রাজনীতিতে দলবদল ও দুধের মাছি
Share on:
রাজনীতিতে দলবদল এবং খেলায় দল পরিবর্তন এক কথা নয়। রাজনীতির সঙ্গে মানুষ আদর্শের জায়গা থেকে যুক্ত হয়। আদর্শিক সংগঠনে দল সংকটে পড়লেও নেতাকর্মী দুর্দিনের বন্ধু হয়ে থাকে। প্রয়োজনে জেল-জুলুম, নির্যাতন স্বীকার করে।
আদর্শিক লড়াইয়ের অংশ হিসেবে এই বাস্তবতা তারা মেনে নেয়। অন্যদিকে খেলায় যে দল বেশি অর্থ দেয়, সেদিকেই খেলোয়াড়ের যাওয়ার ঝোঁক থাকে। খেলার পারিশ্রমিক হিসেবে সেটা ন্যায্য হতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক দলে যারা দুধের মাছি, অর্থাৎ সুসময়ের বন্ধু এবং দুঃসময়ে পাশে থাকে না, তাদের নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার দেশত্যাগ ও আওয়ামী লীগের দুরবস্থায় নেতাকর্মীর দলবদল নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সিলেটে ছাত্রলীগের এক নেতার জামায়াতে ইসলামীতে যোগদানের ঘটনায় সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। বিস্মিত হওয়ার কারণ হলো, আদর্শিক দিক থেকে সংগঠন দুটি দুই মেরুতে অবস্থান করছে। আওয়ামী লীগের গত দেড় দশকে যে জামায়াতে ইসলামী নির্যাতনের স্বীকার হয়েছিল, সেই দলে ঠিক এই সময়ে ছাত্রলীগের নেতা যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে শুরুতে পিঠ বাঁচানোর বিষয়টিই মনে আসবে। এ ঘটনার পর জামায়াতে ইসলামী অবশ্য দলটিতে যোগ দেওয়ার বিষয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে।
শনিবার সমকালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে খুলনার চিত্র সামনে এসেছে। ‘দল ছাড়ছেন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী’ শিরোনামের প্রতিবেদনে অবশ্য তারা কোন দলে যাচ্ছে, সেটির উল্লেখ নেই। তবে আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগ নেতা অনেকে দলীয় পদ ছাড়ার পাশাপাশি আর কোনোদিন রাজনীতি না করার ঘোষণা দিয়েছে। এই সময়ে আওয়ামী লীগ নেতারা কেন আত্মগোপনে, কেন দল ছাড়ার ঘোষণা দিচ্ছেন, তা অনুধাবন করা কঠিন নয়। আত্মগোপনে থাকা এসব নেতা ফেসবুক বা সংবাদমাধ্যমের কাছে দল ছাড়ার ঘোষণা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাইছে, যাতে আওয়ামী লীগার বলে তারা সমস্যায় না পড়ে।
কেউ চাইলে রাজনীতি ছাড়তে পারে, আবার অন্য দলে যোগ দেওয়ার স্বাধীনতাও প্রত্যেকের আছে। রাজনীতি থেকে যে কেউ যে কোনো সময় অবসরও নিতে পারেন। একই সঙ্গে আদর্শিক অবস্থান পাল্টালে বা অন্য দলের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সে তাদের সংগঠনে যুক্ত হতে পারে। কিন্তু সময়টা গুরুত্বপূর্ণ। আগেও অনেকের ক্ষেত্রে আমরা দলবদল দেখেছি দলের দুর্দশার কারণে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলে যোগ দেওয়ার প্রবণতা থাকে অনেকের মধ্যে। ক্ষমতার হালুয়া-রুটির ভাগের আশায় যারা দল বদল করে, তারা নিশ্চয় দুধের মাছি; ক্ষমতা চলে গেলে তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। আবার হয়তো নতুন করে যে দল ক্ষমতায় যায়, তাদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার উপায় খোঁজে।
এ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর শিক্ষাও কম নয়। প্রথমত, যারা সুসময়ের বন্ধু, তাদের দলে ভেড়ানোর ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা। তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে যা ইচ্ছা তা না করা। ক্ষমতা যে চিরস্থায়ী নয়, আওয়ামী লীগ থেকেই তা শিক্ষণীয়। দলটির নেতাকর্মী অনেকেই দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে বেপরোয়া হয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করতেও কুণ্ঠিত হয়নি। তারা প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের ওপর যেমন নির্যাতন চালিয়েছে, তেমনি নানাভাবে দুর্নীতি, অনিয়ম ও অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। মানুষ তাদের ওপর অতিষ্ঠ হয়েই স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেয়। আওয়ামী লীগের পতনের পর জনরোষের ভয়ে এখনও দলটির নেতাকর্মী অনেকে আত্মগোপনে। বাঁচার স্বার্থেই তাই কেউ দল ছাড়ার ঘোষণা দিচ্ছে কিংবা অন্য দলে যাওয়ার চেষ্টায়ও আছে হয়তো অনেকে।
যারা রাজনীতি করে, তারা দেশ ও দশের সেবা করার কথা বলে। তাদের কাছে নিজের উন্নতির চেয়ে দেশের উন্নতিই মুখ্য হওয়া এবং ক্ষমতা পাওয়ার পরও সে লক্ষ্যেই কাজ করা উচিত। সেখানে যখনই ব্যত্যয় ঘটে তখনই সংকট সৃষ্টি হয়; দলবদলও তার বাইরে নয়।