্কারের প্রশ্নের সঙ্গে দেশের সম্পদ পুনর্বণ্টনের রয়েছে গভীর যোগ। দুটোকে আলাদা করে বিবেচনা করা মানে স্পষ্ট বেইমানি। কিন্তু সম্পদ পুনর্বণ্টনের আওয়াজ কোথায়?

রাষ্ট্র না বুঝে রাষ্ট্র পুনর্গঠন?

গণ-অভ্যুত্থানের দ্বিতীয় দিন থেকে গত প্রায় এক মাস আমরা জোরেশোরে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের দাবিদাওয়া দেখছি। আবার একই সঙ্গে সেই লক্ষ্যে নীতিনির্ধারকদের সদিচ্ছাও দেখছি। ইতিহাসে এটা অভূতপূর্ব ক্ষণ, যখন কোনো দেশে নীতিনির্ধারক এবং জনতা উভয়ে একই ধরনের রূপান্তরবাদী প্রত্যাশার অংশীদার। এই স্বর্ণালি মুহূর্তটা ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে যদি ‘পুনর্গঠনে’র আলাপ করতে গিয়ে খোদ ‘রাষ্ট্রে’র আলাপই আমরা না বুঝে থাকি। কিংবা বুঝলেও যদি সচেতনভাবে সেই আলাপ এড়িয়ে যাই।

যেকোনো দেশে ‘রাষ্ট্র’ ও ‘রাজনীতি’ দাঁড়িয়ে থাকে অর্থনীতির জগতের ‘উৎপাদন সম্পর্কে’র ওপর। একটি সমাজের যাবতীয় উৎপাদন সম্পর্কের যোগফল সেই সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো। সে জন্যই রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে বলা হয় উপরিকাঠামো, আর যার ওপর সেই কাঠামো দাঁড়ায়—সেই ভিত্তি বা বনিয়াদ হলো অর্থনীতির জগৎ। আরও সরাসরি বললে, ‘রাজনীতি হলো অর্থনীতির ঘনীভূত প্রকাশ।’

তবে রাজনীতিতে অর্থনীতির গুরুত্ব কেবল এটুকুই নয়। আরও অনেক বেশি এবং সেটা ব্যক্তিপর্যায়েও। মানুষের জীবনদৃষ্টি গড়ে তোলে তার চারপাশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক। এভাবেই গড়ে ওঠে সম্মিলিত ‘সামাজিক চেতনা’।

এ রকম এক সামাজিক চেতনাই কিন্তু ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান ঘটায়। অর্থাৎ এই গণ-অভ্যুত্থান ছিল গত ১৫ বছরের যাবতীয় অর্থনৈতিক সম্পর্কের নির্মমতার প্রকাশ। বিগত দেড় দশকের যাবতীয় বঞ্চনা ও নির্মমতার ক্ষোভকে ধারণ করেই বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ‘বাংলা বসন্তে’ শরিক হয়। যার বড় প্রমাণ অভ্যুত্থানকালে নিহত ৮০০ মানুষের মধ্যে ১০০ জনের বেশি শ্রমজীবী মানুষ।

আন্দোলনকালে যে জায়গাটিকে ‘প্রতিরোধের লেনিনগ্রাদ’ বলা হতো, সেই যাত্রাবাড়ী এলাকায় কিন্তু কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। এটা মুখ্যত শ্রমজীবীদের এলাকা। এখানকার মানুষ কেন জীবন বাজি রেখে রাস্তায় নেমেছিলেন? তাঁরা কেন অকাতরে জীবন দিলেন? উত্তর অনুমান করা কঠিন নয়। তাঁরা হয়তো ভেবেছিলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ের ভেতর দিয়ে দ্রব্যমূল্যের সিন্ডিকেট ও প্রতিদিনকার পুলিশি চাঁদাবাজির মতো সমস্যাগুলো দূর হবে; তাঁদের মজুরি বঞ্চনার অবসান ঘটবে। আদৌ হবে কি সেসব? কোন প্রক্রিয়ায়?

গ্রামের মানুষ জুলাই-আগস্টের উত্তাল দিনগুলোতে টিভির পর্দার সামনে বসে বসে তরুণদের জন্য যে মনে মনে শুভকামনা জানিয়ে গেছে, তারই বা প্রতিদান কী? সেখানকার জমিগুলো কিন্তু ক্রমাগত চাষাবাদে অনুপস্থিত শহুরে মালিকদের দখলে যাচ্ছে। শহুরে ‘দুর্নীতি’র ‘বাগানবাড়ি’ হচ্ছে গ্রাম। এত দিন এটাকে উন্নতি বলা হয়েছে। অথচ গ্রামজুড়ে কাজের অভাব। সামনে অবস্থা কি বদলাবে?

শ্রম সম্পর্কে দমবন্ধ দশা

গত ১৫ বছর বিভিন্ন শিল্প খাতে মাঝেমধ্যে মজুরি বাড়লেও সেটা এত অল্প বেড়েছে যে প্রতিবারই ‘প্রকৃত মজুরি’ ছিল প্রায় নতুন মজুরির কম। সবচেয়ে বড় বিষয়, শ্রমিকেরা শান্তিতে মজুরি বাড়ানোর কথা বলতে পারতেন না মামলা-মোকদ্দমার ভয়ে। শ্রমিক সংগঠকদের গুম হয়ে যাওয়ার নজিরও আছে।

অথচ একই সময়ে ব্যবসায়ী ও শিল্পকারখানার মালিকেরা বেশি বেশি করে পার্লামেন্টের সদস্য হয়েছেন। সর্বশেষ জাতীয় সংসদে ১৯৯ জন ছিলেন ব্যবসায়ের জগতের মানুষ। আগের সংসদে এই সংখ্যা ছিল ১৮২ জন। মালিক শ্রেণির প্রতিনিধিরা যে দেশের নীতিনির্ধারণে এক-তৃতীয়াংশ থাকেন, সেখানে শ্রমিক স্বার্থে জাতীয় সিদ্ধান্ত হওয়ার নয়। হয়ওনি।

দেশের পার্লামেন্টের সদস্যপদ যে শিল্পকারখানা ও ব্যবসায়ীদের দখলে যাচ্ছে, সে বিষয়টি তথ্য-উপাত্তসহ বিশেষভাবে মনোযোগে আনে ‘সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)’ নামে একটি সংগঠন। মনোনয়ন ফরমের সঙ্গে প্রার্থীরা যে হলফনামা দেন, তা বিশ্লেষণ করে সুজন রাষ্ট্রচিন্তার সেই গোড়ার কথা আবার নতুন করে বাংলাদেশের মানুষকে জানায়। সেটা হলো, ‘রাষ্ট্র’ আসলে এক শ্রেণির ওপর আরেক শ্রেণির আধিপত্যেরই জায়গা এবং অর্থনীতিতে যারা অধিপতি শ্রেণি, রাজনীতি-সংসদ-প্রশাসন তাদেরই কথা শোনে।

রাজনীতি এবং বিশেষভাবে নির্বাচনী রাজনীতির অবস্থা এখন এমন, মধ্যবিত্তরাও সেখানে আর সুবিধা করতে পারবে না। এ রকম মধ্যবিত্তরাই শেয়ারবাজারে সর্বস্ব হারিয়েও বিচার পায়নি। কারণ, শেয়ারবাজার লুণ্ঠনের সঙ্গে যুক্ত বলে অভিযুক্তরা নীতিনির্ধারণী পরিসরে জায়গা করে নিয়েছিল। ৩০ টাকা কেজির আলু ৭০ টাকা হওয়ার পরও যে মার্কেট সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে প্রশাসনকে নামানো যায় না, সেটাও ওই একই কারণে। কোম্পানির মুনাফায় শ্রমিক হিস্যার অংশটা শ্রম আইনে থাকার পরও যে ঠিকঠাকমতো দিতে হয় না, তারও ব্যাখ্যা ও রকমই। তাহলে পুরোনো এই পরিস্থিতি পাল্টানো যাবে কি? উত্তর ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’ দুটোই।

কেবল রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে, রাষ্ট্রের সংস্কার করে ন্যায্যতার ধারণা একটা মরীচিকা। একধরনের ধোঁকা। মালিকানা সম্পর্কের সংস্কার না করে, চলতি উৎপাদন সম্পর্ক না পাল্টিয়ে ৯৯ শতাংশের ক্ষমতায়ন হবে না। সংস্কারের রাজনৈতিক সুবিধা নিয়ে নেবে তখন ওপরতলার পুরোনো ১ শতাংশ মানুষই। নতুন চেহারায় আগের মতো অধিপতি শ্রেণি হয়ে থাকবে তারা।

তবে আলোচনার পাদটীকা হিসেবে এ–ও বলতে হয়, বাংলাদেশের ধনীরা যেভাবে সম্পদ পুঞ্জীভবনের নির্মম পথে হেঁটেছেন বিগত সময়ে— কর্মীদের জীবনধারণের ন্যায্য মজুরি না দিয়ে, ব্যাংক-বিমা নিঃস্ব করে, ভূ–সম্পদকে ক্রমাগত কুক্ষিগত করে, প্রাণ-প্রকৃতিকে নির্মমভাবে কলুষিত-দূষিত করে, বিদেশিদের কাছে দাসখত দিয়ে, কেবল ক্ষমতার চারপাশে নিজেদের নিরঙ্কুশ রেখে—তারও একটা শেষ আছে। কেবল ‘দমনে’র গোপন অভিলাষ নিয়ে ‘শাসক’রা বাংলাদেশে আর চিরস্থায়ী হতে পারবে না। শাসনে জনতার স্বতঃস্ফূর্ত ‘সম্মতি’র জন্য রাষ্ট্রের অবকাঠামোতে খেটে খাওয়াদের ন্যায়ানুগ ‘অংশীদারত্ব’ও দিতে হবে। ইতিহাস সেদিকেই এগোচ্ছে।

যদি নব্বইয়ের অভ্যুত্থানকর্মীদের চেয়ে এবারের ছাত্র-জনতা এক ধাপ এগিয়ে এক কাতারে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলতে পারে, তাহলে নিশ্চয়ই একদিন তারা মুখ্যত উৎপাদন সম্পর্কের সংস্কারের কথাও বলতে পারবে।

প্রথম আলো